মিটু নিয়ে অনেকদিন আগে লেখা একটা গল্প

প্রকাশিত: ৯:৫৬ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০২৫

মিটু নিয়ে অনেকদিন আগে লেখা একটা গল্প

সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায় |

মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তায় নেমে গেল মিতুল। এখান থেকে অফিসের পথ সামান্যই। কিন্তু কয়েক পা যেতে না যেতে বৃষ্টির তোড়টা সহসা বেড়ে গিয়ে বেশ বিপাকে ফেলে দিল মিতুলকে। অক্টোবর মাসের অবাক করা বৃষ্টি। যখন মেট্রোয় উঠেছে তখনো কোথাও এক ছিঁটে ফোঁটা মেঘ চোখে পড়েনি। এই সময় ছাতাও সঙ্গে থাকে না। ছাতা অবশ্য এমনিতেও সঙ্গে থাকে না। একটা তেইশ বছরের মেয়ে, চাকরি পেয়ে গিয়েও এখনো ইউনিভার্সিটির হস্টেল ছাড়েনি। মোটামুটি বোহেমিয়ান জীবন যাপন যার। আলুথালু থাকতে থাকতে শেষ মুহূর্তে একটু ম্যানেজ করার মতো গুছিয়ে নিতে অভ্যস্ত যে। কি খায়, কখন ঘুমোয়, কখন কি উৎপটাং কাজ করে ফেলে তার কোন ঠিক নেই। ছ’মাস হল চাকরিটা চেষ্টা করছে মন দিয়ে করতে, এই পর্যন্ত। কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে চাকরিটায়। যেদিন সত্যি মনে হবে বাড়াবাড়ি হচ্ছে, দপদপিয়ে পা ফেলে গিয়ে ফিচার এডিটরের কাছে রেজিকনেশন দিয়ে চলে আসবে। তা এরকম একটা মেয়ের টোট ব্যাগে যে অক্টোবর মাসে ছাতা থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। বৃষ্টির বেগ বেড়ে যাওয়ায় মিতুল তাড়াতাড়ি নতুন তৈরি হওয়া, গ্রানাইট লাগানো ঝকঝকে বাস স্ট্যান্ডের নিচে চলে এল। তাও যথেষ্ট ভিজে গেল সে। একটা টিস্যু পেপার বের করে একটু মুখ আর হাতটা মুছে নেবে ভেবে সে ব্যাগের ভেতর হাত ঢোকাতে যাবে, শুনল ফোন বাজছে। ওহঃ! কঙ্কনা! কঙ্কনাকে নটার সময় ফোন করবে বলেছিল মিতুল। দেরী হয়ে গেছে। এখন সাড়ে দশটা বাজে। আজ ঘুম থেকে উঠতে তার দেরী হয়ে গেছিল। সে ফোনটা ধরল, ” সরি, সরি। আর পাঁচ মিনিটে কল ব্যাক করছি।”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কঙ্কনা বলল,” আসলে আমাকে বেরোতে হবে। আমি তোমার ফোনের জন্য অনেকটা ওয়েট করলাম মিতুল। কিন্তু আর তো দেরী করা যাবে না। তুমি যদি ইন্টারভিউটা নিতে চাও তাহলে আজ রাত দশটার পর ফোন কোরো। ওকে?” ফোন কেটে দিল কঙ্কনা।
ইস! কঙ্কনার ইন্টারভিউটা নেওয়া খুব জরুরী একটা অ্যাসাইমেন্ট তার। আজকেই পাতা ধরানোর কথা। কাল যাবে। এখন কি হবে?
অফিসে নিজের কিউবিকলে পা রাখতেই সৌভিক এসে দাঁড়াল,” অবনদা ডাকছেন তোকে।”
তাদের পাতাটা অবনদা দেখেন। সে দ্রুত হাজির হল অবনদার ঘরে। “তুমি এসেছো? তা কি হল কঙ্কনার ইন্টারভিউটা।” অবনদা উঠে আসছেন। মিতুল এটা চায় না। এই ঘরে ডেকে অবনদার উঠে এসে কাছে দাঁড়ানোটা আর তারপর কথার মাঝখানে পিঠে হাত রাখাটা সে কোনমতেই চায় না। অবনদা তাই করল। খুব স্নেহ ঝরা গলায় বলল,” তোমার কি শরীর খারাপ নাকি?”

” না তো। শরীর খারাপ কেন হবে।” সে পিঠের ওপর থেকে হাতটা আলতো করে ঝরিয়ে দিতে চাইল।
” আসলে তোমাদের মেয়েদের তো অনেক রকম শরীর খারাপ হয়!” অবনদা হাসল নরম করে।
” আসলে আমার জন্য সেটা কোন অসুবিধা নয়।” বলল সে। “আমি ঠিক আছি।”
” তুমি তো খুব সাহসী মেয়ে মিতুল।”
সে প্রশ্ন চোখে নিয়ে তাকাল। হঠাৎ তাকে সাহসী মনে হল কেন অবন চৌধুরীর?
” ভেজা ভেজা সাদা শার্টের নিচে লাল ব্রা?”
সে মাথা নিচু করে ফেলল। তার এত কান্না পায় এই সব কথায়। এখনো অব্দি সে কাউকে বলেনি যে অবন চৌধুরী কি ধরণের ব্যবহার করছে তার সঙ্গে। দিন দিন অসভ্যতা বাড়ছে লোকটার।
সে বলল,” কি রংএর ব্রা পড়ব তাহলে?”
” সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে?” গলে পড়লেন অবন চৌধুরী হাসিতে।
নিজের কথার জালে নিজেই জড়িয়ে গেল মিতুল। সে বলল,” তা না। আসলে আপনিই তো বলছেন যে সাদা শার্টের নিচে লাল ব্রাটা বেশি সাহসী।”
” আহা, সাহসী মেয়েই তো আমার পছন্দের। একটু অ্যাডভেনঞ্চারাস। একটু ডেয়ারিং। তোমার প্রশস্তি গাইছি। বুঝলে না? আসলে তোমরা, ইয়াং মেয়েরা আমাকে বুড়োর দলে ফেলে দাও। আসলে কিন্তু আমি ভীষণ রোমান্টিক। এখনো আমার মনটা একটা পঁচিশ বছরের ছোকরার মত টগবগে আছে।”
” তাই অবনদা?”
” আরে তাই না তাই। তুমি তো আমাকে চান্সই দিতে চাও না। চান্স দিয়ে দেখোই না একবার। এখনো খাপ খোলা তলোয়ার।”
আজ মিতুল আর বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইল না। সে দেখতে চাইল লোকটা কত দ্রুত এগোতে পারে। সে শুধু একটু সরে গিয়ে অবন চৌধুরীর হাফ সার্কেল টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ার তিনটের মাঝেরটার সামনে গিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। সে মনে মনে লোকটাকে আজ সাধ্যমত প্রত্যাঘাত করার জন্য প্রস্তুত করতে লাগল নিজেকে। তার মনের মধ্যে সরু পিঁপড়ের লাইনের মত হেঁটে চলে গেল তার এই বেশ ভালো এবং সো কলড গ্ল্যামারাস পেজ থ্রির চাকরিটা, একটা সিংগল রুম ফ্ল্যাট যেটা সে গতকাল পছন্দ করেছে এবার ভাড়া নিয়ে মুভ ইন করবে বলে। সেই ফ্ল্যাটের ছিমছাম ব্যালকনিটার কথা মনে পড়ল, বন্ধুদের সঙ্গে দার্জিলিং যাওয়ার কথা নভেম্বরের ঠান্ডায়, টিকিট কাটা আছে, সামনের মাসের মাইনেটা ধরা আছে বেরিয়ে আসার খরচ। তার জীবনের প্রয়োজন, শখ, আহ্লাদ সব এই চাকরিটার ওপর এখন দাঁড়িয়ে আছে। বাবা নেই অনেকদিন। মা স্কুল টিচার। এমন কিছু আর্থিক অনটন নেই তাদের। তবু তেইশ বছরের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেয়ের বসে বসে খাওয়ার চিন্তা করাও অকল্পনীয় ব্যাপার। এবং আর একটা চাকরি চাইলেই পাওয়া যায় না। এই সব কিছু এই মুহূর্তে তার মাথায় চড়তে থাকা রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না আর। অবন চৌধুরী মঞ্চ নায়কের মত গলায় ঢেউ তুললেন, ” সরে গেলে কেন? আরে? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?
বসো, বসো মিতুল। কঙ্কনার ইন্টারভিউটা নিয়েছো?”
সে বলল, “কঙ্কনাদি রাতে কথা বলবে বলেছে।”
“কঙ্কনা কি তোমার দিদি হয়ে গেছে?”
“না, মানে, দিদি বলেই কথা বলছিলাম আর কি। তাছাড়া উনি একজন এত নামী অভিনেত্রী। বয়সেও বড়। ওঁকে তো নাম ধরে ডাকা যায় না।”
“ভালো। ভালো। হা,হা,হা। এই কঙ্কনাকে তো আজ চিনি না। যখন সিনেমায় নেমেছে তখন ওর বয়স কত হবে? কুড়ি বড় জোর। তখন কি কি করে এই লাইনে টিকে থেকেছে তা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। বুঝেছো। এখন #মিটু মিটু করছে। নায়িকার রোল তো আর পাচ্ছে না। টিভি শো হোস্ট করছে। তাতেও বোধহয় তেমন লাইম লাইটে থাকতে পারছে না? তাই এই মিটুর নাম করে আবার সংবাদ শিরোনামে আসার চেষ্টা।”
“অবনদা আপনি বলতে চাইছেন কঙ্কনার কথা বলার রাইট নেই?”
“হ্যাঁ রে বাবা। তাই বলতে চাইছি। কিসের রাইট? সব জায়গায় ইকোয়েশন তো একটাই। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হবে। মেয়েদের তো শরীর না দিয়ে কোথাও সুযোগ পাওয়ার চান্সই নেই আমাদের জগতে। বলো আছে? আর এরা তো নিজেদের ব্যবহার করেই এতদূর এগিয়েছে।”
মিতুল অবাক হওয়ার ভান করল,”কেন? কেন নেই? কার সমস্যা এটা অবনদা? যোগ্যতা থাকলেও একটা মেয়েকে শরীর দিতে হবে কেন?”
“যোগ্যতা? কিসের যোগ্যতা? যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ তোমাকে দিচ্ছে কে? সেই সুযোগ পেতে গেলে তো আগে তোমাকে সুবিধা দিতে হবে। এটাই চলছে। এটাই চলবে। যাক গে। যাক গে। তুমি এসব বোঝো না নাকি? মেয়েরা মার পেট থেকে পড়েই এসব বুঝে যায়।”
“তাই নাকি? আপনারও তো আমার বয়সী একটা মেয়ে আছে।”
অবন চৌধুরী অবাক হয়ে তাকালেন মিতুলের দিকে। যেন এত আশ্চর্য কথা উনি জীবনে শোনেননি। একটু একটু করে মুখটা লাল হয়ে গেল লোকটার। “এই শোনো মিতুল, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছি বলে তোমার স্পর্ধা বেড়ে গেছে তাই না? জানো তোমার চাকরি আমি নট করে দিতে পারি একটা মুহূর্তে? অ্যাঁ? জানো সেটা? একটু বুঝে শুনে কথা বলো। তোমাদের মুসকিল কি জানো তোমরা বেশি স্মার্ট। যাও, যাও। কঙ্কনার ইন্টারভিউটা রেডি করো। কি করলেটা কি কাল থেকে? আজ পাতা ধরাতে হবে। যাও, গো এন্ড গেট ইট ডান। আর কোন লেকচার শুনতে চাই না।”
“শুনুন অবনদা। আমি আপনাকে কোন লেকচার দিতে চাই না। দিতে চাইওনি। আপনাকে একটা সোজা প্রশ্ন করেছি শুধু। বলুন না, আমার মত একটা মেয়েকে কেন আপনাদের মত মানুষদের এই সব অ্যাডভান্স সহ্য করতে হবে? আমি তো এখানে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে ঢুকেছি। আমি সাধারণ একটা মেয়ে। সাধারণ একটা চাকরি পেয়েছি শুধু পড়াশুনা করে। কাউকে ধরিনি। কোন অবৈধ সুযোগ নিই নি। আর লাফ মেরে মেরে উন্নতি করার লোভে কোন অনৈতিক রাস্তাও অবলম্বন করি নি। যারা করে তাদের কথা আলাদা। তারা যা করে তার দায়িত্ব তাদের। আমি তো করি না। তাহলে আমাকে একটা সঠিক রাস্তায় হাঁটা থেকে কেন বার বার ভুল রাস্তার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? কেন আমাকে ব্রেণওয়াশ করানো হচ্ছে যে আসলে তোমার যোগ্যতা যাই থাক তার সঙ্গে তোমার দেহকে পাঞ্চ না করলে তুমি এখানে করে খেতে পারবে না! ক্রমাগত এই প্রেশারে থাকতে থাকতে একটা মেয়ে এক সময় নিজেকে যখন সাবমিট করে তখন তো আপনারাই বলেন, “আরে বাবা, এসব করেই তো টিকে আছে”। ফলে অবনদা একটা কাগজের দফতরে একটা #মিটু আন্দোলন নিয়ে গাল ভরা স্টোরি আর দায়বদ্ধতামূলক ইন্টারভিউ লিখতে লিখতে একটা মেয়েকে আপনার পিঠে হাত বোলানো, ব্রা এর রং নিয়ে কথা, আপনার সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার প্রস্তাব সব সহ্য করতে হয়। আমার এক বান্ধবী পুলিশ অফিসার, বুঝলেন? ইভ টিজারকে পিটিয়ে তুলে এনে লক আপে দিয়ে বসের চেম্বারে গিয়ে তাকে কি শুনতে হয় জানেন, ”আরে, কুল ডাউন, কুল ডাউন, এই সব পেটি কেসে এত উত্তেজিত হলে চলে? উত্তেজনায় তোমার বুক যা উঠছে, নামছে দেখে তো আমারই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে শ্বেতা!” আমার হস্টেলের যে কাজের মেয়েটা? বাসন মেজে, ঘর মুছে 1200/- টাকা রোজগারের জন্যও ওকে কাজের বাড়ির বাবুর পেছন টেপা খেতে হয়। ভাবুন তো। এর সঙ্গে উন্নতি, সাফল্য এসব শব্দ যায় না। দুঃখ হয় এই ভেবে যে আপনি ভাবেন এই জঙ্গলের রাজত্বে আপনার মেয়েটি সেফ। আরে আপনি কত বড় তাবড় একটা লোক? একটা কাগজের সাপ্লিমেন্ট পেজের এডিটর। এই তো। কি আপনার ক্ষমতা? কোন ক্ষমতা নেই এই এত বড় নরকের ভেতর থেকে শুধু নিজের মেয়েটির সম্মানকে রক্ষা করার, বুঝলেন। পেট থেকে পড়ে আপনার মেয়েও সব বুঝে বসে আছে। চাকরিটা আমি ছাড়ব না। আপনি তাড়াতে চাইলে তাড়ান। তারপর দেখা যাবে।”

ঠিক এই সময় মিতুলকে ফোন করল কঙ্কনা। মিতুল একটু দম নিয়ে ফোনটা ধরল,” হ্যাঁ, কঙ্কনাদি?”
“মিতুল আমার শুটিং ক্যানসেল হয়েছে। তুমি কি ইন্টারভিউটা নেবে এখন?”

মিতুল অবন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে খুব কেটে কেটে বলল,”আমি এই মুহূর্তে একটা #মিটু পরিস্থিতিতে রয়েছি। নিজের ডেস্কে ফিরে গিয়েই আপনার ইন্টারভিউ নেব কঙ্কনাদি। জাস্ট ফিউ মিনিটস্।”
কঙ্কনা ওপাশে চুপ করে ধরে রইল ফোনটা, তারপর বলল, “যাও ডেস্কে, আমি ফোন ধরে আছি।”
#

সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়
কলকাতা,
০৬ এপ্রিল ২০২৫