অন্যের হাত রাঙিয়ে নিজের জীবনে রঙ ফিরিয়ে এনেছেন তাজিয়া তিথি

প্রকাশিত: ২:০৯ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫

অন্যের হাত রাঙিয়ে নিজের জীবনে রঙ ফিরিয়ে এনেছেন তাজিয়া তিথি

Manual7 Ad Code

আবদুস সালাম আজাদ জুয়েল | চাঁদপুর, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ : জীবন চলার পথে বারবার দিশা হারিয়েছেন। অল্প বয়সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়েছেন। লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। বারবার জীবনের রঙ ফিকে হয়ে এসেছে। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিথি। অন্যের হাত রাঙিয়েই যেন নিজের জীবনের রঙ ফিরিয়ে এনেছেন তরুণ উদ্যোক্তা তাজিয়া রাব্বি তিথি (২৬)।

জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা পর্ব ইউনিয়ন এর মূলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা চাকরিজীবী আবুল খায়ের (৫৮) ও গৃহিনী জেসমিন বেগম (৫০) দম্পতির কন্যা তাজিয়া রাব্বি তিথি। মুলপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং মূলপাড়া সামছুদ্দিন খান কারিগরি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে চাঁদপুর সরকারি কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। দুই ভাইবোনের মধ্যে তিথি ছোট। বড় ভাই হাসান সবুজ (৩০) বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন।

Manual3 Ad Code

মাধ্যমিক পাসের পরে তিথিকে বাবা-মা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মধ্যবয়সি এক প্রবাসীর সাথে বিয়ে দেন। আশা ছিলো মেয়ে সুখী হবে। কিন্তু বিয়ের কয়েকদিন পরেই বুঝতে পারেন স্বামীর বিভিন্ন চারিত্রিক সমস্যা আছে। বিষয়গুলো পারিবারিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হন। এরই মধ্যে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। তাই স্বামীর হাতে বার বার নির্যাতনের শিকার হয়েও সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক বছর মুখ বুজে সংসার করেন। একসময় তাও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে বিবাহবিচ্ছেদে বাধ্য হন। শিশু পুত্রসহ চলে আসেন বাবার বাড়ি। সেই থেকে চেষ্টা চালান স্বাবলম্বী হওয়ার। অন্যের হাতে মেহেদী পড়িয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। পাশাপাশি হ্যান্ড পেইন্ট, টোট ব্যাগ, বিভিন্ন কোম্পানির লোগো, শাড়ী, পাঞ্জাবি, হিজাবে হাতের কাজ করেন।

আলাপকালে তিথি বলেন, ‘বিয়ের পর আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি বিয়ের দুই বছর পরে গোপনে কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা চালু রেখেছি। বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পড়েছি। ২০২০ সালে এইসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনে স্বামীর হাতে মার খেয়ে আমাকে পরীক্ষার কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। কিন্তু আমি দমে যাইনি, আমি পড়তে চেয়েছি এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি।’

Manual8 Ad Code

তিনি বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদের পরপরই আমি নিজে কিছু করার কথা ভাবি। আগে থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অন্যের হাতে মেহেদী লাগাতাম। সেটা ছিলো শখ। কিন্তু এবার আমি এটাকে আমার পেশা হিসেবে গ্রহণ করি।

পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলেও নিজেকে সময়োপযোগী করার জন্য ইউটিউব ভিডিও দেখেও কাজ শিখেছেন। ২০২২ সালে নারীদের উদ্যোক্তা সংগঠন ‘চাঁদপুর বিজয়ী’ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মেহেদী আর্টিস্ট হিসেবে একটি ফেসবুক পেজ খোলেন। পেজের নাম দেন ‘তাজিয়াস গ্যালারি এ্যান্ড মেহেদী বাই তাজিয়া’ পেজ লিংক: https://www.facebook.com/share/1FsbXMBTHf/ ।

Manual3 Ad Code

তিথি বলেন, এই পেজ তৈরি করতে আমার বড় ভাই এর কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে কিছু মেহেদী কিনি এবং সেগুলো দিয়ে কয়েকটি কাজের ছবি পোস্ট করি। সেগুলো দেখে মানুষজন আগ্রহ প্রকাশ করে ।

তিনি বলেন, প্রথম কাজের হ্যান্ডপেইন্ট এর একটি শাড়ী, একটি পাঞ্জাবি ১৫০০ টাকায় বিক্রি করি ভোলায় একজনের কাছে। এগুলো আমি চাঁদপুর থেকে কুরিয়ার করে পাঠাই। তারা খুব প্রশংসা করে আমার কাজের। এরপর একই সময়ে আমি আরো ৩৫০০ টাকার অর্ডার পাই। সেই মাসে আমার ৪৮০০ টাকা আয় হয়। সেই যে শুরু করি এখনো করছি, তবে এখন আমার কাজের পরিধি অনেক বেড়েছে। মানুষের ভালোবাসাও বেড়েছে।

তিথি আরো বলেন, আমি বিভিন্ন উৎসবে বেশি অর্ডার পাই। তখন এলাকা থেকে লোকজনের সহায়তা নিতে হয় সহকারী হিসেবে। তাদের আমি পারিশ্রমিকও দেই। এখন আমার গড় মাসিক আয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। তবে বিভিন্ন উৎসবের সময় তা আরো বেড়ে যায়। এই টাকা থেকে গত ১ বছর ধরে আমি একটি ৫ হাজার টাকা মাসিক সঞ্চয় করি ছেলের ভবিষ্যতের জন্য।

প্রথম স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হয় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। এরপর ২০২৩ সালে আবার পারিবারিক ভাবেই বিয়ে করেন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ইমরান তাহিরকে (২৭)। চাঁদপুরে বাবার বাড়ির পাশে একটি ভাড়া বাড়িতে স্বামী ও প্রথম সংসারের পুত্র ইসমাইল হোসেন (৭) কে নিয়ে তিথির বর্তমান সংসার। ইসমাইল মুলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।

তাজিয়ার মা জেসমিন বেগম বলেন, আমার মেয়েকে ছোট বয়সে বিয়ে দেয়া ভূল সিদ্ধান্ত ছিল। যার ফল আমাদের ৭ বছর ধরে টানতে হয়েছে। এখন আমার মেয়ে মেহেদী লাগিয়ে ও হাতের কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। তার সফলতা দেখে আমরা সবাই খুশি। আমি চাই আমার মেয়ের মত তরুণ প্রজন্মের মেয়েরা স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য নিজ নিজ দক্ষতা দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক।

নারীদের উদ্যোক্তা সংগঠন ‘বিজয়ী’র প্রতিষ্ঠাতা তানিয়া ইশতিয়াক খান বলেন, তাজিয়া রাব্বি তিথি একজন সংগ্রামী নারী। তার জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। সে আমাদের সংগঠনের দেয়া প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। জেলায় তিথির মত হাজারো নারীর জীবন বদলাতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

Manual6 Ad Code

তিথির স্বামী ইমরান তাহির নিজেও পেশায় ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, আমাদের বিয়ের আগে থেকেই তিথি উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছে। তার হাতের মেহেদীর ও হাতের কাজগুলো খুব চমৎকার। তার কাজের মান ভালো হওয়ায় সে দ্রুত উন্নতি করেছে। তার এই কাজে আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আমি তার আরো সাফল্য কামনা করি।

জীবনে সাফল্য আসলেও প্রথম জীবনের ক্ষত এখনো নাড়া দেয় তিথিকে। যেন একটা দু:স্বপ্ন মাঝে মাঝেই হানা দেয়। তিথি বলেন, ‘আমি একসময় ভাবতাম আমার বিচ্ছেদের কারণে আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। মানুষের অনেক বাজে কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু এখন আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আমার কাজ দেখে আমার এলাকার ছাত্র-ছাত্রী ও বেকার তরুণিরাও উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তারাও নিজেরা কিছু কিছু আয় করছে। এটা দেখে আমার খুব ভালো লাগে। মেয়েরা যদি স্বাবলম্বী হয় তাহলে আর স্বামীর সংসারে বোঝা হতে হবে না।

মেহেদি আঁকার পাশাপাশি হ্যান্ড পেইন্টের কাজ করলেও ‘মেহেদি আর্টিস্ট’ হিসেবেই পরিচিতি পেতে চান তিথি। তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন সবাই আমাকে মেহেদি আর্টিস্ট নামে চিনুক।’

ভবিষ্যতে কাজের পরিচিতি ও পরিধি বাড়ানোর জন্য নিজেই একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার স্বপ্ন দেখছেন তিথি। তিনি বলেন, আমি চাই আমার এই ধরনের কাজে অনভিজ্ঞরাও আসুক। আমি তাদের সবরকম সহায়তা করবো। আমরা দেশে অর্থনৈতিক গতি আনতে কাজ করতে চাই। সরকারের সহযোগিতা পেলে আমার কাজগুলো নিয়ে দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হতে চাই।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code