মঙ্গলকোট ও নাগদেবীর মস্তক

প্রকাশিত: ২:৪১ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৮, ২০২৩

মঙ্গলকোট ও নাগদেবীর মস্তক

Manual7 Ad Code

শাহরিয়ার কবীর |

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪৫ তম পর্ব) ||
১৯৭৪ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক বছর হলো। কয়েকজন যুবক গুপ্তধনের সন্ধানে মহাস্থানগড় থেকে ১.৫ কিলোমিটার দূরের নির্জন একটি প্রাচীন ঢিবি খুঁড়তে লাগলো অতি সংগোপনে। আনাড়ি হাতে যথেষ্ট খুঁড়তে গিয়ে তছনছ হয়ে গেলো বাঙালির ইতিহাস গঠনের অনেক মহামূল্যবান উপাদান, একের পর এক পোড়ামাটির নারী মূর্তির মস্তক বেরিয়ে আসতে লাগলো। সেগুলো ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা হলো আশেপাশে। গুপ্তধন পেলো না তারা। কিন্তু এহেন নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞের কথা গোপন থাকলো না, জানাজানি হয়ে গেল অচিরেই। টনক নড়ল প্রশাসনের। এ ঘটনার আরো ছয় বছর পর ১৯৮১ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে উৎখননকার্য শুরু করে। আর এতেই ইতিহাসের একটি রহস্যময় অধ্যায় সবার সামনে চলে আসে।

Manual8 Ad Code

যাঁরা মহাস্থানগড় দেখতে আসেন, অনেকেই একদম কাছের এ প্রত্নস্থানটির কথা জানেন না। একেবারে নিভৃত পল্লীতে অবস্থিত এ প্রত্নস্থান – মঙ্গলকোট ধাপ। বাংলাদেশের বগুড়া জেলার নামুজা ইউনিয়নের চিঙ্গাসপুর গ্রামে এ ঢিবিটি অবস্থিত, পুণ্ড্রনগর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরত্ব।

Manual2 Ad Code

Manual5 Ad Code

১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সময়কালে পরিচালিত প্রত্নখননের ফলে প্রায় বর্গাকৃতির একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, আয়তন ৫.০২ × ৪.৯২ মিটার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এখান থেকে আবিষ্কৃত প্রায় ১২০০ টি পোড়ামাটির নিদর্শন, কয়েকটি ছাড়া যেগুলোর সবকয়টি মস্তকে সর্পযুক্ত নারীর মস্তক, মানে নাগদেবীর (মনসা?) মূর্তি। গুপ্তযুগের অতি উৎকৃষ্ট মানের শিল্পরীতিতে প্রত্যেকটি নাগদেবীর মুখাবয়ব তৈরী করেছেন সে সময়ের শিল্পীগণ। এগুলোর নির্মাণকাল তৃতীয় থেকে চতুর্থ শতাব্দী। মনসাদেবীর আদিতম মৃন্ময় নিদর্শন এগুলোই।

Manual1 Ad Code

একটা বড় রহস্য হলো, একটি মন্দিরে এতগুলো পোড়ামাটির মনসার মূর্তি কেন ও কোথায় থেকে এলো? সমগ্র বাংলায় একই ঢিবি থেকে এতগুলো মনসামূর্তি পাওয়ার কোন দৃষ্টান্ত নেই, তা-ও আবার একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে। পুণ্ড্রে নাগ উপাসনা উদ্ভবের শেকড়খানি যে অনেক গভীরে প্রোথিত সেটি সন্দেহাতীত। মঙ্গলকোট এ কথাটির একটি বড় প্রমাণ। কোন অজানিত কারণে মনসাপূজায় রাঢ় বাংলার অবদান স্বীকৃত, অপরদিকে পুণ্ড্রের এ অধ্যায়টি চর্চার বাইরে ও কালক্রমে বিস্মৃত। আরেকটি কথা বলে রাখি, মঙ্গলকোট ঢিবির আরেকটি নাম পদ্মাবতীর ধাপ। পুণ্ড্রে মনসা পূজার উদ্ভব এবং মনসামঙ্গলের সাথে এর সুগভীর সম্পর্ক অস্বীকারের সুযোগ নেই।

এ অঞ্চলে কিছু বছর আগেও বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্যমাসে একদল ভবঘুরের আবির্ভাব ঘটতো, যারা শোলা অথবা মাটির মনসা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দান আদায় করতো মনসার পূজা ও গীত আয়োজনের জন্য। গ্রামের পুকুরগুলো ভরে যেত চাঁদ সদাগরের ডিঙা দিয়ে। শোনা যেত মনসার গীত:
যত মন্দ বলে চাঁদো মনসার প্রতি।
নেতোর সাক্ষাতে গিয়া কহে পদ্মাবতী ॥
শুন হেরো বলি নেতো প্রাণের ভগিনী।
এত মন্দ বলে কত সহিব পরানি ॥
আবার তান্ত্রিক কবিরাজ বা ফকিরেরা মনসার দোহাই বা মন্ত্র দিয়ে ঝাড়ফুঁক বা চিকিৎসা করে থাকে। একটি সুনির্দিষ্ট আঞ্চলিক প্যাটার্ন ধরে এ ধরণের চর্চা পুণ্ড্রে এখনো বিদ্যমান। অনেক বছর পুণ্ড্রের পথে প্রান্তরে হেঁটে এমন কত অজানা কথা জেনেছি, কত কথা শুনেছি। এ সমস্ত লোকাচার ও ইতিহাসের উপাদানগুলো গবেষণা করলে এ অঞ্চলের ধর্ম ও কৃষ্টির নতুন একটি দিক উন্মোচিত হবে এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস। (সংক্ষেপিত)
তথ্যসূত্র:
১. মহাস্থান, মোঃ মোশারফ হোসেন ও মোঃ বাদরুল আলম
২. বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসামঙ্গল, অচিন্ত্য বিশ্বাস
ছবিঋণ: পোড়ামাটির মস্তকের ছবিগুলো বাংলাপিডিয়া থেকে নেয়া। মঙ্গলকোটের ছবিগুলোর স্বত্ব আমার।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code