সিলেট ১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৪:১০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৫, ২০২৫
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির ছাত্র ছিলাম। শিক্ষাজীবনের শেষ বর্ষে এসে মনে হলো, এরপর কি করব? আমার অধিকাংশ বন্ধুদের জন্য এটা জটিল কোনো প্রশ্ন না। বিসিএস ক্যাডার হতে চান অনেকে, কেউ কেউ ব্যাংকার, কর্পোরেট পেশাজীবি। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, এনজিওর কথাও ভেবেছেন দুয়েকজন। কিন্তু আমি যেহেতু জীবনটা লিখে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার চিন্তা তাই পেশাভিত্তিক ক্যারিয়ার বেছে না নেওয়া। এমন কিছু করা যাতে লেখালেখিটা ঠিকঠাক করতে পারি।
সিদ্ধান্ত নিলাম সাংবাদিক হবো। দুজন প্রিয় লেখক হেমিংওয়ে-মার্কেস সাংবাদিক ছিলেন। দেশে অনেক লেখক ছিলেন, কিন্তু আমি স্বপ্নে বাস করি তখন।
২০১২ সালে সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু হলো। তিন চার বছরের মধ্যে স্বপ্নটা কেটে গেল। তখনো নিজের অভিজ্ঞতা সামান্যই; কিন্তু সম্পর্কের সূত্রে বিভিন্ন হাউজের সিনিয়র সাংবাদিকদের জীবন, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, তোষামোদি দেখে বুঝতে পারলাম, শুধু লেখক না, কোনো মানুষের জন্যই সাংবাদিকতা উপযুক্ত পেশা না। সরি টু সে, এদেশে এটা কোনো মানুষেরই পেশা হতে পারে না। তবে নিজে তখনো ভালোই ছিলাম। ওই বয়সেই পাক্ষিক অনন্যার নির্বাহী সম্পাদক। একইসঙ্গে একটা প্রতিষ্ঠিত অনলাইনের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি, আরেকটা অনলাইনের আন্তর্জাতিক পেইজ দেখি। কাজটা উপভোগ করি, শ্রম দিই, আয়ও ভালো। কিন্তু দেশে সাংবাদিকতার নেচার ও ভবিষ্যতের আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে পেয়ে সাংবাদিকতা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। যা আয় করি তার তিন ভাগের এক ভাগ স্যালারিতে বাংলা একাডেমিতে চলে আসি। বাংলা একাডেমিতে আসার পর বাড়ি থেকে টাকা নিই, না হলে চলে না। কিন্তু সাংবাদিকতা পেশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বস্তি আসে। মাঝে একটা ভালো এনজিওতে যাবো বলে ঠিক করেছিলাম, একবার মাটির চাপে কানাডা চলে যাওয়ার জন্যও মৃদু উদ্যোগী হই। এসব বিক্ষিপ্ত চিন্তার কারণ একটাই, লেখক হিসেবে কোনো পেশাকেই উপযুক্ত মনে হচ্ছিল না। এই দেশে লেখক শিল্পীদের জন্য উপযুক্ত কোনো পেশা তৈরিই হয়নি। সরকারি চাকরি? মোটেও না।
সরকারি চাকরিতে প্রথমত রাজধানীতে টিকে থাকার মতো মাইনে নেই। সৎভাবে চাকরি করে সরকারি চাকরিতে আমি যে কমফোর্টে থাকতে অভ্যস্ত, সেটা সম্ভব না। কিন্তু সেটাও কারণ না। সরকারি চাকরি করে মুক্তচিন্তার ফ্যাকাল্টিই মরে যায়। মুক্তচিন্তা প্রকাশ তো দূরে থাক, ভাবার ক্ষমতাটুকুও নষ্ট করে দেয় রাষ্ট্র। জীবনের শেষ কলামে (সুইসাইড নোট?) সাংবাদিক বিভূরঞ্জন সরকার যে লিখলেন “সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়”, এটাই মূল কথা।
