আগামী ১ সেপ্টেম্বর সূচনা অনুষ্ঠান – ‘বাংলাদেশ রিফর্ম ওয়াচ’

প্রকাশিত: ২:০৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৮, ২০২৫

আগামী ১ সেপ্টেম্বর সূচনা অনুষ্ঠান – ‘বাংলাদেশ রিফর্ম ওয়াচ’

Manual2 Ad Code

সৈয়দ নোমান আজমী, বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ২৮ আগস্ট ২০২৫ : নাগরিক প্ল্যাটফর্ম-এর পক্ষ থেকে ‘Bangladesh Reform Watch’ (BRW) শীর্ষক একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

Manual7 Ad Code

১ সেপ্টেম্বর ‘২৫, সকাল ১০টায় এ সূচনা অনুষ্ঠানটি শুরু হবে। সরাসরি দেখুন আপনিও।

সিটিজেনস প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজি’স বাংলাদেশ (নাগরিক প্ল্যাটফর্ম) মনে করে, “নাগরিক কণ্ঠঃস্বর সোচ্চার না হলে কোন সংস্কার উদ্যোগই কার্যকর ও টেকসই করা যায় না।”

রিফর্ম ওয়াচ দেশের সংস্কার প্রক্রিয়ায় ন্যায্যতা ও বৈষম্যবিরোধী চেতনা স্থাপন করতে চায়। দেশের রূপান্তরকালীন এই সময়ে রিফর্ম ওয়াচ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কার এজেন্ডা প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করবে। উপরন্তু, প্রস্তাবিত আর্থ-সামাজিক উদ্যোগসমূহের আর্থিক অভিঘাত ও অর্থায়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করারও প্রয়োজন রয়েছে।

সিটিজেনস প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজি’স বাংলাদেশ (নাগরিক প্ল্যাটফর্ম)-এর প্রত্যাশা, এ সমস্ত সংস্কার প্রস্তাবনা আগামী দিনে রাজনৈতিক দলসমূহের নির্বাচনী ইশতেহারে যথাযথ স্থান পাবে।

Manual5 Ad Code

আরো আশা যে নির্বাচন-পরবর্তী সরকার এসব সংস্কার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করবে। তবে সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ অব্যাহত থাকবে কিনা তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।

