রোযা ও নারীদের পিরিয়ড

প্রকাশিত: ১২:১৪ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২৯, ২০২৫

রোযা ও নারীদের পিরিয়ড

সাবরিনা হোসেন |

রমযান মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে! ইবাদত, ইফতার, সেহেরি, যাকাত, ঈদের কেনাকাটা সবকিছু মিলে অন‍্যরকম আমেজে অসম্ভব দ্রুততায় মাসটি চলে গেল! যাঁরা রোযা রাখেন অথবা যারা শারীরিক কোন সমস্যার কারণে রোযা রাখতে পারেন না-সবার মনই কেমন যেন হু হু করে – মাসটি চলে গেল !
যারা জেলখানায় রমযান পালন করেন তারা সত‍্যিকার অর্থেই এই মাসটির জন‍্য হাহাকার করেন এবং বছর জুড়ে এই মাসটি আসার অপেক্ষায় থাকেন! কারন এই মাসে যারা রোযা রাখেন তাদের জন‍্য কারা কতৃপক্ষের পক্ষ থেকে ইফতার বরাদ্দ থাকে ! ছোলা, মুড়ি, জিলাপি, ডালের বড়া, শরবতের চিনি, কলা সেই সাথে একটা আস্ত সেদ্ধ ডিম !
প্রতিদিন রোযাদারের লিস্ট হয় ! যারা রোযা রাখেন না তারাও রোযাদারদের লিস্টে নাম ওঠাতেন এই ইফতারের খাবারটুকু পাবার আশায় ! পৃথিবীতে যত ধরনের খেজুর পাওয়া যায় তার মধ্যে সবচেয়ে নিম্নমানের খেজুর দেয়া হতো – তারপরও খেজুর তো! একটা খেয়ে আরেকটা তারা জমিয়ে রাখতো রোযার মাস শেষ হলে খাবেন বলে!
মুড়ি কিন্তু মোটেই পোতাইন‍্যা নয়- মচমচে! জিলাপিও রসালো! তবে ডালের বড়া এতটাই শক্ত যে একমাত্র নাছোড়বান্দা কয়েদী ছাড়া কেউই নিজের দাঁতের উপর ঝুঁকি নিয়ে এগুলো চিবাতো না ! কারন মহিলা কারাগারে দাঁতের ডাক্তার নেই ! শত্রুতা করে কেউ কাউকে ডালের বড়া ছুঁড়ে মারলে আহতের কপাল তৎক্ষণাৎ ফুলে গোলআলু হয়ে যেত !
শরবতের জন‍্য যে চিনি দেওয়া হতো – রুমের পাহারা অধিকাংশ সময়ই সেই চিনি লুকিয়ে নিজের বোয়াম ভরে রাখতেন বছর জুড়ে খাবেন বলে! রুমের অন‍্য বন্দীদের যৎসামান্য দিতেন ! কলা নিয়ে রোজই ঝগড়া এমনকি চুলোচুলি পর্যন্ত হতো ! কার কলা সাইজ বড়- কারটা পচে কালো হয়ে গেছে !
পাহারার ঘনিষ্ঠ বন্দিনীরা পাহারা কোটায় পরিমাণে বেশি পেতো! বিষম‍্য ব্যাপারটা কারাগারেও প্রকট ছিলো !
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইটেম ছিলো সেদ্ধ ডিম ! যারা বছরের পর বছর জেল খাটছে- পুরানো হাজতী বা কয়েদি তাদের অনেকেই একমাত্র রোযার মাস ছাড়া ডিম খাওয়া তো দূরের কথা- ডিম চোখেও দেখতে পান না ! হাতের তালুর মধ‍্যে আস্ত একটি ডিম- ভাবা যায় !? এ তো স্বপ্ন! এর কাছে ন‍্যয় অন‍্যায় বোধ সব ফিকে! একটি ডিমের জন‍্য রোযা না রেখেও রোযা রেখেছি এমন মিথ‍্যা অনায়াসে বলা যায় ! মিথ‍্যাবাদীরা তাদের মিথ্যা ধরা পড়লে কি অজুহাত দিবে তা তৈরি করেই রাখে! তাদের অজুহাত ছিলো ধরা পরলেই বলবে, এই মাত্র মাসিক হয়ে রোযা ভেঙ্গে গেছে !
একবার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী হাসিনা আন্টি ধরা পরে গেলেন ! উনার বয়স পঁচাত্তর – দশ বছর আগেই স্বামী গত হয়েছেন! ছেলেরা মাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, জেল খাটা মায়ের সাথে তারা কোন ধরনের সম্পর্ক রাখতে নারাজ! দেখার ঘরে তাকে কেউ দেখতে আসেনা বহু বছর হলো! এমনকি সাপ্তাহিক ফোনালাপের দিনেও তার কথা বলার মতো আপনজন এই জগৎসংসারে নেই ! বেচারী শীর্ণ দেহে রোযাও রাখতে পারেন না ! কিন্তু ইফতার বিশেষ করে ডিম খাবার জন‍্য রোযাদারের লিস্টে নাম লেখাতেন !
কিছু নির্বোধ নারী কূটনামী করে নিজের পায়েই কুড়াল মারে! এমনই একজন নারী বন্দী হাসিনা আন্টিকে পানি খেতে দেখে তিনি যে রোযা রাখেন নি সেটা কতৃপক্ষকে জানিয়ে দিলেন! বিচার বসলো -সবার সামনে ! নিরুপায় হয়ে হাসিনা আন্টি অধোবদনে জানালেন, এতদিন তিনি রোযা ছিলেন – আজই তার মাসিক হয়েছে এজন্য রোযা ভেঙ্গে গেছে !
পঁচাত্তর বয়সী নারীর ক্ষেত্রে এই তথ‍্য বিশ্বাসযোগ্য হলোনা! কতৃপক্ষ রুমের পাহারাকে হাসিনা আন্টিকে তল্লাশি করে সত‍্যতা যাচাই এর হুকুম দিলেন ! তল্লাশির সেই প্রক্রিয়া একটাই নির্মম, এতটাই কুৎসিত যে, এই বৃদ্ধা নারীর অপমানে সারা পৃথিবী বুঝি সেদিন স্তব্ধ হয়ে গেল ! অসহায় আক্রোশে, অসম্ভব যন্ত্রণায় মাথা নিচু করে রইলাম !
আজ আড়ং এ বোনের নবজাতক বাচ্চার জন‍্য পোশাক কিনতে গেছি! পাশেই টেরাকোটায় ইফতার বিক্রি হচ্ছে! জিভে জল আসা ঘ্রাণে সেদিকে এগুলাম ! অনেক দাম ! হঠাৎ হাসিনা আন্টির কথা মনে পরে গেল !
যে দুনিয়ায় কিছু মানুষ একটি ডিম সেদ্ধর জন‍্য সীমাহীন গ্লানি আর অপমানের শিকার হয় সেই দুনিয়া থেকে ফিরে এসে আমার দামী কিছু খাবার কেনার রুচি হলোনা !

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