সাংবাদিকতা সত্য উচ্চারণ করার পেশা। কিন্তু বাস্তবে সাংঘাতিকভাবে এটা সত্যবিরোধী পেশা। অন্যদিকে সরকারি চাকরি মনন ও মুক্তমত-চর্চা-বিরোধী পেশা।
আমি মাঝে মধ্যে মাটিকে বলি, এ জীবনটা যেহেতু লিখে কাটাবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিয়ে করাটা ভুল হয়েছে। না, সংসারের চাপ না, সংসারের সব কিছু মাটিই করে। কিন্তু সংসারের কথা ভেবে একটা চাকরি বাঁচিয়ে রাখতে হবে, এই চাপটা সহ্য হয় না।
লিখতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে পলিটিক্যাল কারেক্টনেস দেখানো তো লেখক-শিল্পী-সাংবাদিকের কাজ না। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এই অভাগা দেশে জন্ম নিয়েছি। নিয়েছি তো নিয়েছি, লেখক/সাংবাদিক হতে এসেছি। সমস্যাটা এখানেই। না, ঠিক এখানেও না। সমস্যাটা হলো আপোস না করার প্রবণতা, তোষামোদ না করার বদ অভ্যাসটা। না হলে অনেক সাংবাদিক তো গাড়িবাড়ি করেছেন। অনেক লেখক তো দলীয় কর্মী হয়ে বেশ থাকেন।
বিভূরঞ্জন সরকারের কথা বলতে গিয়ে আজ আমি নিজের কথা বলছি, কারণ এই পরিণতি বুক পকেটে নিয়ে আমার মতো হাজার হাজার মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে এই শহরে। বিভূরঞ্জন সরকার মেইলটা করেছেন বলে জানতে পারছি, অন্যদেরটা জানা যাচ্ছে না।
এদেশে গত পঞ্চাশ বছরে একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়নি। মিডিয়ার মতো বড়ো কর্মক্ষেত্র চলে গেছে মাফিয়াদের হাতে। রাতারাতি পুরো মিডিয়ার লোক ছাঁটাই করা যায়, দখল নিয়ে নেওয়া যায়, পুরো মিডিয়াকে দলীয় কর্মী বানিয়ে ফেলা যায়। এসবের নেপথ্যে থাকে কারা?? সব সময় তো ভিক্টিম হয় কর্মীরা, মালিক না।
মালিকরা হলো ট্রুথ ফ্যাক্টরি, তারা ক্ষমতাসীন দলের জন্য সত্য উৎপাদন করে। এই ফ্যাক্টরির কখনো কিছু হবে না। বিভূরঞ্জনরা চলে যাবেন। নতুন বিভূরঞ্জন আসবেন। ফ্যাক্টরির কিচ্ছু যায় আসে না। আজ যারা বিভূরঞ্জনের পরিণতিতে খুশি হচ্ছেন বা ইনিয়ে বিনিয়ে জাস্টিফাই করছেন আপনাদের কারো কারো জন্যেও কিন্তু একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। দুদিন আগে আর পরে। বিভূরঞ্জন যদি এক দলের হয়ে কথা বলে থাকেন, আপনিও করছেন বিপরীত দলের জন্য। কাজটা সেই একই, দল আলাদা। পড়ার গর্তটা কিন্তু একটাই।
মিডিয়ার চরিত্র নিয়ে আমার আগের একটি লেখা:
আমরা প্রত্যাশা করি, দেশের সাংবাদিকরা সৎ ও নির্ভিক হবেন। অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে খবর পরিবেশন করবেন। সাংবাদিকরা রাজনৈতিক কর্মী হবেন না। সমাজের সবাই পচে গেলেও, সাংবাদিকরা থাকবেন তরতাজা, ফরমালিনমুক্ত। এই তো আমাদের প্রত্যাশা?
কিন্তু মিডিয়ার মালিকদের চরিত্র নিয়ে আমাদের কোনো প্রত্যাশা ও মাথাব্যথা থাকে না। তিনি চোর ডাকাত হলে কোনো অসুবিধা নাই। আমরা ভেবে দেখি না, মিডিয়ার মালিক কি সৎ সাংবাদিক চান? তিনি কি চান তার দুর্নীতি লুটপাটের খবরও প্রচারিত হোক নিজের কিংবা অন্য মিডিয়ায়? সেই জন্য কি তিনি মিডিয়া ব্যবসা লাভজনক খাত না জেনেও মিডিয়া খুলে বসে থাকেন?
