সিলেট ১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:০৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৫, ২০২১
নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ : একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে অর্থনৈতিক ভগ্নদশা কাটিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অগ্রগতির দেশ হিসেবে অবস্থান করে নিয়েছে।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে অবস্থান করছে। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাস বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতির আকার দ্বিগুণ হতে পারে।
দেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা নদীর ওপর ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বহুমুখী সেতুর নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ, যা দেশের অর্থনীতির মজবুত অবস্থার একটি বড় নিদর্শন। মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরের মতো বেশ কিছু বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে, যা শেষ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করবে।
প্রায় ১৭ কোটি শক্তিশালী জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ দারিদ্র্য দূরীকরণ, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল; সেই সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং স্যানিটেশনের মতো অন্যান্য আর্থ-সামাজিক মানব উন্নয়ন সূচকে মাইলফলক অর্জন করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
২৩ বছরের পাকিস্তানি শোষণ-লুন্ঠন-বৈষম্যের কারণে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যার ৮০%-এরও বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়ের সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।
সম্প্রত পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, “বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় রয়েছে।”
তিনি বলেন, “অনেক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে কারণ স্বাধীনতার পর থেকেই দেশকে দরিদ্র করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।”
সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) তথ্যানুসারে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান এবং সামরিক শাসনের মতো অস্থিতিশীলতার কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কক্ষচ্যুত হওয়ায় স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যাত্রা ছিল কঠিন। ২০০৯ সাল থেকে, দেশে অর্থনৈতিক পরিবর্তন শুরু হয়েছে, এবং প্রধান আর্থ-সামাজিক ও মানবিক সূচকগুলিতে প্রবৃদ্ধির হাওয়া লেগেছে। বাংলাদেশ এখন অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “১৯৭০ সালে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যদি উন্নয়ন সম্ভব হয় তবে অন্য যেকোনো দরিদ্র দেশেও তা সম্ভব।”
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে গত দশকে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন হওয়ায় প্রবৃদ্ধির হার বিশেষ গতি পেয়েছে।”
৮০‘র দশকে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে দেশের রূপান্তরের মূল উপাদান ছিল তৈরি পোশাক খাতের উত্থান। এই খাতে বর্তমানে ৪০ লাখ লোক কাজ করছে, যাদের বেশিরভাগই নারী; এবং এই খাতে বছরে ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় হয়, যা মোট রপ্তানির ৮৪%।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “পোশাক খাত শুধু দেশের অর্থনীতিকেই পরিবর্তন করেনি, বাংলাদেশে নারীর সামাজিক মর্যাদা এবং লিঙ্গ সমতারও পরিবর্তন করেছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, রেমিট্যান্সও দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা ২০২০ সালে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ফলে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ডে পৌঁছেছে।
অর্থ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেতে শুরু করে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ৯০,০০০ ডলার এফডিআই পেয়েছে, এবং ২০১৯ সালে এই পরিমাণ রেকর্ড ৩.৬১ বিলিয়নে পৌঁছেছে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ
সিআরআই‘র মতে, ২০১৯ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০% এবং অতি দারিদ্রের হার ১০% এর নিচে। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারির ফলে দারিদ্র্যের পুনরুত্থানের মধ্যেও বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার অর্ধেক কমিয়ে আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ডক্টর এম আবু ইউসুফ বলেন, “অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নীতি, দেশিয় ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ব্যাপক সামাজিক নিরাপত্তা বলয় কর্মসূচির ফলে মধ্যম ও অতি দারিদ্র্য উভয়ই হ্রাস পেয়েছে।”
কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। দেশ ইতোমধ্যেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
এক সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭২ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৯.৯ মিলিয়ন টন, সেখানে ২০২০ সালে মোট খাদ্যশস্যের উত্পাদন দাঁড়িয়েছে ৪৫.৪ মিলিয়ন টন। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম চাল এবং তৃতীয় বৃহত্তম স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনকারী দেশ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) রবার্ট ডি সিম্পসনের মতে, “বাংলাদেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন করেছে। গ্রামীণ এলাকায় শস্য চাষে আধুনিক প্রযুক্তি এবং মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার আরও বেশি উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে পারে।”
মেগা অবকাঠামো
স্বাধীনতার পর থেকে পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে যোগাযোগ ও বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছে।
পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো মেগা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় নিশ্চিতভাবে দেশের যোগাযোগ জোরদার এবং বিদ্যুতের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করবে।
এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু পদ্মা সেতুই দেশের সামগ্রিক জিডিপিতে ১%-এর বেশি অবদান রাখবে।
একইভাবে বিদ্যুতের পর্যাপ্ততা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শক্তিশালী অগ্রগতি হয়েছে। ১৯৯১ সালে দেশে বিদ্যুতের পর্যাপ্ততা ছিল ১৪% এবং ২০২১ সালে তা ৯৯% এ পৌঁছেছে।
মাইলফলক স্বীকৃতি
জাতিসংঘের উন্নয়ন কমিটির কাছ থেকে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণের সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। যদি এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার তিনটি শর্ত পূরণ করে তাহলে জাতিসংঘ ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য করার সুপারিশ করবে।
মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর ১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে।
এর আগে, বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করে এবং তখন থেকেই এলডিসি তালিকা থেকে বেরিয়ে হওয়ার পথে রয়েছে।
দেশটি এখন ২০৪১ সালের মধ্যে একটি দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত।
এতোসব অর্জনের মধ্যেও, মানসম্মত শিক্ষার অভাব এবং বৈষম্য পরবর্তী উন্নয়নের পথে বড় বাধা।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “দেশে ৯৮% এরও বেশি শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করা সত্ত্বেও, শিক্ষার মান খারাপ রয়ে গেছে, যা দক্ষ কর্মশক্তির বিকাশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।”
তিনি আরও বলেন, “চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের উচিত শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে কাজ করা।”
অধ্যাপক রহমানের মতে, ক্রমবর্ধমান আয় এবং সম্পদের বৈষম্যও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ধীরগতির জন্য দায়ী।
দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৩৪ মার্কিন ডলার এবং ২০২০ সালে তা ২০৬৪ ডলারে পৌঁছেছে। কিন্তু একইসঙ্গে বৈষম্যের অনুপাতও বেড়েছে।
অন্যদিকে, গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট-২০২০ অনুসারে, বাংলাদেশ তার সামগ্রিক লিঙ্গ ব্যবধান ৭৩% দূর করেছে। তবে দেশের উন্নয়নের জন্য সমস্ত ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি