ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে থাকলেও নারীরা এগিয়ে অনলাইন ব্যবসায়

প্রকাশিত: ৫:০৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১২, ২০২৫

ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে থাকলেও নারীরা এগিয়ে অনলাইন ব্যবসায়

Manual5 Ad Code

নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ১২ জানুয়ারি ২০২৫ : করোনা মহামারির সময় যখন জনজীবন চার দেয়ালে আবদ্ধ, হালিমা আফরোজ ও তার স্বামীরও মনে হয়েছিল শুধু ঘরে বসে থেকে লাভ নেই। কিছু একটা করা প্রয়োজন। শখের বশে বেকিং করে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় খাবার পাঠাতেন। তখন অনেকেই পরামর্শ দিলেন ব্যবসা শুরু করলে কেমন হয়? আর এতে ইন্টানেটকে কাজে লাগানো যেতে পারে। যেই কথা সেই কাজ! সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে পেজ চালু করে ঘরে তৈরি খাবারের অর্ডার নেওয়া শুরু হলো।

তাহুরা বানুর গল্পটা একটু অন্য রকম। ৭ বছর আগে প্রথম যখন তিনি নিজের শাড়ির ছবি ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন, ১৫ দিনেও কোনো সাড়া পাননি। এরপর নিজে শাড়িটি পরে পোস্ট করলে ভালো সাড়া পান। তাহুরার সেই অনলাইন ব্যবসা এখন অফলাইনেও আছে। বেড়েছে ব্যবসার পরিধি। তাহুরার মতো নারীদের আত্ম-নির্ভরশীল করার পথ দেখিয়েছে অনলাইন ব্যবসা। দেশে অনলাইন ব্যবসায়, বিশেষ করে গ্রামে নারীরাই এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

নওগাঁর তাহুরা বানুর সন্তানেরা একটু বড় হলে নিজেকে নিয়ে ভাবার সুযোগ পান। ফেসবুকে পেজ চালু করেন।

একটু একটু করে নিজের ব্যবসা বড় করেছেন। নওগাঁয় একটি শোরুম দেওয়ার পর এখন ঢাকাতেও তিনি কারখানাসহ শোরুম চালু করার পরিকল্পনা করছেন। তাহুরা জানান, চাকরি করে পরিবারকে সময় দেওয়া কঠিন হতো। কিন্তু নিজেকেও আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। তাই অনলাইন ব্যবসায় আসা। নিজের সুবিধামতো এখানে সময় দেওয়া যায়।

Manual2 Ad Code

মহামারি কালে রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্ধা হালিমার সেই প্রয়োজন ও শখের যাত্রা- এখন পরিবারের মূল উপার্জনখাত হিসেবে পরিণত হয়েছে। ২০২০ সালের শেষ দিকে এসে অনলাইনে খাবারের এই ব্যবসা চালু করেন তিনি। তার ভাষ্য, ‘শখের বশে শুরু হলেও এই ব্যবসার মাধ্যমেই আমার সংসার চলে। এছাড়া আমার স্বামীও একটি দুর্ঘটনায় পড়ে। তখন দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিই, অনলাইন ব্যবসাটাকেই বড় করতে হবে। খাবারের পাশাপাশি অনলাইনভিত্তিক আরও একটি উদ্যোগ আছে।’

শুধু হালিমা কিংবা তাহুরা নয়,অনলাইনে ব্যবসায় এগিয়ে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন নারীরা। যা জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড-এর চলতি বছরের আগস্ট মাসে নারীদের ই-কমার্স ব্যবসা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেখলে আরও স্পষ্ট হবে।

Manual6 Ad Code

প্রতিবেদনে বলা হয়, ই-কমার্স নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় প্রবেশকে সহজ করতে পারে। এর মাধ্যমে তারা অভিজ্ঞ হয়, বিশেষ আর্থিক যোগাযোগের ক্ষেত্রটা বড় হয়। পাশাপাশি ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক এবং বাজারের সুযোগও বাড়ে। ই-কমার্স প্রথাগত ব্যবসার চেয়ে সময়ের দিক থেকে অনেকটা সুবিধাজনক। দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব)-এর হিসেবে, ই-কমার্স খাতে নারী উদ্যোক্তা ৯ শতাংশের মতো। ই-কমার্সের বাজারে নারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ২৫ শতাংশ। তবে ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসায় নারীরা অনেক এগিয়ে।

ই-ক্যাব জানিয়েছে, দেশে ৫ লাখ ফেসবুক পেজ আছে। নিয়মিত পণ্য বিক্রি হয়, এমন ফেসবুক পেজের ৫৫ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। ই-ক্যাবের মতে, ই-কমার্স খাতের বাজার ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো। যেখানে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বাজার নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে। অনলাইন ব্যবসায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও তাদের বেশির ভাগেরই ক্ষুদ্র উদ্যোগের ব্যবসা। তাই মার্কেট শেয়ার তাদের কম। নারী উদ্যোক্তারা সাধারণত ফ্যাশন, জীবনযাপন বিষয়ক সেবা ও পণ্য এবং খাবার ভিত্তিক ব্যবসা বেশি করেন।

পারিবারিকভাবেই পোশাক খাতের ব্যবসা রয়েছে মুনিয়া জামানের। সেই ব্যবসা থেকেই প্রয়োজন বিবেচনা করে দেশীয় উপাদানে তৈরি ব্যাগের ব্র্যান্ড ‘কালিন্দী’ শুরু করেন। যাত্রার তিন বছরে অনলাইন ভিত্তিক এ ব্র্যান্ড ভালো অবস্থানে এসেছে।

Manual7 Ad Code

মুনিয়া জামান এই প্রতিবেদককে বলেন,‘করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বেই ই-কমার্স ব্যবসার প্রসার ঘটে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের অনেকেই অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসায় আগ্রহী হয়।’

অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি জানান, অনলাইনে ক্রেতাদের ৭০ শতাংশ শহর ভিত্তিক। নারী-উদ্যোক্তা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও ক্রেতা এখনো শহর কেন্দ্রিকই বেশি। তবে নারীরা ব্যবসা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পরিচালনা করেন। যা তাদের ক্রেতাদের সন্তুষ্টির অন্যতম কারণ।

সূত্র জানায়, নারী উদ্যোক্তাদের বিষয়ে দেশে এখনও সেখানে পরিসংখ্যান নির্ধারণ করা হয়নি। তবে বিভিন্ন জেলায় নারী উদ্যোক্তা ফোরাম ছোট আকারে কাজ করছে। উদ্যোক্তাদের কল্যাণে বর্তমান সরকারও বেশ ইতিবাচকভাবে কাজ করছে। মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (এমএফএস) বিকাশ-এর মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তাদের নারী মার্চেন্টের সংখ্যা প্রায় ৯ শতাংশ। তবে গ্রামে নারী মার্চেন্ট ১১ শতাংশ এবং শহরে তা সাড়ে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে ইন্টারনেটের প্রসারের কারণে নারীরা স্বল্প পুঁজি নিয়ে হলেও অনলাইন ব্যবসায় আগ্রহী হচ্ছেন। গ্রামের নারীরা সামাজিক বিধি-নিষেধের মধ্যেও ঘরে বসেই আয়ের সুযোগ তৈরি করে নিচ্ছেন।

নারীরা আগ্রহী হলেও এখনো সমাজে লিঙ্গ ভিত্তিক ডিজিটাল বৈষম্য অনেক। মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন (জিএসএমএ) চলতি বছরের মে মাসে ‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৪’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পুরুষদের ৪০ শতাংশ এবং নারীদের ২৪ শতাংশ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কিন্তু ৫০ শতাংশ নারী ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে জানেন। কিন্তু পুরুষদের চেয়ে নারীরা ইন্টারনেট ব্যবহারে বেশি আগ্রহী।

Manual6 Ad Code

আঙ্কটাডও তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ডিজিটাল লিঙ্গ-বৈষম্য, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এবং সমাজে প্রচলিত ধারণা নারীদের ই-কমার্সে প্রবেশ এবং অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে। বাধাগুলো দূর করতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ দেখা যায়। সম্প্রতি দেশের শীর্ষ মুঠোফোন অপারেটর গ্রামীণফোন গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেট বিষয়ে জ্ঞান বাড়াতে এবং দক্ষ করে তুলতে সারাদেশে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ নামে উঠান বৈঠক আয়োজন করেছে।

গ্রামীণফোনের এই প্রচারাভিযানের লক্ষ্য হচ্ছে সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নারীদের মধ্যে ইন্টারনেট বিষয়ে শিক্ষা ও সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। যাতে গ্রামীণ নারীরা ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার মাধ্যমে জীবনের চলার পথে ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারেন।

সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন (জিএসএমএ) বলছে, দেশের ৪০ শতাংশ পুরুষ ও ২৪ শতাংশ নারী মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এ হার ভারতে ৫৩ শতাংশ ও ৩৭ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬৯ শতাংশ ও ৬৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৩ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ। আর এটা শুধু বাংলাদেশেই নয় জিএসএমএ-এর হিসাব মতে, নিম্ন ও মধ্যমআয়ের দেশগুলোয় মোবাইল ফোনের মালিকানায় নারীরা পিছিয়ে আছেন। বিশেষ করে অস্বচ্ছল,পড়াশোনা না জানা, গ্রামাঞ্চলে বসবাস করা বা বিশেষভাবে সক্ষম নারীরা আরো বেশি পিছিয়ে আছেন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code