আগে ভূস্বামীরা নিজেদের লাঠিয়াল বাহিনী রাখত। এখন লুটপাটকারীরা লাঠিয়াল বাহিনীর পরিবর্তে মিডিয়া পোষে। এই তো। ফলে আপনি সাংবাদিককে যতই গালি দেন, লাভ নাই। আপনার গালিতে কোনো সাংবাদিক পেশাগত সততা দেখাতে গেলে পরদিনই চাকরি হারাবে। সরকারও কিন্তু সত্য প্রকাশ করার জন্য সরকারি মিডিয়া রাখেনি। ফলে মিথ্যা কাচামাল দিয়ে সত্য উৎপাদনের সবচেয়ে বড়ো ফাক্টরি হলো মিডিয়া। প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের চরিত্রও কিন্তু তাই। মিডিয়ার কাজ দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্র প্রধানরা যে ভুল কথা বলবে সেটা সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার পেছনে কিছু ফ্যাক্টস তৈরি করা, সরকার যে ভুল সিদ্ধান্ত নেবে দলীয় বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে তার সম্মতি উৎপাদন করা।
সত্য কিন্তু ফাক্টস না, সত্য হলো বিশ্বাস। আপনি যে ধর্ম মানেন সেটা ফ্যাক্টস হিসাব করে মানেন না। এটা আপনার বিশ্বাস। ক্ষমতার পক্ষে আপনার বিশ্বাস অর্জন করানো মিডিয়ার কাজ। এই কারণে সরকার বদল হলে মিডিয়ার একসেট কর্মী, মিডিয়ার বক্তা ও বুদ্ধিজীবী পরিবর্তন হয়, স্ট্রাকচার বা নীতি না।
যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, কালো টাকাওয়ালা লোকজন মিডিয়ার মালিক যখন তখন সাংবাদিকতা আদর্শিক কোনো পেশা না, আর পাঁচটা পেশার মতো পেশা। ভালো সাংবাদিক মানে পেশাদার (পেশার প্রতি ওনেস্ট) সাংবাদিক, এর সঙ্গে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার কোনো সম্পর্ক নেই।
চাটুকারিতার জন্য সাংবাদিকদের আপনি গালি দিতে পারেন, আরেকদল এসে তার চাকরি খেয়ে দিতে পারে। কিন্তু কেউ মিডিয়ার মালিকদের খেয়ে দিতে পারে না। তারাই ফাক্টরি যখন, মেশিনম্যান বদলে কাজ হবে না, আনটিল ইউ চেঞ্জ দ্য মেশিন।
এখন এই মেশিন কে বদলাবে?
রাষ্ট্র?
কিন্তু বড়ো মেশিন যদি রাষ্ট্র (সরকার বা রাষ্ট্রের লোকজন) নিজেই হয়?
না, তাতে আমার মতো চড়ুই তেলাপোকার জন্য কিছুই করার নেই।
তবে এরমধ্যেও স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার একটা পথই আমার জানা ছিল, সেটা হলো কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি না করা। যে সরকারই ক্ষমতায় আসতো নিয়ম করে জেলে জেতাম। কিংবা লাশ পড়ে থাকত বুড়িগঙ্গায়। জীবন মানুষের পশুপাখির মতোই। মানুষ হয়েছি বলে এই বালের জীবনের প্রতি মায়া দেখানোর কিছু নেই। একদিন বাঁচলেও বলতে পারতাম সত্যের সঙ্গে সত্যের জন্য বেঁচেছি। কিন্তু ওই যে সংসার, সন্তান হয়ে গেছে। চাকরিটা তাই বাঁচাতে হবে। তাই এ পর্যন্ত লিখে লেখাটা আবার রিভাইস দিতে হবে। পলিটিক্যাল কারেক্টনেস রক্ষা করতে হবে। নতুন কিছু না, কর্মজীবী হওয়ার পর থেকে এই তো করে আসছি। ?
বিভূরঞ্জন সরকার, আপনার চলে যাওয়া প্রতিদিন হাজার হাজার ঘটনার মতোই একটা ঘটনামাত্র, তেমন কিছু না। আফসোস।#
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি