সিলেট ১০ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:২৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩১, ২০২২
নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ৩১ আগস্ট ২০২২: ২০২১ সালে বাংলাদেশে ৭০.৯ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
জরিপে অন্তর্ভুক্ত ১৭টি সেবাখাত বিবেচনায় শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। পরের দুটি অবস্থানে রয়েছে পাসপোট ও বিআরটিএ। অন্যদিকে, জরিপে অন্তর্ভুক্ত ঘুষদাতা খানার ৭২.১ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার কারণ হিসেবে “ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না”- এ কথা বলেছেন, অর্থাৎ ঘুষ আদায়ের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অব্যাহত রয়েছে। সার্বিকভাবে খানা প্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে এবং জাতীয় পর্যায়ে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ দশমিক ১ কোটি টাকা। ‘সেবাখাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’-এর ফলাফল প্রকাশে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি।
আজ বুধবার (৩১ অাগস্ট ২০২২) টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।
টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের রিসার্চ ফেলো ফারহানা রহমান ও মোহাম্মদ নূরে আলম।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে সার্বিকভাবে উত্তরদাতাদের ৭০.৯ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছে, যা ২০১৭ সালে ছিলো ৬৬.৫ শতাংশ উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বরাবরের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। অন্য যে সকল খাতে দুর্নীতির শিকার হওয়ার হার তুলনামূলকভাবে বেশি তার মধ্যে রয়েছে পাসপোর্ট সেবা, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, ভূমি, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার খাত। আরো উদ্বেগের বিষয় এই যে, যে সকল খানা সেবা পেতে গিয়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের ৭২ শতাংশের বেশি উত্তরদাতার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ঘুষ দেওয়া ছাড়া সেবা পাওয়া অসম্ভব। অর্থাৎ সেবাখাতে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে যদিও দুর্নীতির ফলে সকল শ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে প্রতিবন্ধী, গ্রামাঞ্চলের ও নিম্নআয়ের খানা অর্থাৎ প্রান্তিক জনগনের ওপর এর প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। সরকারি কর্মকর্তাদেরকেও উল্লেখযোগ্য হারে দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে; আবার যারা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা তারা চাকুরিরত কর্মকর্তাদের তুলনায় বেশি হারে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।”
গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে ড. জামান বলেন, “পৃথিবীর সকল দেশেই সেবাখাতে দুর্নীতি হয়। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির প্রত্যাশিত মাত্রায় কার্যকর প্রয়োগ আমাদের দেশে দেখা যায় না। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা থাকলেও, তা বাস্তবায়নের দায়িত্বে যারা আছেন তারা সেটি করছেন না, বরং লঙ্ঘন করছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের প্রক্রিয়া পর্যাপ্ত নয়, যেটুকুও আছে সেটির ওপরও মানুষের আস্থার অভাব লক্ষণীয়। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা রয়েছে, তার কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সারাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে পারলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।”
সেবাখাতে দুর্নীতি নিয়ে টিআইবি পরিচালিত নবম খানা জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত সাত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭৪.৪ শতাংশ), পাসপোর্ট (৭০.৫ শতাংশ), বিআরটিএ (৬৮.৩ শতাংশ) বিচারিক সেবা (৫৬.৮ শতাংশ), স্বাস্থ্যসেবা (৪৮.৭ শতাংশ), স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (৪৬.৬ শতাংশ) এবং ভূমি সেবা (৪৬.৩ শতাংশ)। অন্যদিকে ২০২১ সালে সার্বিকভাবে ঘুষের শিকার হওয়া খানার হার ৪০ দশমিক ১ শতাংশ, এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঘুষ গ্রহণকারী তিনটি খাত হচ্ছে পাসপোর্ট, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও বিআরটিএ। ২০২১ সালে সার্বিকভাবে খানা প্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে এবং সর্বোচ্চ ঘুষ আদায়ের তিনটি খাত হল বীমা, বিচারিক ও গ্যাস সেবা। জাতীয় পর্যায়ে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ দশমিক ১ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশে জিডিপির শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ।
জরিপের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সার্বিকভাবে ২০১৭ সালের তুলনায় সেবাখাতে দুর্নীতির শিকার খানার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থের হার কমেছে কিন্তু ঘুষ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে। অপরদিকে অন্যান্য অনিয়ম-দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে সেবাখাতে দুর্নীতি বেড়েছে। বিভিন্ন খাতে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও কোনো কোনো সেবাখাতে তা পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় দুর্নীতি একই অবস্থায় রয়েছে (যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, বিআরটিএ ইত্যাদি) এবং কিছু খাতে বৃদ্ধি পেয়েছে (স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বিমা ইত্যাদি)। এছাড়া, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে কোনো কোনো খাতে ঘুষের শিকার খানার হার বেড়েছে (স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান) এবং কোনো কোনো খাতে কমেছে (কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা)।
জরিপে আর্থ-সামাজিক অবস্থানভেদে খানার দুর্নীতির শিকার হওয়ার হারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য তারতম্য পরিলক্ষিত হয়নি। তবে ঘুষের ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী খানার শিকার হওয়ার হার বেশি (৩৬.৬ শতাংশ বনাম ৪৬.৫ শতাংশ)। উচ্চ আয়ের তুলনায় নিম্নআয়ের খানার ওপর দুর্নীতির বোঝা অপেক্ষাকৃত বেশি। সেবা নিতে গিয়ে উচ্চ আয়ের তুলনায় নিম্ন আয়ের খানা তাদের বার্ষিক আয়ের অপেক্ষাকৃত বেশি অংশ ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে আরও পাওয়া যায়, পুরুষ সেবাগ্রহীতার তুলনায় নারী সেবাগ্রহীতারা কোনো কোনো খাতে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছে (স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, অন্যান্য খাত) এবং কোনো কোনো সেবাখাতে নারীদের তুলনায় পুরুষ সেবাগ্রহীতারা বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছে (শিক্ষা, ভূমি সেবা)। এছাড়া ৩৫ বছরের নিচের সেবাগ্রহীতাদের তুলনায় ৩৬ ও এর বেশি বয়সের সেবাগ্রহীতারা অপেক্ষাকৃত বেশি দুর্নীতির শিকার হয়।
২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ৮ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত দেশের ৬৪টি জেলায় জরিপটি পরিচালিত হয়। নির্বাচিত খানাগুলো ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন সেবাখাতে সেবা গ্রহণের সময় যে সকল দুর্নীতি ও হয়রানির মুখোমুখি হয়েছে তার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে নীতি-নির্ধারণী এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য টিআইবির সুপারিশমালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিভিন্ন সেবাখাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনানুগভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করা; সেবাগ্রহীতার সাথে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হ্রাসে সকল সেবা ডিজিটালাইজ করা, সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিস চালু করা এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা; সেবাপ্রদানকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সেবাপ্রদানকারীদের আচরণগত বিষয়গুলো জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন ও কার্যকর করা; বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত মানদন্ডের ওপর ভিত্তি করে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করা; সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানির মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
জরিপের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল ও যাবতীয় নথিপত্রের জন্য ভিজিট করুন : https://www.ti-bangladesh.org/beta3/index.php/en/research-policy/93-household-survey/6521-2022-08-31-04-46-29
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D