সিলেট ১১ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৯:৩১ পূর্বাহ্ণ, মে ১০, ২০২৫
সামরিক বাহিনী বর্তমানে সরাসরি ক্ষমতায় না থাকলেও ‘ডিপ স্টেট’ বা অপ্রকাশ্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র পাকিস্তান, যার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নানা কারণে জটিল। পরমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে পাকিস্তান শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তাই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। তবে, দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেসামরিক সরকারগুলো কখনোই পূর্ণ স্বাধীনতা বা কর্তৃত্ব উপভোগ করতে পারেনি সেখানে। এর প্রধান কারণ সামরিক বাহিনীর ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কেবল জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাজনীতি, অর্থনীতি এবং কূটনীতিতেও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
পাকিস্তানের সরকার ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি:
সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবে, সামরিক বাহিনীর প্রভাবের কারণে দেশটির রাজনীতিতে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা একটি ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্য। এই পরিস্থিতি দেশটির গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দুর্নীতির অভিযোগ এবং সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হস্তক্ষেপ নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর থেকে দেশের রাজনীতি আরও বিভক্ত ও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এছাড়া, বেলুচিস্তানে স্বাধীনতা সংগ্রাম, সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন এবং চোলিস্তান ক্যানাল প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক, কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব, দুর্বল অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট এবং আন্তর্জাতিক ঋণের চাপ সরকারের জন্য নানামুখী চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। ফলে জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা ও সামাজিক অসন্তোষ ক্রমশ বাড়ছে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব:
পাকিস্তানের ইতিহাসে বেশ কয়েকবার সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল করেছে। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই প্রবণতা শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের (১৯৫৮-১৯৬৯) অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই প্রবণতা শুরু হয়। পরবর্তীতে আরও তিনটি উল্লেখযোগ্য সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান (১৯৬৯-১৯৭১) পূর্ব পাকিস্তানের সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হন, যার পরিণতিতে বাংলাদেশ জন্ম নেয়। জেনারেল জিয়াউল হক (১৯৭৭–১৯৮৮) জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার উৎখাত করে ইসলামিক শাসন পদ্ধতি চালু করেন। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ (১৯৯৯-২০০৮) এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অপসারণ করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে দশ বছর দেশ শাসন করেন।
এমনকি গণতান্ত্রিক শাসনকালেও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (আইএসআই) এবং সেনাপ্রধানরা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। সামরিক বাহিনীকে প্রায়শই ‘রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো প্রায়শই সেনাবাহিনীর অনুমোদন ছাড়া নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম।
পাকিস্তানের ‘ডিপ স্টেট’:
সামরিক বাহিনী বর্তমানে সরাসরি ক্ষমতায় না থাকলেও ‘ডিপ স্টেট’ বা অপ্রকাশ্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২-২৩ সালে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা স্পষ্ট ছিল। নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ, নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থার ব্যবহার এবং গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপের অভিযোগ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে উঠেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পিটিআই-এর উত্থানেও সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও, গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ, সাংবাদিকদের গুম, নির্যাতন এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগও দীর্ঘদিনের। জিও টিভি, ডন এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের ওপর সরাসরি ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং সিন্ধুতে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য সেনাবাহিনী ও আইএসআই দায়ী বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি।
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম:
সামরিক বাহিনীর অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য, যা ‘মিলবাস’ (Military Business) নামে পরিচিত, পাকিস্তানের অর্থনীতির একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ফৌজি ফাউন্ডেশন, আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এবং শাহিন ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ব্যাংকিং, কৃষি, শিক্ষা, খাদ্য এবং রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ করেছে। অনুমান অনুযায়ী, পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব:
