সিলেট ১০ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৮, ২০২৩
এইমাত্র ‘দিকদর্শন’ প্রকাশনীর দাদা রতন পাল এর কাছ থেকে পেলাম উপন্যাসের প্রচ্ছদের ছবি। উনার পরিচালনায় ‘গ্রন্থকুটির’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হবে ‘বিলেতের বাউরি বাতাস’ ❤️ দ্বিতীয় উপন্যাস। এর আগে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম উপন্যাস ‘শিউলির কথা’। বন্ধুরা এটি আমার গ্রন্থ হিসেবে ৬ষ্ঠ। ‘প্রচ্ছদ শিল্পীঃ অরূপ মান্দি।
বি.দ্র.উল্লেখ্য বিলেতে সাত বছরের অবস্থানের কারণ এ উপন্যাসের উদ্ভব। বিলেতের অবৈধ ইমিগ্রেন্টদের উপর ভিত্তি করে প্রেমোপন্যাস। বইটা একটু দীর্ঘ কলেবরে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে বইটা লেখা শুরু করেছি। গত জুনে শেষ হয়েছে। আশাকরি ভালো লাগবে। সকলের আশির্বাদ কামনা। বইটি হরেকরকম.কম থেকে কিনতে পারবেন।
উপন্যাস থেকে কিছু অংশ :
………………………….
`আমি একটু অন্যরকম পেখম মেলার ইচ্ছা রাখি
বুকে আমার একটু জখম অন্যরকম।’
আমার এক প্রিয় কবির কবিতা দিয়েই শুরু করছি তোমাকে লেখা…
‘তুমি সম্বোধনের উর্ধ্বে। সম্বোধন ভাষাশ্রিত একটি শব্দমাত্র। তোমার আমার সম্পর্কের অনুভব, আত্মার অপার উপলব্ধিজাত ভাবের গভীরতা কোন ভাষায় প্রকাশ সম্ভব! তুমি আমার কে? তা আমি ছাড়া জানে কে! কি নামে তবে ডাকবো? পৃথিবীর প্রচলিত কোন ডাকে বোঝাতে পারব না তুমি আমার কত প্রিয় কত আপন, কত যে আপন! তোমাকে ঘিরে আমার উচ্চাকাঙ্কার যত কথা, তোমাকে নিয়ে আমার অনুরাগের যত আরাধনা লিখেও ফুরুবে না জনম জনম। আজ রাতভর লিখে যাবো যে থাকে দেখার বাইরে আমার অপেক্ষায়। আমি তার সে আমার এ ভোরের আকাশের নীলের মতো, ঝর্ণার উচ্ছলতার মতো স্বচ্ছ ও শব্দময়। স্ফটিক শিশিরের মতো স্নিগ্ধ আর রাঙাফুলের লালের মতো লাজুক ও মায়াময়। তুমি ফ্যানিব্রাউনের মতো (কিটসের প্রেমিকা), ইসাবেলার মতো(বায়রনের প্রেমিকা), বিয়াত্রিস বা লেডি সিম্ফসনের মতো আমার সমস্ত অন্ধকার জুড়ে এক উজ্জ্বল সূর্য।তোমার সম্মুখে যাবো। বসে মুখোমুখি অনুক্ত কথার উৎসবে মুখর হবো সে আমার শৈশবের ভোরের প্রথম শুভেচ্ছা। এ সম্পর্ক সুরের সিম্ফনি ছড়িয়ে কানে কানে বলে যাবে এ বরফ আর বরফের মানুষের অলিন্দে। সুখ সুখ আর সুখের নিবিড়তায় জেগে ওঠবে এ শহরের ইট, কাঠ আর বরফ হৃদয়েরা বহু আগেই যা জমা পড়েছে ধন আর পূর্তির কারাগারে। আমরা এক হবো। ভাগাভাগি করে পরস্পরের সুখ আর দুঃখের অস্ফুট রাগ-অনুরাগ ছুঁয়ে ছুঁয়ে জ্বালাবো দীপাবলী; জ্বলবও অন্তরের ক্ষত সব পুড়িয়ে পুড়িয়ে…
তুমি ভালো থেকো ভালোবাসার মিষ্টি অনুভূতি ও সঞ্চিত সুধা নিয়ে, আমার আদর ও আশির্বাদ নিয়ে ঠিক তোমার মতো আনন্দময়ী, লাবন্যময়ী, রূপময়ী…’
তোমার রূপক