এ ধরনের সংস্কারের জন্য উদ্যোগ ও আয়োজনকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য, ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ফিনান্সিয়াল পোস্ট’ ও সাপ্তাহিক নতুন কথার প্রতিনিধি, আরপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, “দেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমুল সংস্কার প্রাসঙ্গিক ও জরুরী। এ সংস্কার প্রক্রিয়ায় ন্যায্যতা ও বৈষম্যবিরোধী চেতনা প্রতিস্থাপন করতে হলে, রূপান্তরকালীন এই সময়ে শোষণ-লুণ্ঠনমূলক ব্যবস্থার কারণে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈপ্লবিক বা আমূল সংস্কার এজেন্ডা প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাযথভাবে নিজস্ব ফর্মুলায় কাজ করতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা ‘৭২-এর সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির আলোকে উপরন্তু, অর্থনীতির চালিকা শক্তি ও ইতিহাসের নির্মাতা দেশের জনগণ ও ও পরিবর্তন অভিমুখী বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসমূহকে সম্পৃক্ত করে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে প্রস্তাবিত আর্থ-সামাজিক উদ্যোগসমূহের আর্থিক অভিঘাত ও অর্থায়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করারও প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ৫৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। বাঙালি জাতি ও জনগণের বড় ও শ্রেষ্ঠ অর্জন এই স্বাধীনতা। বাংলাদেশের ইতিহাস হলো স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস। এ দেশের মানুষ লড়াই করেছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শ্রেণি শোষণ ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে। দেশীয় সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচার ও লুটেরা শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। জনগণের সংগ্রামের মুখেই একদিন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ চলে গেলেও আমাদের উপর চেপে বসল পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক ধরণের শাসন ও শোষণ।
বাংলাদেশের মানুষ প্রথম থেকেই জাতিগত শাসন-শোষণ-বঞ্চণা-অনুন্নয়ন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছে- যার চূড়ান্ত রূপ লাভ করল ’৭১-এর সুমহান সশস্ত্র স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ভিতর দিয়ে। অল্পসংখ্যক ঘাতক রাজাকার-আল বদর-আল শামস-শান্তি কমিটির সদস্য ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষ ধর্ম-বর্ণ-বিশ্বাস-নারী-পুরুষ-আবাল বৃদ্ধ বণিতা-দলমত নির্বিশেষে স্বাধীনতার স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ভাসানী), অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (মোজাফফর), কমরেড মণি সিং-এর নেতৃত্বাধীন কমিউনিষ্ট পার্টি, কাজী জাফর-রাশেদ খান মেনন-হায়দার আকবর খান রনো’র নেতৃত্বাধীন কমিউনিষ্ট পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি (বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি), ছাত্র ইউনিয়ন [মেনন]-(বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী), ছাত্র ইউনিয়ন [মতিয়া]-(বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন), কমিউনিষ্ট পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি (দেবেন শিকদারের নেতৃত্বে), শ্রমিক-কৃষক কর্মীসংঘ, কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার), পূর্ব বাংলার কৃষক সমিতি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন (পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন), পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নসহ বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও গণ-সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটিসহ অন্যান্য প্রগতিশীল নানা গ্রুপ-দলের সক্রিয় অংশগ্রহণে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ফলেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পরাজয় ঘটলো এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয় ঘটলো। জাতিগত নিপীড়ন ও শোষণের শিকার জনগণের বিজয় অর্জিত হল। কিন্তু যুগযুগব্যাপী এ দেশের কৃষক-শ্রমিকসহ অন্যান্য মেহনতী ও সাধারণ জনগণ শ্রেণি শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির যে আকাঙ্খাকে বুকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে এসেছে, সে আকাঙ্খা পূর্ণ হয় নি। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই চলছে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে ‘৭২-এর সংবিধান প্রণীত হলেও রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনা হয় নি। সাম্রাজ্যবাদের ফিন্যান্স পুঁজি জনগণকে নির্মমভাবে শোষণ-লণ্ঠন, ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম করে নিজেদের সম্পদ ও টাকার স্ফীতি ঘটাতেই নিয়োজিত। গ্রামীণ-টেলিনর ও অন্যান্য মোবাইল ফোন কোম্পানিসহ বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীর কমিশন এজেন্সী, কালো বাজারী, তেল-গ্যাস-কয়লা-খনিজ-প্রাকৃতিক সম্পদকে দেশের প্রয়োজনে কাজে লাগানোর প্রশ্নে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে প্রাধান্য না দিয়ে চুক্তি সম্পাদন করে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানির হাতে ন্যস্ত করা, চোরাচালানী, বড় বড় কণ্ট্রাক্টরী, জাতীয় শিল্পের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন আমদানি-রপ্তানি, সাপ্লাই, মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীসমূহের সহযোগী ও ছোট পার্টনার হিসেবে কাজ করা, বৈষম্যমূলক বিদেশী বিনিয়োগ নীতিমালা, এটাই হচ্ছে বিদেশীদের উন্নয়ন সহায়তার চরিত্র। এই সকল সহায়তা খবরদারিমূলক, আমাদের দেশের জনগণের প্রতি এদের দরদ-সহমর্মিতা বলতে কিছু নেই। এমনকি স্বাধীন ও জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি হিসেবে গড়ে তোলাসহ স্বয়ম্ভর শিল্পায়নের দিকে ন্যূনতম আগ্রহও দেখা যায় না। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেও মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কা শিল্পায়নের একটা উদাহরণ যেভাবে সৃষ্টি করতে পেরেছে; আমাদের দেশেও সেই ধরণের অঙ্গীকার, উদাহরণ ও মডেল সৃষ্টি করা সম্ভব। বাংলাদেশ একটা বড় লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও আমাদের দেশের বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদ, বহুজাতিক কোম্পানী, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত ও তাদের উচ্ছিষ্ট ভোগকারী শ্রেণি হিসেবে এরা কাজ করছে; বিশেষ করে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে তাদের একটা ঘনিষ্ঠ স্বার্থের সম্পর্ক রয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-লুণ্ঠনমূলক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির কারণে দেশের অর্জন, অগ্রগতি, উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ভূমি সংস্কারসহ কৃষির গণতান্ত্রিক সংস্কার, শিল্পায়ন ও সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়েছে পদে পদে। প্রশাসনে, অর্থনীতিতে ও সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির কারনে বিরাজ করছে অস্থিরতা, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, বিশৃঙ্খলা, অনুন্নয়ন ও শোষণ-লুণ্ঠন। জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও এ কারণে গড়ে উঠতে পারেনি। ক্ষমতাধর কিছু ব্যক্তিবগের্র চরম দুর্নীতির মাধ্যমে কালো পুঁজি সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে- যা বিলাসিতা, বিদেশে পাচার ও অনুৎপাদনমূলক ব্যবসার কাজে ব্যয়িত হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদ প্রধানত ঋণ ও তথাকথিত সাহায্য এবং অসম বাণিজ্য ও জাতীয়স্বার্থবিরোধী অসম চুক্তির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লুণ্ঠন ও আমাদের খনিজ সম্পদ সম্পূর্ণ লুণ্ঠন করে নিয়েছে এবং এখনো নিতে চায়। এটাই হচ্ছে আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদের নয়া ঔপনিবেশিক শোষণের প্রধান রূপ। এ ছাড়া আছে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীসমূহের প্রত্যক্ষ পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে ২০ বছরের ট্যাক্স হলিডে সুবিধাসহ বিপুল অংকের মুনাফা ও সম্পদ লুণ্ঠনের ঘটনা। চা বাগানগুলোর একটা বড় অংশ বৃটিশ পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন রয়েছে। আমাদের অনেকগুলো গ্যাসক্ষেত্র বিদেশী কোম্পানীকে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে গ্যাসক্ষেত্রে বিদেশী কোম্পানীর স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকী দিতে হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই আমাদের দেশের জনগণের প্রধান শোষক ও দুশমন।
আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে প্রতি বছর যে উদ্বৃত্তমূল্য সৃষ্টি করছে, তার বড় অংশ আত্মসাৎ করছে সাম্রাজ্যবাদ। এই উদ্বৃত্তমূল্য দেশের মধ্যে পুঁজি হিসেবে সঞ্চিত হচ্ছে না, দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী মুনাফার উচ্ছিষ্ট ভোগ করে, জনগণকে বেপরোয়া শোষণ-লুণ্ঠন করে দেশীয় আমলা মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া তার ধনভান্ডার বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু তাও কোন উৎপাদনমূলক জাতীয় বিকাশের কাজে ব্যবহৃত হয় নি। তার একটা বিশাল অংশ বিদেশে পাচার হয়ে যায়। আরেকটা অংশ বিদেশ থেকে গাড়ীসহ আমদানিকৃত বিলাসদ্রব্যের জন্য অনুৎপাদনমূলক ব্যবসার কাজে খাটাচ্ছে। যে গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে এত হাকডাক, সেই শিল্পে তৈরীকৃত পোশাক বিদেশে রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় হয়, এই আয়ের একটা অংশ বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি বাবদ খরচ হয়ে যায়। অথচ গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল তৈরির কারখানা গড়ে তোলা আমাদের দেশেও সম্ভব।
