সিলেট ১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:৩১ অপরাহ্ণ, মে ২১, ২০২৫
প্রয়াত হিরোহিতো জাপানের সম্রাট থাকাকালে একবার বলেছিলেন, “যতদিন জাপান থাকবে, বাঙালি খাদ্যাভাবে, অর্থকষ্টে মরবে না। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নিঃস্বার্থ বন্ধু।”
এই আবেগপূর্ণ উচ্চারণ কেবল কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়, বরং ইতিহাসের গহীনে প্রোথিত এক অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। আর এই হৃদয়গ্রাহী বক্তব্যের পেছনে যিনি ছিলেন একমাত্র কারণ, তিনি হলেন রাধা বিনোদ পাল—বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় জন্ম নেওয়া এক অসাধারণ আইনবিদ, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমধর্মী ভূমিকা রেখে গেছেন।
১৮৮৬ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ছালিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রাধা বিনোদ পাল। শৈশবে তার বাবা সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, ফলে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রিত থেকে তাকে পড়ালেখা করতে হয়। রাজশাহী থেকে তিনি এন্ট্রান্স ও এফএ পাশ করেন যথাক্রমে ১৯০৩ ও ১৯০৫ সালে। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে অনার্স সম্পন্ন করে শিক্ষকতার মাধ্যমে পেশাজীবন শুরু করেন। কিন্তু গণিতের গণ্ডি পেরিয়ে তার মন আরও বৃহত্তর এক ন্যায়বোধের জগতে প্রবেশ করে—আইনের অধ্যয়নে। আইন পড়ে তিনি কলকাতা ল কলেজের অধ্যাপক হন, এবং পরে ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে, জাপানের শীর্ষ সেনা ও রাজনৈতিক নেতাদের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত করে যে আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল (Tokyo Trial) গঠিত হয়, তাতে ভারতীয় বিচারক হিসেবে রাধা বিনোদ পালকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১১ বিচারকের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি জাপানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে একটি বিপরীতমুখী রায় দেন।
তার প্রশ্ন ছিল—যারা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তারাই কি নৈতিকভাবে পরাজিত পক্ষের বিচার করতে পারে? মিত্রপক্ষের উপনিবেশিক দেশগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজির তুলে ধরে তিনি বলেন, শান্তির নামে সংঘটিত এই বিচার আসলে একতরফা ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। তার ৮০০ পৃষ্ঠার রায়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
এই রায়ের জন্যই মার্কিন বাহিনী জাপানে তার লেখাটি নিষিদ্ধ করে। তবে ১৯৫২ সালে জাপান থেকে মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার পর দিনই সেই রায় সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশিত হয়। রাধা বিনোদ পালের এই নৈতিক সাহসিকতা ও নিরপেক্ষতার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ জাপান সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানায়। ১৯৬৬ সালে সম্রাট হিরোহিতো তাকে প্রদান করেন জাপানের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান—“The Order of the Sacred Treasure, First Class”।
২০০৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ভারত সফরকালে তার পুত্র প্রশান্ত পালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যা এই শ্রদ্ধার বন্ধনের আরেকটি উদাহরণ। টোকিওর ইয়াসুকুনি স্মৃতিসৌধে প্রায় ২৫ লক্ষ যুদ্ধ-নিহতের মাঝে রাধা বিনোদ পালের একটি স্মৃতিফলকও স্থাপিত হয়েছে—যা যুদ্ধকালীন কোনো মৃত্যুর জন্য নয়, বরং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো একজন বিদেশি বিচারকের স্মরণে।
রাধা বিনোদ পালের ভূমিকার ফলেই জাপান আজও বাংলাদেশের মানুষকে সম্মানের চোখে দেখে। তার জন্যই জাপান মনে করে, একসময় যখন সমগ্র বিশ্ব তাদের অপরাধী ঘোষণা করেছিল, তখন একজন বাঙালি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। তাই সম্রাট হিরোহিতোর সেই বিখ্যাত উক্তির পেছনে রয়েছে এক গভীর ঐতিহাসিক বন্ধন—যা আজও দুই দেশের সম্পর্কের আত্মিক ভিত্তি।
রাধা বিনোদ পাল ছিলেন না কেবল একজন বিচারক—তিনি ছিলেন মানবতার এক আলোকবর্তিকা। ইতিহাস যখন বিজয়ীদের কলমে লেখা হচ্ছিল, তিনি তখন পরাজিতের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে প্রশ্ন করেছিলেন। তার সেই নৈতিক দৃঢ়তা আজও আমাদের শেখায়—ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে সাহস লাগে, আর সেই সাহসই একজন মানুষকে অমর করে তোলে।
রাধা বিনোদ পালের মতো মানুষরা ইতিহাসের প্রান্তে নয়, হৃদয়ে বাঁচেন। আর তার জন্যই জাপান আজও বলে, “বাঙালি হবে আমাদের চিরকালের বন্ধু।”
#
পারভেজ কৈরী
উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যকর্মী
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি