সিলেট ২৫শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:৪৪ অপরাহ্ণ, জুন ২২, ২০২৫
ইরানে ইসারায়েলের অতর্কিত হামলা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে। ইসরায়েল-ইরানের এই যুদ্ধে ক্রমশ বিশ্বের ক্ষমতাধর পরাশক্তিগুলোও তৎপর হয়ে উঠছে। তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছে, যুদ্ধ বন্ধে কড়া বার্তা ও হুশিয়ারি দিতে শুরু করেছে। বিশ্ব এখনো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধকলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তার সাথে যুক্ত হলো ইসরায়েল-গাজা-ইরান যুদ্ধের ভয়াবহ ঘটনা।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের ক্ষতিগ্রস্ত সোরোকা হাসপাতাল পরিদর্শনের পর বলেছেন, “আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে ‘আর থাকতে (বেঁচে) দেওয়া যাবে না’।” স্থানীয় গণমাধ্যম ও এএফপির বরাতে এ সংবাদ প্রকাশ করেছে বিবিসি। (১৯ জুন, সমকাল)। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও প্রকারন্তরে ইরানের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। এবং তাদের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের’ আহ্বান করেছেন।
ইরান আক্রমণের এই ঘটনায় ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ মন্তব্য করেছেন, “ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে আমেরিকার হস্তক্ষেপ পরিবেশকে ‘আরেকটি ভয়াবহ উত্তেজনার দিকে নিয়ে যাবে’। তারা ইরানে ইসরায়েলের এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। এছাড়া ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা না দেওয়ার জন্য আমেরিকাকেও সতর্ক করেছেন রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ।’ ১৯ জুন, সমকাল)
সেন্ট পিটার্সবার্গে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরামের এক সংবাদ সম্মেলনে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, ‘ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলাকে আমরা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করি। এটি আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকির এবং বিশ্বকে একটি পারমাণবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’ (১৯ জুন, সমকাল)
চলমান এই সংঘাত নিয়ে টেলিফোনে কথা বলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ফোনালাপে ইসরায়েলের ইরানবিরোধী পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন দুই বিশ্ব নেতা। সংঘাত থামাতে ভ্লাদিমির পুতিন আবারও মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন।
ইসরায়েল ও মার্কিনের হুমকি-আক্রমণের মধ্যেই দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ’ইরানি জনগণকে ভয় না পেয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।’ (বিবিসি)
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল সামরিক সরঞ্জাম ও সেনা মোতায়েন করছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। ট্রাম্প বলেছেন, সময় ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৪০ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজবাহী রণতরি ‘ইউএসএস নিমিটজ’ দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রা করেছে। এর সঙ্গে রয়েছে একাধিক গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, যেগুলো পারস্য ও ওমান উপসাগরে অবস্থানরত মার্কিন যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে যুক্ত হবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এফ-১৬, এফ-১২ ও এফ-৩৫ মডেলের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘাঁটিতে স্থানান্তর করেছে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ইরান পারমানবিক অস্ত্র তৈরীর পথে হাটছে এবং এক্ষেত্রে তারা অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু ইরান দাবী করছে তারা সেই কাজ করছে না, তারা পারমানবিক শক্তিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করতে চায়। ইরানের সাথে এই দ্বন্দ্ব-বিতর্ক নিয়ে কয়েক দফা আলোচনাও হয়েছে, পরবর্তি আলোচনার নির্ধারিত দিনক্ষনও ছিল কিন্তু তার আগেই ইসরায়েলের এই আক্রমণ পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর মানুষ আশা করেছিল মার্কিন শাসকরা বুঝি আর নতুন করে বড় করে যুদ্ধে জড়াবে না কিন্তু তিনি সেই ভাবনায় পেরেক ঠুকে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। বিশ্ববাসী একটি ক্ষুধা-দারিদ্র মুক্ত পৃথিবী চাইলেও দিন যুদ্ধ-সংঘাত-রক্তপাত-প্রাণহানি জনজীবনের সংকট ও অস্থিরতার আরো বাড়িয়ে তুলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরায়েলের এই আক্রমণ কি শুধু ইরানের পারমানবিক শক্তিধর হয়ে ওঠার সম্ভবনার অভিযোগ না অন্য কোন বিষয় আছে? এই প্রসঙ্গে জিও পলিটিক্যাল ইকোনমির এক ব্লগে খ্যাতিমান সাংবাদিক বেন নরটন আটটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, ইসরায়েল-আমেরিকার ইরানের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করছে, তার প্রধান কারণগুলো হচ্ছে; (১) মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখা, (২) উপনিবেশ-বিরোধী “অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স” (প্রতিরোধ জোট) ধ্বংস করা, যাতে ফিলিস্তিনের পূর্ণ উপনিবেশকরণ সম্ভব হয়, (৩) ইরানকে কখনোই পরমাণু ক্ষমতা অর্জন করতে না দেওয়া, (৪) ইরানের স্বাধীন ও বিপ্লবী সরকারকে উৎখাত সেটা না হলে অন্তত দুর্বল করা, (৫) এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশকে—বিশেষ করে উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলোকে—ভয় দেখানো, যেন তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ডলারের থেকে দূরে সরে যাওয়ার সাহস না পায়, (৬) পেট্রোডলার ব্যবস্থা রক্ষা করা, যাতে বিশ্বজুড়ে মার্কিন ডলারের চাহিদা বজায় থাকে, (৭) BRICS ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO)-কে অস্থির করা, গ্লোবাল সাউথ (বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহ) ভেঙে ফেলা এবং বহু-মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করা, (৮) ইরান-রাশিয়া-চীন অংশীদারিত্ব ভেঙে দেওয়া, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো বেইজিংকে বিচ্ছিন্ন করা।
জিও পলিটিক্যাল ইকোনমির বিশ্লেষণ বলছে, তাদের হামলা-আক্রমণের প্রধান কারণ- ইরান সরকারকে উৎখাত না হয় দূর্বল করা। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ ইরানের হামলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, ইরানের ‘শাসকদের উপর হামলার এই সরকারকে দুর্বল করে ফেলা। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই মন্তব্য ইসরায়েলের যুদ্ধনীতিতে একটি স্পষ্ট পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
ইরানকে দূর্বল করাই কি ইসরায়েলের আসল উদ্দেশ্য? এ প্রসঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল মাইকেল ফ্লিন ১৭ জুন স্টিভ ব্যাননের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্য হলো “চীনের ক্ষমতা দুর্বল করা” এবং “মার্কিন বৈশ্বিক আধিপত্য নিশ্চিত করা”।
তিনি বলেন, “এই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইরানি সরকারকে উৎখাত করা। ভবিষ্যতে ইরানে যে নতুন সরকার আসবে, তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক সম্পর্ক থাকলে সেটা আমাদের জন্য লাভজনক হবে—বিশেষ করে চীনের বিপরীতে।” ফ্লিন আরও বলেন, “ইসরায়েলের বিজয় যদি ঘটে, তাহলে সেটা মার্কিন বৈশ্বিক আধিপত্যের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে— সেটা মানসিকভাবে হলেও। আর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।”
ফ্লিন, যিনি ওবামা প্রশাসনে ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (DIA) পরিচালক ছিলেন এবং ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলেন—এই যুদ্ধ কেবল ইরানের বিরুদ্ধে নয়, এটি একটি বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক কৌশল—যার লক্ষ্য চীনের প্রভাব খর্ব করে যুক্তরাষ্ট্রকে একচেটিয়া বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
মাইকেল ফ্লিন এতে একমত পোষণ করে বলেন, “২১ শতকের প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছে চীন। চীন, চীন, চীন—এটাই আপনার সবাইকে বুঝতে হবে।” তিনি বলেন, “যদি আমরা এবং ইসরায়েল ইরানের সরকারকে উৎখাত করতে পারি, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার সমস্ত শক্তি ও মনোযোগ চীনের দিকে স্থানান্তর করতে পারবে।”
এই চরমপন্থী মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ইউরোপীয় উদার মধ্যপন্থী নেতৃত্বেরও কথারও মিল পাওয়া যায়। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, “ইসরায়েল আসলে পশ্চিমা বিশ্বের ‘নোংরা কাজ’টা করে দিচ্ছে।” এই সব মন্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, ইরানের বিরুদ্ধে বর্তমান যুদ্ধ কেবলমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন নয়—এটি বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্নির্ধারণের লড়াই, যার কেন্দ্রে রয়েছে চীনকে মোকাবিলা করে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।
এ প্রসঙ্গে ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ২০২০ সালে প্রকাশিত ’আমেরিকার ক্রসেড’ বইতে বলেন— যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীরা একটি “পবিত্র যুদ্ধ” চালাচ্ছে চীন, আন্তর্জাতিক বামপন্থা এবং ইসলাম—বিশেষত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে। ইসরায়েলকে দিয়ে ইরানের উপর চাপিয়ে দেয়া তাদের এই যুদ্ধ- সেই অভিসন্ধিরই বহিঃপ্রকাশ।
#
ড. মঞ্জুরে খোদা টরিক
লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D