একদিকে যখন আমাদের দেশে কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধা, শোষণ-দারিদ্র্য, অনাহারজনিত মৃত্যু ও বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে কোন মতে বেঁচে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত, অপরদিকে তারই পাশাপাশি দেখা যায়, মুষ্টিমেয় কিছু লোকের চোখ ঝলসে দেওয়ার মত বিলাসিতা ও জাতীয় সম্পদের জঘন্য অপচয়। আমাদের দেশের জাতীয় বাজেটের শতকরা ৩০% থেকে ৪০% সম্পূর্ণ অপচয়/অবচয় হয় দুর্নীতি-অনিয়ম-আত্মসাৎ-স্বজনপ্রীতি-অপব্যবহার-অবহেলাসহ নানা কারণে। অন্যদিকে গোটা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সাম্রাজ্যবাদী ঋণের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই ঋণ করা অর্থ কোন উৎপাদনমূলক কাজে ব্যবহৃত হয় না। এক গবেষণা ও পরিসংখ্যানভিত্তিক নিবন্ধে দেখা যায় যে, এ পর্যন্ত আমাদের দেশে আসা ফরেইন এইডের শতকরা ৭৫ ভাগ বিভিন্ন শর্তাবলীর আড়ালে বিদেশীরাই লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে। ফলে জনগণের কাঁধে ক্রমাগত ঋণ ও সুদের বোঝা বেড়েই চলেছে। প্রতি বছর বিদেশী ঋণের সুদ বাবদ গড়ে প্রায় ২ হাজার ৭শ’ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে (এ চিত্র প্রতি বছর কিছুটা উঠানামা করে)।
নয়া উপনিবেশবাদ শুধু যে শোষণ-লুণ্ঠন করছে এটাই একমাত্র কথা নয়। সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন কায়দায় আমাদের অর্থনীতিকে তাদের উপর নির্ভরশীল করে রাখছে। এবং আমাদের দেশের স্বয়ম্ভর শিল্প বিকাশসহ স্বাধীনভাবে সার্বিক জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে দারুণভাবে বাধা প্রদান করছে। এইভাবে একদিকে আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বাধীনতা হারাচ্ছি, অপরদিকে ভূমি সংস্কারসহ শিল্প বিকাশের কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উপযোগিতা ও বাজার থাকা সত্ত্বেও আদমজী জুট মিল বন্ধ করাসহ এই খাতকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বস্তুতঃ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সংস্থা। কার্যতঃ তারাই আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও নীতি নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের শর্তাদির কারণে আমাদের দেশের অর্থনীতি জাতীয় ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারছে না। সাম্রাজ্যবাদ ও পশ্চিমা বহুজাতিক কর্পোরেশন বা কোম্পানীর স্বার্থরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক আমাদের দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের তথাকথিত ফর্মুলা দিয়েছে। সেই ফর্মুলার নাম ‘দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র’ সংক্ষেপে ‘পিআরএসপি’। এই কৌশলপত্র দিয়ে আমাদের দেশে জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন তো হবেই না, বরং সাম্রাজ্যবাদ ও বহুজাতিক কোম্পানীর শোষণ-লুণ্ঠন অব্যাহত রাখার নিমিত্ত্বে দারিদ্র্যাবস্থাকে দীর্ঘায়িত করাসহ সহনীয় মাত্রা বা পর্যায়ে নিয়ে আসা মাত্র। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে বিশ্বব্যাংক দায়মুক্তি নিয়েছিল।
আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন একদিকে শিল্প বিকাশ ও অপরদিকে ভূমি সংস্কার ও কৃষির গণতান্ত্রিক সংস্কার। এ দু’টো ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। আজকের দিনে অবশ্য সাম্রাজ্যবাদ বিপ্লব ঠেকানোর জন্য কৃষিতে বুর্জোয়া ঢং-এ কিছু সংস্কার করতে চায়। কারণ তারা আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে প্রধানতঃ যেটা চায়, তা হল দেশটি যেন বিশ্ব পুঁজিবাদী সম্পর্কের আওতার মধ্যে থাকে। এতেই তাদের লাভ। সেই কারণে আমাদের দেশেও একাধিকবার ভূমি সংস্কার ইত্যাদির কথা বলা হলেও, তাদের তৈরি করা ‘পিআরএসপি’তে ভূমি সংস্কারের বিষয়টি রাখা হয় নি। এ ছাড়া ‘পিআরএসপি’ আর ড. ইউনূস উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচী দিয়ে শোষণ-লুণ্ঠনমূলক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশে জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন হবে না, আদৌ হতে পারে না। আমাদের দেশে পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যেই কোনো ধরণের গণতান্ত্রিক সংস্কার বা কোনো প্রকার বুর্জোয়া সংস্কারও সম্ভব হয় নি। বড় বড় দলগুলোর কেউই স্বাধীন জাতীয়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া সংস্কার করার ন্যূনতম কর্মসূচী এ পর্যন্ত ঘোষণা করে নি। এমনকি উৎপাদন ব্যবস্থায় যে সামন্ত অবশেষ ও প্রাক-পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক রয়েছে, তাদের জিইয়ে রেখে উৎপাদন শক্তিকে আটকে রাখবে বলে মনে হয়। সাম্রাজ্যবাদি সংকীর্ণ কায়েমীস্বার্থ ও শোষণের রাজত্বকে বজায় রাখার স্বার্থে ঔপনিবেশিক আমলের প্রশাসন ব্যবস্থাকে মূলতঃ টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