বেসামরিক সরকারগুলোর প্রতি সামরিক বাহিনীর অনাস্থা সুস্পষ্ট। প্রতিবার যখনই বেসামরিক সরকার নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে, সেনাবাহিনী সরাসরি বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। ইমরান খান সেনাবাহিনীর সমর্থনে ক্ষমতায় এলেও পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। নওয়াজ শরীফ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু প্রতিবারই সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে ক্ষমতা হারান। প্রখ্যাত সাংবাদিক হামিদ মীরের মতে, “পাকিস্তানের ইতিহাসে বেসামরিক সরকারগুলোর বারবার ব্যর্থতার পেছনে সামরিক বাহিনীর অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ একটি বড় কারণ।”
বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন:
পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মধ্যে বেলুচিস্তান আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড়, যা দেশটির প্রায় ৪৪ শতাংশ ভূখণ্ড জুড়ে রয়েছে। এই প্রদেশে প্রচুর প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ রয়েছে এবং পাকিস্তানের গ্যাসের ৩০ শতাংশ এখান থেকে আসে। তবে, বেলুচ জাতীয়তাবাদীরা অভিযোগ করেন যে, সরকার ও সামরিক বাহিনী তাদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে একতরফাভাবে শোষণ করছে। বর্তমানে বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র প্রদেশ, যেখানে জিডিপির মাত্র ৩.৭ শতাংশ অবদান রাখে এবং শিক্ষার হার মাত্র ২৫ শতাংশ।
কয়েক দশক ধরে বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ), বেলুচ রিপাবলিকান আর্মি এবং বেলুচ লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। এই বিদ্রোহ দমনের জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কঠোর অভিযান চালায়, যার ফলে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ২০২৪ সালে প্রায় ৫০০ বেলুচ নাগরিক গুম বা খুন হয়েছেন বলে জানা গেছে। দীর্ঘদিন ধরে বেলুচ নিখোঁজদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া মানবাধিকার কর্মী মাহরাং বেলুচের গ্রেপ্তার আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বিএলএ ২০২৫ সালের মার্চে জাফর এক্সপ্রেস ট্রেন হাইজ্যাক করে, যাতে ২৬ জন নিহত এবং শতাধিক যাত্রী জিম্মি হয়। কাচ্চি জেলায় একটি রোডসাইড বোমা হামলায় সাতজন সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই হামলার জন্য বিএলএ-কে দায়ী করলেও কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামরিক দমন-পীড়নের পরিবর্তে রাজনৈতিক সংলাপ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে বেলুচিস্তানের সমস্যা সমাধান সম্ভব। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকল্পগুলো স্থানীয় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে, কারণ তারা মনে করে এই উন্নয়ন তাদের উপকারে আসছে না।
সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন ও চোলিস্তান ক্যানাল প্রকল্প:
পাকিস্তান সরকারের ‘গ্রিন পাকিস্তান ইনিশিয়েটিভ’-এর অংশ হিসেবে চোলিস্তানে ছয়টি নতুন ক্যানাল নির্মাণের পরিকল্পনা সিন্ধু প্রদেশে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছে। সিন্ধু প্রদেশের জনগণ ও পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন যে, এই প্রকল্প সিন্ধুর পানি সরবরাহ কমিয়ে ইকোসিস্টেমের ক্ষতি করবে। সিন্ধু প্রদেশের আইনসভা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস করেছে এবং সিন্ধুর বাবারলোই এলাকায় আইনজীবীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও উত্তেজনা:
ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই উত্তেজনাপূর্ণ। কাশ্মীর ইস্যু, জঙ্গিবাদ, পানি চুক্তি এবং সীমান্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ এই বৈরিতাকে আরও জটিল করেছে। সম্প্রতি ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার পর পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। পাকিস্তানও পাল্টা জবাব দেয়। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আলোচনা পর্যন্ত উঠে আসছে। এই দ্বন্দ্ব শুধু দুই দেশের জনগণের নিরাপত্তাই নয়, দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্ব রাজনীতির স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান:
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ শরিফ) ভারতের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী সামরিক প্রতিশোধের অনুমোদন দিয়েছেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো ভারতের সামরিক হামলার নিন্দা করেছেন। পাশাপাশি, জাতীয় ঐক্যের আহ্বান ও কাশ্মীর ইস্যুতে কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে মত দিয়েছেন। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ, জামায়াত-ই-ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর নেতৃবৃন্দ ভারতের অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
সামরিক বাহিনীর আধিপত্য, বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার মতো বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই সমস্যাগুলোর সমাধানে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, মানবাধিকার রক্ষা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অপরিহার্য।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। পাকিস্তানের সমাজবিজ্ঞানী আকবর এস. আহমেদের মতে, “সামরিক বাহিনী নিজেকে কেবল প্রতিরক্ষা বাহিনী হিসেবে নয়, রাষ্ট্র গঠনের একটি প্রধান উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।” এই বাস্তবতা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। একটি কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধ করা জরুরি।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D