চিঠিটা কয়েকদিন ধরে পড়ছে। পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্থ। ভাব আর আবেগ মিশে অভিমানের স্তর গাঢ় হচ্ছে। পলির সাথে জমছে পাথর। উদগীরণ হয়ে যেতে পারে; অগ্নির দাহ পুড়িয়ে ফেলতে পারে প্রাণ প্রবাহ। এদিকে রেস্টুরেন্টের খবর দিতে উসখুস করছে মন। নতুন প্রেমের মতো নতুন কাজের নতুন অনুভূতি। রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে ফোন ঘুরালো বার কয়েক। না কোন খবর নাই; কেউ নাই। কপালটা কুঁচকে আছে সে থেকে।
-কি গো আপা। কেমন আছো? কেমুন কাজ করতাছো? মালতীলতাকে গম্ভীর দেখায়।
-ভাল। মাথা নাড়ে পৃথ্বী…শুকনো ঠোঁটে হালকা হাসি…
-চিন্তাযুক্ত লাগে। ফোনে কথা অয় না মনে অয়।
মালতীলতার এ খোঁচাটায় যদিও সহমর্মিতা মিশে আছে যদিও রূপকের সাথে আগে থেকেই সম্পর্কিত মালতীলতা তবু যেন রূপক তার মানুষ। তার এবং রূপকের সমস্যা তাদের দুজনের। ধীরে ধীরে রূপকের সবকিছুতে তার অধিকার দৃঢ় হচ্ছে। ঠিক যেমন কর্মকান্ডের…
-এই সব বেটা মানুষরে বেশি প্রশ্রয় দিবা না। মিশ সমস্যা নাই। ঠাণ্ডার দেশ বয়ফ্রেন্ড লাগে, নয়তো শইলের লগে মনও জইম্মা যাইবো। তবে মনের বিত্তে ঢুকাইবা না। তুমি মনে অয় বেশি সিরিয়াস। চাকরিটা পাইছ মন দিয়া কাজ কর।
তা ঠিক। মালতীলতা ঠিকই বলেছে। চাকরি নাই তো কিছু নাই। এ মহাশূন্যতায় কে কার খবর রাখবে? ব্রিটিশ সরকার ঢেলে বেনিফিট দিচ্ছে। কিন্তু তা সবার জন্য নয়। যারা ভিজিটর বা অবৈধ তাদের জীবন শুকনো রুটির মতো। গেলাও যায় না ফেলাও যায় না। পায়ে পায়ে বিপদ। কেউ কাজ তো দেয় না বরং ধরিয়ে দেয় পুলিশে। ভয় আশঙ্কা নিত্যসঙ্গী; এমনকি তাদের চিকিৎসায়ও কেউ এগিয়ে আসে না। মালতীলতার কারণেই এ চাকরি। নয়তো নতুন অনভিজ্ঞ ভিজিটরকে কেন কাজ দিবে? যে ধরা পড়লে মালিকের দশ হাজার পাউন্ড জরিমানা হবে। তবুও মনের কোণে ঘুরেফিরে প্রশ্নরা উঁকিজুঁকি মারে, ‘রূপক জানে তো তার কাজের অবস্থা!’
পরদিন সকাল সাতটায় ঘর থেকে বের হয় পৃথ্বী। দুটো ট্রেন পাল্টাতে হয় তাকে। পেকামে আণ্ডারগ্রাউণ্ড লাইন নাই আছে বৃটিশ রেল। প্রথমে বৃটিশ রেল ও পরে আণ্ডারগ্রাউণ্ড এর নর্দান লাইন। ঘর থেকে বের হয়ে বাসে উঠতে হয়। বৃটিশ রেলে টোটেনহাম কোর্টরোড স্টেশনে নেমে নর্দান লাইন ধরতে হয়। স্টেশন বদল আর ভীষণ খাড়া চারতলার সমান উঁচু দোতলার নীচে নামতে উঠতে হাজার মানুষের চঞ্চলতার ভেতর গলে যায় জোছনার মতো, ফুলের সুগন্ধ বয়ে চলা রাতের জোনাকি হাটে দিনের স্টেশনে। সবাই এত উদ্দাম চঞ্চল যে কেউ কারো দিকে তাকায় না। কোথায় ঝরে যায় ফুল কোথাও ক্রন্দন। এটা একটা বড় স্টেশন; আরও চারটি ট্রেন থামে। একটু অমনোযোগী হলেই উল্টোদিকে ছুটতে হবে। কেউ বলে দেবে না ‘নামো, নামো। আণ্ডারগ্রাউণ্ডে মোবাইল ফোন কাজ করে না। ফোন কোম্পানিদের নেটওয়ার্ক থাকে না। ফোন থাকে বেগে। কাজেই স্টেশনের দিকে মনোযোগ থাকে। বিশাল স্টেশনের লাল এরো চিহ্ন ধরে ডান বাম করতে করতে ট্রেনের নির্দ্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে স্বস্থি মেলে। রূপকের শেখানো হয় না ট্রেনে চড়া। ট্রেনের ম্যাপ দেখে নিজে নিজেই শিখেছে। প্রথমদিন ওয়েস্টারে স্টেশনে ঢুকতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কিছুতেই দরোজা খোলে না। পরে স্টেশনের লোকের সাহায্য নেয়। আরও দু-একবারের পর সহজ হয়েছে চলাচল।
-সবসময় রাস্তার সাইন বোর্ড এ এরো চিহ্ন দেখবে। এ দেশে কোন কিছু খামাখা থাকে না। সবকিছুরই কোন না কোন প্রয়োজন থাকে। তোমার প্রয়োজনেরটায় চোখ রাখবে। রূপকের এসব কথা কাজ করছে পথ চলতে। ট্রেনের অপেক্ষা করতে করতে ভীষণ ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো হু হু করে বুকের ভেতর অস্বস্থি ও কষ্ট। শত শত মানুষ কিন্তু কোথাও কেউ নেই গোছের জীবন। যার কেউ আছে তার আছে। ট্রেনে সবাই যার যার মতো থাকে; কেউ পেপার পড়ে, কেউ জড়িয়ে রাখে আপনজনের বাহুডোর কিংবা হাতের আঙুল। কেউ ফোনের বাটন টিপে কান বন্ধ রাখে। সবার সামনেই ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় কেউ কেউ। কেউ অস্বস্তি অনুভব করে না। তবে এখনো কেউ অস্বস্তি বোধ করে যুবক যুবক বা যুবতী যুবতী যদি একই কাজ করে।
ক্যামডন শহরের কেন রোডে একমাত্র বাঙালি ‘প্রিয় রেস্টুরেন্ট। সব রেস্টুরেন্টই হোয়াইট চ্যাপেল, ব্যাথনাল গ্রিন ও ব্রিকলেনে। পরম সৌভাগ্যে সে কাজ পেয়েছে। রেস্টুরেন্ট তত বড় নয়। বসার জন্য আটটা টেবিল ও তার সাথে চারটা করে চেয়ার। একটা কাচের বড় বক্স যাতে সব রান্না খাবার সাজিয়ে রাখা হয়। একপাশে মাইক্রোওভেন, চায়ের কেতলি। কাপ, পিরিচ, চা, দুধ। ভেতরে বড় ফ্রিজ ও ডিপ ফ্রিজ। পাশাপাশি চারটা চুলা ও তন্দুরি ওভেন। যাতে নানরুটি শিক কাবাব, তন্দুরি চিকেন, টিক্কা বানানো হয়।
সকালের নাস্তা রুটি বা পরোটার সাথে সব্জি, ভাজি ও ডিম। প্রথম দুদিন তার ট্রেনিং পর্ব ছিল। কাজ শিখিয়ে দিয়েছে প্রধান শেফ কালা মিয়া। তাকে সবাই কালা ভাই ডাকে। আগে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের শেফ ছিল। বয়স বাড়তির দিকে। আসে এগারটায়; চলে যায় তিনটায়। সকাল আটটায় পৃথ্বীর কাজ। এ সময় কেউ থাকে না। মজবুত চাবি দিয়ে গেটের তালার পরে সার্টার খুলে সাদা বোর্ডের ওপর লাল রঙে লেখা ওপেন সাইনবোর্ড লাগায়। আগের দিনের পরিষ্কার করা ঘর ঝকঝকে তকতকে। এক কাপ চা বানিয়ে বিস্কুট দিয়ে খায় কাস্টমারের চেয়ারে বসে। যদিও তাদের খাবার খেতে হয় ভেতরে নিয়ম অনুযায়ী। চা ও বিস্কুটের ব্যবস্থা সামনেই একপাশে থাকে। সামনের রোজিনা এর আগে চা বানিয়ে খাইয়েছে। বিকালে পেঁয়াজু ও পুরি বানায় মোহনা বানায়।
ছমোছা, সিঙ্গারা, পিয়াজুর কড়াইয়ের নীচ থেকে একটা ইঁদুর দৌড়ে যায়। কদিন আগে একটা মরা ইঁদুর পড়েছিল এ তেলে। পৃথ্বী ইঁদুর দেখে ভয়ে ও ঘৃণায় মনটা ভার করে ফেলে। সে ভার নিয়ে আলু, সীম কেটে ভাজি বসায়। শুধু চা খেতে আসে একজন কাস্টমার। চা দেয়ার নিয়ম খাবারের পর। শুধু চা দেয়া যায় না। এটা চায়ের দোকান নয়। পৃথ্বী ভেতর থেকে এসে নিষেধ করে। লোকটি রোজিনাকে খোঁজে। সামনে কাজ করে রুয়েল, রমিজ ভাই, রোজিনা, মালিক বা গাবনার মনিরুল মাইজভান্ডারী ভাই। রোজিনা দশটায় আসবে জানায় সে।
-আর কেউ নেই?
পৃথ্বী কথা বলে না।
-তুমি চাপাতি বানিয়ে খাওয়াবে? কেমন বানাও দেখি তো? এখানে রুটিকে বলে চাপাতি আর নানরুটিকে বলে রুটি।
-হাঁ
-একা কাজ কর? লোকটার কথা চলছে…
-হাঁ। একটু পর সবাই আসবে।
-কেমন লাগে লন্ডন শহর?একটা রেস্টুরেন্টে একা একটা মেয়ে দেখে লোকটা মজা পেয়েছে।
-ভালো
-চাপাতি বানাও তো আমি দেখি। দুইটা চাপাতি আর ডিম ভাজি। লোকটা গা ঘেষে দাঁড়ায়। চিবুকে হালকা টোকা মারে।
-বসেন, বলে কান ঝালাপালা অস্বস্থি নিয়ে পৃথ্বী ভেতরে আসে। লোকটা তার সাথে সাথে ভেতরে আসে। উস্কখুষ্ক চুল, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। গা থেকে ভ্যাপসা গন্ধ মনে হয় রাতের পোশাক বদলানো হয়নি। চুলার ভাজির ঢাকনাটা উল্টে দেখে। ঘ্রাণ নেয়…
-আহ সব্জিও হচ্ছে। দারুণ ধনিয়া পাতার ঘ্রাণ আর আমার বাংলাদেশর উরি না!
-হাঁ, আপনি সামনে বসেন প্লিজ। কাস্টমারের সাথে খারাপ ব্যবহার করা যায় না। পৃথ্বীর কণ্ঠের ভারি শব্দে লোকটা আস্তে আস্তে সামনে গিয়ে বসে।
দশ মিনিটে দুটো চাপাতি ও একটা ডিম অমলেট ভেজে পৃথ্বী দাঁড়ায়।
-তুমি তো নতুন এত তাড়াতাড়ি বানাতে পারলে? পৃথ্বী হাসে না, বলে না কিছু। তার লাল-কালো শার্টপেন্টের উপর বেগুনি-সাদা টানের এপ্রোন যা শুধু সামনের দিক ঢাকা। লোকটা তাকিয়ে থাকে পেছন দিকে; অস্বস্থির কালো ছায়া শীরদাড়া বেয়ে নেমে যায়। আগের দিন অল্প তেলে গুলানো আটা হালকা মিশ্রণ করে ফ্রিজের নরমাল অংশে রেখে দেওয়া হয়। তাই বানাতে বেশি সময় নেয় না। ডিপ ফ্রিজের বিশাল ঢাকনার উপরই চাপাতি, পরোটা, নান রুটি, সমোছা, সিঙ্গারা বানানো হয়। এ কাজের দায়িত্বে আছে তন্দুরি সেপ মোহনা। তত পাকা নয় কাজ করতে করতে শিখেছে।
আরও কয়েকজন ডিম, সব্জি ও চাপাতি খেয়ে বিদায় নেবার পর আয়কৃত টাকা গুনে দেখে আট পাউন্ড। এ টাকাটা রোজিনার হাতে দিতে হবে। রোজিনা শ্যামলা মেয়ে আই লাইনার পরা চোখ দুটো টানা টানা। গোলাকৃতির মুখ, বেশ আহ্লাদ ও মায়া লাগিয়ে কথা বলে। গাবনারের বিশ্বস্ত ও খুব পছন্দের মানুষ সে। গাবনারের পরে ক্যাশ শুধু রোজিনাই রাখে। রোজিনা স্মার্ট সুন্দরী তাই সামনে কাজ করে। ঘড়ি দেখে নয়টা চৌদ্দ। পুরনো কিছু তরকারী গরম করে ট্রে সাজিয়ে রাখে। দুদিন হয়ে গেলে খাবার বিনে ফেলে দেয়া হয়। ধোয়াধুয়ির কাজ শেষ করেও হাতে সময় থাকে। বার বার মোবাইলের দিকে চোখ যায়। মেসেজ চেম্বারে জমানো মেসেজ। অনুরাগ ও আব্দারের কত বাক পরিক্রমা। এ সময় কোন এক ফাঁকে রেস্টুরেন্টের একাকিত্বের আবছায়া আলো আঁধারীতে তার মন প্রিয় সান্নিধ্যের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠে। ইচ্ছার উদগ্রতার কাছে হেরে যায় সংযমের আবেষ্টিত বাঁধ। চোখ ভিজে ওঠে। ‘ও চোখ তুই দেখ কত কাজ জমা রেস্টুরেন্টে। ম্যাসেজ চেম্বারে রূপকের ছবি আছে তাতে কি! এ শুধু কাজের দিন এ লগন কাজ করবার।
-যদি কাজটা হয় কাজের সময় আমার কথা ভাববে না। মনে থাকবে?
-না, হাসে পৃথ্বী।
-ফোন বা মিসকল মারবে না দুষ্ট। রেস্টুরেন্টে আসার আগের দিন সাবধান ও সতর্ক করে দেয়া রূপক জানতেও চাচ্ছে না কোনোকিছু। অভিমান যেন বুক ভেঙে আসতে চায়। চিঠিটা হ্যান্ডবেগে আছে বের করে না পৃথ্বী। জানে এ চিঠি বের করলে কেঁদেই ফেলবে। এত কঠিন ভাষা অথচ কি মিষ্টি তার রেশ। নিজেকে সামলে নিয়ে কাজে লেগে যাওয়াটাই ভালো। রেস্টুরেন্টের কাজ তো ঘরের কাজ। মায়ের বকা খেত এসব কাজ না করার জন্য। মা’র কথা ছিল পরের বাড়িতে লাঞ্ছিত না হবার জন্য। যে কাজ সম্মান দিতে পারে না। সামাজিকভাবে মর্যাদায় দাঁড় করাতে পারে না তা লাঞ্ছনা ছাড়া আর কি হতে পারে। আজ রুমার কাজ জীবিকা নির্বাহের; নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। নিজেকে স্বাবলম্বী করে পরাধীনতার শেকল ভাঙবে সে।
সবার আগে যা করতে হয় নেটের বস্তা থেকে পেঁয়াজ নিয়ে ছুরি দিয়ে খোসা ছাড়াতে শুরু করে। এখানে পেঁয়াজ ধোয়া হয় না খোসা ছাড়ানোর আগে বা পরে। শাক আঁটির মধ্যে রেখেই নেড়েচেড়ে ধোয়া হয়। অবশ্য বাংলাদেশ থেকে শাকগুলো আসে পরিষ্কার ও ঝকঝকে। একটু মাটি থাকলে যেন ভালো হত-ও আমার দেশের মাটি তোমায় দিয়ে লাগাই টিকা। লাল শাক ও পালং শাক, এখন মৌসুমী মুলা শাক রয়েছে। ভেড়ার মাংস ও চাল একবার ধোয়। শুধু মাছটাই বেশি ধোয়া হয়। মাছকাটা ও ধোয়া তার ভাগেই পড়েছে। আরো কাটতে হয় শাক, ঢেঁড়স; আলু, পেঁয়াজের সাথেই খোসা ছাড়িয়ে রাখা হয়। সেটা মোহনা কাটে, কালা ভাইও কাটে হাতে সময় থাকলে। ছুরিতে ভাই যখন পেঁয়াজ কাটে হাত দেখা যায় না। যেন একটা রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে । ছুরির সাদা পাতের সাথে সাদা রশ্মি। পৃথ্বী তাকিয়ে থাকে বিবশে-বিস্ময়ে। কালা ভাই তখন পৃথ্বীর দিকে তাকিয়ে হাসে অভিজ্ঞ হাসি। চিকন গলায় গুনগুন গান গায় ‘‘পেঁয়াজ কাটে, সব্জি কাটে কোন রুপসী গাঁয়, ননদিনী, পাড়াপড়সী লুকিয়ে লুকিয়ে চায় ‘’ দেশি ছোট মাছের দাম বেশি তাই সাথে থাকে বার্মার কাঁচকি, পুঁটি ও মলা মাছ সেগুলোর দাম কম। রুই ও ইলিশ মাছ আঁশসহ কেটে আনে মেশিনে। ভেজানোর পর হাত দিয়ে নয়তো চামচ দিয়ে আঁশ ছাড়াতে হয়। এ দেশের তাজা মেকরোল, টুনা ও সার্ডিন আনে। মেকরোলকে সিদ্ধ করে কাঁটা ছাড়িয়ে ঝুরঝুর করে ভাজা হয় পেঁয়াজ ও ধনিয়ার কুচি দিয়ে। এটাকে বলে ঝুরি। কচুর লতি ও কাঁঠাল বিচির প্যাকেট থাকে বড় চিংড়ি দিয়ে পাকানো হয়।
বাজার নিয়ে আসে রুয়েল। চিকন মুখ ও শরীর, ফর্সা রঙ, উচ্চতা কম। চিবুকের পাশ দিয়ে কাটা দাগ। ইঁদুরের মতো চিকন ছোট দাঁত। কথা বলার সময় গাল কাত করে একরকম হাসে।
চামচ দিয়ে রুইয়ের আঁশ ছাড়িয়ে রুই ও বোয়াল ধুয়ে দিয়ে পৃথ্বী কাঁচি দিয়ে কই ও শিং মাছ কুটতে লেগে যায়। রোজিনা আসে। টানটান চোখের সুন্দর মেয়ে রোজিনার বুকগুলোও টানটান। বেশ দীপ্ত সুন্দর। কালো কোটের নীচে ফিটিং পোশাক। আজকে গোলাপি টপের সাথে ব্রাউন পেন্ট পরেছে। দামি হ্যান্ডবেগ ও কোট সিঁড়ির উপরে রেখে আসে। এখানে সিঁড়ি পর্যন্তই রাস্তা বন্ধ। পৃথ্বীর সাথে কুশল বিনিময় করে জুতার আওয়াজ তুলে সামনে যায়। আসে তন্দুরী শেফ মোহনা ও শেফ কালাভাই। মোহনা একেবারেই আনপড় গেয়ো মহিলা। দেশে থাকতে গ্রামের ক্ষেত খামার করেছে। এখানে পাউন্ড হাতে আসায় অহংকার বেড়েছে। পোশাক দামি পরে বটে তা তার আসলত্ব গোছায় না।পান-জর্দায় কালো দাঁত বের করে হাসে। কালাভাইও সে পর্যায়ের; তবে মানুষটা মায়াবী। কথাবার্তায় আন্তরিকতা সে বয়সেই হোক আর স্বভাবেই হোক।
সবাই কাজে ডুবোডুবি। ঘরের মাঝখানে স্টিলের উচুঁ টেবিলে কেটে রাখা পেঁয়াজ ও সব্জি।কালা ভাই চুলার দিকে তার ডানে একটা নীচু টেবিলে বাটিতে গুড়া ও ব্লেন্ড করা সব ধরনের মশলা সাজিয়ে ভেড়ার মাংস দিয়ে রান্না শুরু করে দিয়েছে এখানে বলে লেম। মশুরি, মুগ ও ছোলা মেশানো তিন ধরনের ডাল পৃথ্বী আগে থেকেই চুলায় বসিয়ে দিয়েছে।পেছনের সারির ডানের শেষ চুলাটা ডালের। চারটা চারটা আটটা চুলার সেট এটা।একেবারে বাঁয়ের চুলাটা চাপাতি, পরোটা ও ডিম ভাজির জন্য বরাদ্ধ। অবশ্য এ সময়ে এসব অর্ডার বেশি আসে না। তখন মোহনা শাক বা কোন মাছ রান্নায় কালা ভাইকে সহায়তা করে।
সবশেষে এক গাদা ব্লকের বাংলাদেশী বাইং, পাবদা, শিং, কাঁচকি, মলা, বুতুম, চিংড়ি, মেনি , ইলিশ মাছের ব্লক নিয়ে ঢোকে মালিক মনিরুল মাইজভান্ডারী। ঢোকে পেছনের দরোজা দিয়ে। কেননা গাড়ি থেকে মাছ ডিপ ফ্রিজে রাখা সহজ। সবার সাথে ভালমন্দ খবরাদি নেয়।
তাকে বলে, পৃথ্বী আপা ঠিক আছো তো? কাজ বোঝা যাচ্ছে?
পৃথ্বী হাসে, হাঁ সব ঠিক আছে।
-ঠিক থাকব না পৃথ্বী আপা আসলে ঘর হাসে গো! যেদিকে যায় ঘরও লড়ে গো! কালা ভাইর কথায় সবাই হেসে ওঠে।
-ঘর হাসলে তো হবে না? কাজ শিখবে।
-হ ভাইছাব বুদ্ধি বালা। তয় এহন তো নতুন, হিগ্গা যাইবো মোহনা বাঁকা ঠোঁটে হাসে।
-কেউ কাজ শিখাইব না গো আপা। নিজে নিজে শিখবে।
-ছায়া আপা আছে? বলতে বলতে গাবনার সামনে চলে যায়। রোজিনার ডাক নাম ছায়া, গাবনার ভাই সে নামেই ডাকে। সামনের প্লেট বাটি সাজাবার টুংটাং শব্দ আসে। বেলা একটা থেকে দেড়টার মধ্যে বারো পদের তরকারি ও ডাল একে একে সামনের দিকে বন্ধ ও পেছনে খোলা কাচের বাক্সে স্টিলের ট্রেতে রাখা হয়।
প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত কাজের ছুটি পৃথ্বীর। এটাকে বলে অফ টাইম। বাসা কাছে হলে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে আসতে পারত। এসময় কোট পরে সে লরেন্স পার্কে যায়। বেঞ্চে বসে। একবার ফোন করে রূপককে। ফোন রিসিভ হয় না। কোনদিন মাকে ফোন করে। গ্রামের স্কুলের বান্ধবীদের, কলেজের বন্ধু ও বান্ধবীদের নম্বরও আছে। ডায়েরিটা উল্টেপাল্টে দেখে। কত প্রিয় প্রিয় মুখ মনে পড়ে। দেশে থাকতে স্কুল জীবন শেষে, কলেজ জীবন শেষেও অনেকের খোঁজ নেয়নি, জানার ইচ্ছে জাগেনি কার জীবন কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে। শুধু যারা খোঁজখবর রাখত তারাই ছিল আপন জন; আজ বিদেশে এসে মনে পড়ছে সেসব কচি-মিষ্টি বা সুখ-দুঃখ আঁকা সহজ-সরস মুখচ্ছবি। ক্লাশমিট জীবনের আবির জড়িয়ে তারাও আগলে রেখেছে; মনের গভীর তলদেশ থেকে তাদের জন্য নিঃশ্বাস পড়ে। খোঁজ নিতে দিতে কেন তাদেরই বেশি করে মনে পড়ছে! ফুল কুড়োনোর মতো জীবনের ছোট ছোট স্মৃতির ফুল কুড়িয়ে আঁজলা ভরে রুমা। স্কুলের খুনসুঁটি, জবজবে বৃষ্টিতে কাকভেজা স্কুল গমন, ছাতা উড়িয়ে ধানক্ষেতে পড়া, কাঠের সাঁকো নাড়াচাড়া করে আরেকজনকে ভয় দেখানো। ভাবতে ভাবতে একা একা হেসে ওঠে। ক্লাশ সেভেনে মীনা রাণীর ঋতুস্রাব হয়ে গেল স্কুলেই। আহা সেকী কান্না! দপ্তরী মহিলার পুরানো গাঁট থেকে কাপড় এনেও তার কান্না থামানো যায়নি সেদিন। আজ মিনার দুটো সন্তানের খবর পায়। এর ভেতর কত রক্তপাত ও অশ্রু তার জীবন ভাসিয়ে দিয়েছে কে জানে!
পথচারীদের দামি, কমদামি কোট ও জ্যাকেট পরা । পোশাকের সাথে চলারও মিল রয়েছে। দামি পোশাকপরা মানুষগুলোর গতি ও চোখের দ্যুতি বেশি আর কমদামিদের ম্লান; আড়ষ্ট ও চিন্তাক্লিষ্ট। গতিও ধীর। কেমডনের আর পেকামের মানুষের মধ্যেও মিল-অমিল রয়েছে। ওখানে কালো বেশি সাদা ও বাদামী মোটামুটি এখানে সাদা বেশি কালো বাদামী মোটামুটি।
-মানুষের দিকে কখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকাবে না। এটাকে এদেশে অসভ্যতা মনে করে। রূপকের সতর্কতা সত্ত্বেও না তাকিয়ে পারে না পৃথ্বী। হয়তো ফ্যালফ্যাল নয় তবে মিষ্টি হাসি মাখানো চট করে তাকানোর মতো…
সুন্দর সুন্দর বাচ্চাদের বাগিতে বসিয়ে টানছে মায়েরা। মাঝেমধ্যে বাবাও দেখা যায়। হয়তো মা বাচ্চাকে রেখে কাজে গেছে। কখনো বেশি ছোট বাচ্চা বুকের সাথে বেল্ট দিয়ে বাঁধতে দেখা যায়। বাচ্চাটা বিড়াল ছানার মতো তাকিয়ে থাকে। বড়দের পার্কে এনে ছেড়ে দেয়। ইংরেজির বোল শোনা যায় হাই, ও ডিয়ার, নো…
অনেকেই হেসে তাকে হাই ও হ্যালো বলে। উত্তরে সে মৃদু হাসে। আড়ষ্ট হাত তোলে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফিরে যায় কাজে। কোন কোন দিন মার্কেটে ঢোকে। কোট ও জ্যাকেটের দাম দেখে বিস্মিত হয়। এক একটা কোটের দাম আড়াইশ থেকে তিনশ পাউন্ড। এক পাউন্ডে একশত চল্লিশ টাকা হলে তিনশত পাউন্ডে একশত চল্লিশ গুনন তিনশত তিন চৌদ্দ বিয়াল্লিশ মানে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা। মনে মনে হিসাব করে পৃথ্বী ‘মাই গড এরা কত টাকা কামায়?’ ফড়িংদেহীর দেয়া এরকমই একটা কোট আছে তার।
রাত নয়’টায় পৃথ্বীর ছুটি হয় সবার আগে; যেতে হবে বহুদূরে। এখানে বাকি সবাই কাছাকাছি। মোহনা চায় তাকে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে। নিকটে রোল্যান্ড রোডে সে একজনের কাউন্সিলের বাসা ভাড়া নিয়েছে। উপরের দুই রুমে তারা থাকে; পৃথ্বী চাইলে সিটিং রুমে ভাড়া থাকতে পারে। দাঁতে গুল দিতে দিতে মোহনা জানায়। তার বাড়িতে দিনেও গেস্ট আসে না; আসলেই কি? পৃথ্বী তো কাজেই থাকবে। ডে অফের দিন খালি। কেউ আসলে তো রোববার। পৃথ্বী ভাবছে, এত দূর থেকে আসা সত্যি অনেক কঠিন। তাছাড়া প্রতিদিন ট্রেন খরচ পুরো পাঁচ পাউন্ড। ‘দেখতে যাবো’ বলাতে খেঁকিয়ে ওঠে মোহনা।
-আ আপা কি দেখবা? আর দেরিই বা কর কেনে! তোমার ইনকাম ট্রেনওলারা খাইবে, বাসের কোম্পানী খাইবে। আমার ঘর খালি। আমরা টোনাটুনি। নিজের ঘরের মতো থাকতে পারবা। মালতীলতার ওহানে কতজাতের ফিরিঙ্গি ঘোরে!
-কি?
-না এমতেই কইলাম। ক্লাবো টাবো ঘোরে মালতীলতা। কেসিনোত যায়।
মালতীলতার কথা মনে পড়ছে। এ রেস্টুরেন্টের মালিকের সহকর্মী । শেষে না কাজটাই চলে যায়। একটা মাসিক টিকেট কেটে নেওয়ার নিয়ম আছে। ট্রেনের মাসিক টিকেট নব্বই পাউন্ডে করা যায়। তাকে আবার একটু বাসেও চড়তে হয়। না বাসের মাত্র দুটো স্টপেজ; হেঁটেই যাবে সে।ভাবতে ভাবতে রাতের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে। কতরঙের বাতিতে উজ্জ্বল শহর। ঝকঝকে পরিক্রমা। পাবগুলো কাচের। বাইরে থেকে দেখা যায় আয়েশি হাতে হাতে ড্রিংসের গ্লাস। চুপচাপ শান্ত মূর্তি টেবিলে টেবিলে। ক্লাবগুলো বন্ধ থাকে। কিন্তু ভিতরে ধুন্ধুমার মিউজিক চলে; ধুমধুম ধুন জীবনের আনন্দিত বাজনার আওয়াজ কিছু বাইরে ছড়িয়ে পড়ে… মায়েরা বাচ্চাদের বেবি সিটারের কাছে রেখে শনিবারের আমোদে অংশগ্রহণ করে। জীবনকে জয় করে তারা সরব সুরের মূর্ছনায়। রবিবার বিরতি। সোমবার থেকে তো আটটা চারটা।
অচেনা এ শহর ধীরে ধীরে চেনা হয়ে উঠেছে। অপিরিচিতজনকে এভাবেই মানুষ পরিচিত করে নেয়। পরিচিতরা হারিয়ে যায়, বুকের গভীরে ক্ষত করে অচেনা পথের বাঁকে…
ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা। এসে দেখে মালতীলতা বকাবকি করছে। হিরণপালের আজ রান্না করার কথা ছিল সে কোন কৃৃষ্ণ মন্দিরে খেয়ে এসেছে। কাজেই মালতীলতার অসুস্থ শরীর নিয়ে রান্না করতে হয়েছে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর এসব কথায় কান দিলেও মন দিতে ইচ্ছে করছে না। মালতীলতার শরীর টিপছে আফসার। আফসার হাত, ঘাড় টেপা শেষ করে ধীরে ধীরে মালতীলতার শাড়ি একটু তুলে তুলে পা টিপছে। মালতীলতার পা সাদা মশৃণ।কিছুটা উঁচু করে কাটা নখে খয়েরি নেল পলিশ লাগানো। ঘোলাটে বাল্বের আলোয় চিক চিক করছে পা। পায়ের পাতা ছাড়িয়ে গোড়ালি ও উপরের দিকে নাইটি একটু তুলে তুলে হাতে নেভিয়া লোশন মেখে ম্যাসেজ করছে আফসার। লোশনের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে এদিক ওদিক। উঁহ আহ শব্দ করছে মালতী। কতটুকু তুলতে বলবে মালতীলতা পৃথ্বী ভয় পাচ্ছে! আফসার ভয়ে, না পৃথ্বীর লজ্জায় তত মনোযোগ দিয়ে পা টিপে দিচ্ছে না বলে ধমক খাচ্ছে।
-পাহা এহনো উডে নাই অহনই ছটফটাচ্ছো। যেদিন উডবো বুইনের খবরও নিবা না। বালা কইরা চিপা দে ভাই তোর দুলাভাই থাকলে কি তরে কইতাম! উঁচু গলা আস্তে আস্তে নামিয়ে আনে। মালতীলতা কথা জানে উপযুক্ত জায়গায় উপযুক্ত কথা। সবার মন সোজা করে রাখার কৌশল পুরাই আয়ত্বে।
বাথরুমে কাপড় খুলে হাতমুখ ধুয়ে আসে পৃথ্বী। আফসারের সামনে শুতে পারে না। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বসে বসে ঝিমায়।
-তুমি হুইয়া পড় আপা। সারাদিন রেস্টুরেন্টো ঝক্কি পোহাইছো। কাইল ভোরে আবার দৌড়ন লাগবো। নতুন গরে বেবাক জায়গায় বেশি খাডুনি খাডায়। যেদিন শেফের পোষ্ট টা পাইবা হেদিন আরাম করবা। মালতীলতা রেস্টুরেন্ট শেফ ছিল। অনেক গল্প শুনেছে সে সময়ের। আফসার একটা ক্যাশ এন্ড কারি সোপে কাজ করে নয়টা-দশটা। নীচতলা থেকে ভারী বস্তা ও ফ্রোজেন মাছ উপর তলায় তোলে, ভ্যানে করে আনা মাল স্টোরে রাখে তার হাত চালনা থেকে বোঝা যায় সারাদিনের ক্লান্তি তার আঙুলেও ভর করেছে ঝেঁকে। আফসার চলে গেলে ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বালিশের নিচে রেখে স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধে ঢুকে পড়ে। এই স্যাঁতস্যাঁতে জ্যাবজ্যাবে জীবনই আসল জীবন। এ জীবন থেকে মুক্তির আশাটাই হয়তো আশা হয়ে হাত নাড়ে; নিবিড় করে রাখে জীবনের সাথে। সামনে ছোটার দিকে প্রতিনিয়ত ধাবিত করে। কারও কথা ভাববে না সে; নিঃসীম অন্ধকারে হারিয়ে গেছে অতি আদরের সুখপাখি…
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D