আমাদের দেশের গোটা অর্থনীতি বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির অংশবিশেষ। বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতি আজ এক সাধারণ সংকটের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। এর ফলে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অগ্রগতি হলেও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার কারণে জনজীবনে লাগাতার সংকট লেগেই রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল থেকে এই অর্থনৈতিক সংকটের যে কোন সমাধান নেই এবং বুর্জোয়া সংস্কারের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবন-যাপনে মৌলিক সমস্যার যে কোন রকম সমাধান সম্ভব নয়, তাও জনগণকে স্পষ্ট করে বুঝতে হবে।
লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের মৌলিক উন্নতি ঘটে নি। রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় রকমের পরিবর্তন সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতী সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো মৌল পরিবর্তন ঘটে নি। নিষ্ঠুর শোষণ-লুণ্ঠনে সাধারণ খেটে খাওয়া গরীব মানুষের জীবনে আজ নাভিঃশ্বাস উঠেছে। ভূমি সংস্কার ও শিল্প বিকাশ না হওয়ায় বেকারের সংখ্যাও ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিল্প বিকাশের উদ্যোগের অভাব, ভূমি সংস্কার ও কৃষিতে প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টার অনুপস্থিতি এবং সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদী সীমাহীন বেপরোয়া শোষণ-লুণ্ঠনের কারণে প্রকৃত অর্থে সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২৫৯১ মার্কিন ডলার (টাকার অংকে ২,১৯৭৪৪)। মোট জাতীয় আয় ৩৬ লক্ষ ৯৬ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮২ লক্ষ বা ১৬.৮২ মিলিয়ন। দারিদ্র্যের হার ২০.৫% এবং চরম দারিদ্র্যের হার ১০.৫%। স্বাক্ষরতার হার ৭৫.২% (পুরুষ ৭৭.৪% এবং মহিলা ৭২.৯%)। মোট শ্রমশক্তি ৬.৩৫ কোটি; পুরুষ ৪.৩৫ কোটি ও নারী ২ কোটি। খাত অনুযায়ী শ্রমশক্তিতে নিয়োজিত কৃষি ৪০.৬%, শিল্প ২০.৪%, সেবা ৩৯%। চলতি মূল্যে মোট জিডিপির পরিমাণ ৩৫,১১,০৬৫ কোটি টাকা এবং স্থিরমূল্যে ১২,০৭,২৬৪ কোটি টাকা। স্থিরমূল্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫.৪৭%। জাতীয় সঞ্চয়পত্র মোট জিডিপির ৩০.৩৯% এবং মোট বিনিয়োগ জিডিপির ২৯.৯২%। (৩০ জুন ২০২১) পর্যন্ত মোট বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৪৬,৩৯১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ ২৪,৭৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। রিজার্ভ মুদ্রা ৩,২৭,৮৫৩ কোটি টাকা। ২০২০-২১ এর সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট রাজস্ব ৩,৫১,৫৩২ কোটি টাকা। মোট রাজস্ব জিডিপির ১১.৩৯%। মোট ব্যয় জিডিপির ১৭.৪৬%। বৈদেশিক অনুদান সহ বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫.৯%। বৈদেশিক অনুদান ব্যতীত বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬.১৫%।
২০২০-২১ অর্থবছরে চূড়ান্ত মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলার (চূড়ান্ত)। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হয়েছে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
প্রতি বছর মোট দেশজ উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক নির্দেশক প্রক্কালন ও প্রকাশ করে বিবিএস। এ বছরের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে শতকরা ৬ দশমিক ৯৪ ভাগ, যা সাময়িক হিসাবে ছিল ৫ দশমিক ৪৩ ভাগ। ২০২০-২১ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা বা ২৫৯১ মার্কিন ডলার।
সার্বিক বিবেচনায় কৃষি খাতের ২০২০-২১ অর্থবছরে চূড়ান্ত হিসাবে শতকরা ৩ দশমিক ১৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা সাময়িক হিসাবে ছিল ২ দশমিক ৩৭ ভাগ। চূড়ান্ত হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে শস্য উপখাতে শতকরা ২ দশমিক ২৯ ভাগ, পশুপালন উপখাতে শতকরা ২ দশমিক ৯৪ ভাগ, বন উপখাতে শতকরা ৪ দশমিক ৯৪ ভাগ এবং মৎস্য খাতে শতকরা ৪ দশমিক ১১ ভাগ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে।
শিল্প খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। বছর শেষে বিদ্যুৎ খাতে ১১ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং নির্মাণ খাতে ৮ দশমিক ০৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। সার্বিকভাবে চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী এ খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ১০ দশমিক ২৯ ভাগ যা সাময়িক হিসাবে ছিল ৫ দশমিক ৯৯ ভাগ।
২০২০-২১ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা খাতে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যানবাহন খাতে ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ, ব্যাংক ও বীমা খাতে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ , শিক্ষা খাতে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ ও স্বাস্থ্য খাতে ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। সার্বিকভাবে চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী সেবা খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ, যা সাময়িক হিসাবে ছিল ৫ দশমিক ৮৬ ভাগ।
১৯৭০ সালে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল শুধু ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে তা দাঁড়ায় ২৭৫ মিলিয়ন ডলার। ৪৯ বছরে যা বৃদ্ধি প্রায় ৩০ গুণ। ১৯৭০-এ মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার, ২০১৮-২০১৯-এ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৯০৯ ডলার এবং ২০২০-এ তা ২০৬৪-এ উন্নীত হয়। তাহলে ১৯৭২-১৯৭৩ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ গুণ।
১৯৭২-১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি, ২০১৮-২০১৯-এ ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি, ২০১৯-২০২০-এ ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি এবং ২০২০-২০২১ সালের বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ১৯৭২-১৯৭৩ সালের তুলনায় বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৭২২ গুণ। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে উন্নয়ন বাজেটের আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২০১৮-২০১৯ সালে হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি, যা ৩৪৫ গুণ বেশি। এসব কিছুর প্রতিফলন দেখা যায় বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণ সড়কের ঘনত্ব, শিল্পায়ন, গৃহায়ণ, নগরায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, দারিদ্র্য বিমোচন প্রভৃতি ক্ষেত্রে। সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমাদের ৫২ বছরের অগ্রগতি স্বস্তিদায়ক বলা হয়। যেমন সার্বিক সাধারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, গড় আয়ু, ইপিআই, নারীর ক্ষমতায়ন, জন্ম ও মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদিতে অগ্রগতির উল্লেখ করা যেতে পারে।
দেশের শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি মানুষের জমি নাই বা থাকলেও নেহায়েত সামান্য। দেশের শতকরা ২৮ ভাগ বেকার। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা শতকরা ৩৮ ভাগেরও বেশি। দেশের জনসমষ্টির ৩৫ ভাগ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। দেশের জনসমষ্টির ২০ ভাগ মানুষ অন্ততঃ ছয় মাস অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে কোনমতে বাঁচার চেষ্টা করে। প্রতি বৎসর না খেয়ে যে কত হাজার হাজার মানুষ মারা যায় তার খবর দৈনিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পায় না, বেতার-বিটিভিসহ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া চ্যানেলগুলোতে প্রচার করা হয় না, সরকারী পরিসংখ্যান-তথ্য-গবেষণাতেও স্থান পায় না। এদের নিয়ে লেখালেখিও অনেকে পছন্দ করেন না। এরা কারা? এরা হচ্ছেন শহর ও শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক, গ্রামাঞ্চলের খেতমজুর-দিনমজুর, বর্গাচাষী, গরীব কৃষক, মাঝারি কৃষক এবং শহর ও গ্রামের অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ, সর্বহারা-অর্ধ সর্বহারা, বেকার-অর্ধ বেকার। এই গরীব ও শোষিতের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণি হচ্ছে সবচেয়ে অগ্রগামী, বিপ্লবী ও সংগঠিত। রাজনৈতিক ক্ষমতার ও দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তারা অবস্থান করেন। সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন ভূমিহীন ও খেতমজুর। এদের একাংশ পরের জমিতে বর্গাচাষী হিসেবে কাজ করেন আর বিরাট অংশ খেতমজুর হিসেবে অথবা অন্য কোনোভাবে কঠোর মেহনত করে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটান। বেকারত্বের সমস্যা তাদের জীবনে সবচেয়ে বড় সমস্যা। মনুষ্যবাসের উপযোগী মজুরী তারা পায় না। গ্রামীণ পরিবারের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পরের জমিতে বর্গাচাষ করে। বর্গার অধীনে জমির পরিমাণ হলো মোট আবাদী জমির এক পঞ্চমাংশেরও অনেক কম। আমাদের ভূমি ব্যবস্থা চরম অসাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। মোট আবাদী জমির এক পঞ্চমাংশ জোতদার ও ধনী কৃষক পরিবারগুলোর হাতে রয়েছে। গ্রামের সাধারণ জনগণ সাধারণতঃ গ্রামীণ মহাজন ও এনজিওদের নির্মম শোষণের শিকার। তাছাড়া সাম্রাজ্যবাদ ও আমলা পুঁজির কারসাজির ফলে কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পান না। বাজারের শোষণের ফলে সকল শ্রেণির কৃষক-খেতমজুর-দিনমজুর এবং শহর ও গ্রামের সাধারণ মানুষ শোষিত হচ্ছেন। সাধারণ মানুষ ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দরুণ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বাস করছেন। বাড়ছে আয় বৈষম্য। সাধারণ জনগণের জীবনে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত নয়।
দেশ এখনো দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে শ্রমজীবী মানুষ, অপরদিকে একদল সুবিধাভোগী লোক। বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জন মানুষ যারা উৎপাদন করেন, শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর ও অন্যান্য মেহনতী মানুষ সারাদিন পরিশ্রম করেও দু’বেলা পেটপুরে খেতে পারে না। শোষণ আর অনুন্নয়ন থেকে সৃষ্ট ক্ষুধা-দারিদ্র্য-বঞ্চনা-মৃত্যু তাদের নিত্যসাথী। কিন্তু এরই পাশাপাশি হাতে গোনা কিছু লোক চরম বিলাসিতায় দিন যাপন করছে। এরা যে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করে তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। রাজধানী ঢাকা শহরে যেখানে কয়েক লক্ষ মানুষ নোংরা অস্বাস্থ্যকর দুর্গন্ধময় খুপড়িতে বাস করে, সেখানে এরা বাস করে প্রাসাদতুল্য অট্টালিকায়। ঘরে তাদের বিলাসী দ্রব্যে ভর্তি। তাদের একেকটি পায়খানার মধ্যেই রয়েছে কয়েক লক্ষ টাকার সামগ্রী। যে দেশে প্রতি বছর না খেয়ে মানুষ মরে হাজারে হাজারে, যে দেশে কয়েক কোটি মানুষ প্রতি রাতে ক্ষুধা পেটে নিয়ে ঘুমাতে যায়, সেই দেশেই সৌখিনতা, বিলাসিতা, বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণ, বছর বছর নতুন নতুন গাড়ী কেনা, বিদেশে শত শত কোটি টাকার সম্পদ-মুদ্রা পাচার, প্রতি রাতে মধ্যপানে যে অপচয় এরা করে তা জঘন্যতম ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ ছাড়া কি হতে পারে? কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে চাই যে, এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। শ্রমজীবী মানুষ শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতির যন্ত্রণা থেকে মুক্তির সুতীব্র আকাঙ্খায় ছটফট করছে। মানুষ চায় পরিবর্তন। গোটা সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন। এর নাম বিপ্লব। প্রয়োজন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতির স্বার্থে। প্রয়োজন শতকরা ৯৫ জন মানুষের বেঁচে থাকার স্বার্থে। এই বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদের নয়া ঔপনিবেশিক শোষণের অবসানসহ শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতি-অনিয়মের রাজত্বের মূলোচ্ছেদ করে কৃষি ও অর্থনীতির ক্ষেত্র থেকে সামন্ত অবশেষের উচ্ছেদ ঘটিয়ে এক নতুন প্রগতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে জনগণের এক শিল্প বিকশিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে সম্পূর্ণত জনগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার। বিপ্লব আজ সামাজিকভাবে অবশ্যম্ভাবীরূপে দেখা দিয়েছে। ক্ষুধাপীড়িত, অত্যাচারিত, শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতি জর্জরিত মানুষকে বেঁচে থাকার তাগিদে মুক্তির আকাঙ্খায় নিজ নিজ ভাগ্য পরিবর্তনের প্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাম প্রগতিশীল শক্তির নেতৃত্বে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জনগণকে অবশ্যই স্বাধীনতাপন্থীদের লাল সবুজ ঝান্ডার নিচে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সৃষ্টি করতে হবে সর্বহারা-শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর-সাধারণ জনগণের স্বার্থের রাজনৈতিক বিকাশ। জনগণ চাইলে, এই অবস্থার পরিবর্তন হবে। অতীতে প্রগতিশীল শক্তির অংশগ্রহণে যেভাবে জনগণ ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, প্রগতিশীলরা এগিয়ে যাবে আর বাংলাদেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে বিদ্যমান শোষণমূলক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন দরকার। দরকার জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুশাসন নিশ্চিত করা। আর সেটি করতে হলে আমাদের বৈষম্যহীন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এই চার নীতিতে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। তাহলেই জনআকাঙ্খা পূরণ করা সম্ভব হবে।”

Manual1 Ad Code

 

Manual3 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code