বাঙালির সংস্কৃতি বহুত্ববাদী

প্রকাশিত: ১২:৩১ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৩, ২০২৫

বাঙালির সংস্কৃতি বহুত্ববাদী

Manual5 Ad Code

ড. মাসুদুজ্জামান |

বাঙালি সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। পৃথিবীতে এরকম সমৃদ্ধ সংস্কৃতি খুব কমই আছে। বাঙালির সংস্কৃতি মূলত বহুত্ববাদী বা বহুমুখী সংস্কৃতি। বহু জাতি, বহু ধর্ম, বহু সম্প্রদায়, বহু নৃগোষ্ঠী, বহু ভাষা এর সঙ্গে মিলেমিশে আছে বলেই আমরা এর বহুমুখী চমৎকার প্রকাশ লক্ষ করি। এককথায় বললে, বাঙালি সংস্কৃতি হচ্ছে মিশ্র সংস্কৃতি। এটাই এর সৌন্দর্য।

ঐতিহাসিক কাল থেকে যদি দেখি, এখানকার আদি বাশিন্দারা ছিলেন নিম্নবর্গের মানুষ। পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার মানুষের মতোই এই আদিম মানুষদের – যারা বাঙালিদের পূর্বসুরি – কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্ম ছিল না। কারণ, তখনও আধুনিক কোনো ধর্মের আবির্ভাব পৃথিবীতে ঘটেনি। পরে এদেরই একটা বড় অংশ প্রথমে বৌদ্ধ এবং আরও পরে আরেকটা অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কীভাবে এটা ঘটেছিল, কীভাবে এই অঞ্চলের নিম্নবর্গের মানুষেরা নানান ধর্মের অধীনে এসেছিলেন, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব সম্পর্কে চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন আকবর আলী খান ও আহমদ শরীফ।

Manual4 Ad Code

বাংলাদেশের সংস্কৃতির সমৃদ্ধ হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৃতি এত বিচিত্র আর এত দ্রুত রূপ বদল করে যে, এখানে যা কিছু পুরাতন তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারে না। যেমন ঋতু-পরিক্রমের কথাই বলি। এদেশে বার মাসে ছয়-ছয়টা ঋতু। মরু-অঞ্চলে একটাই ঋতু – গ্রীষ্ম। ইউরোপে শীত জাঁকিয়ে বসে থাকে প্রায় নয় মাস, গ্রীষ্ম-বসন্তের আয়ু মাত্র তিন-চার মাসের। ঋতু সেই দুটি। কিন্তু বাংলাদেশে ঘন ঘন ঋতু পরিবর্তনের কারণে গাছ-লতা-গুল্ম নিত্য নবীন হয়ে ওঠে। সৃষ্টির মধ্যে সবসময়ই নতুনের আবির্ভাব ঘটে। এই নতুনত্বের প্রভাবে মানুষের মনও সজীব হয়ে ওঠে। তার জীবনে জাগে আনন্দ। এই যে নব নব লীলার প্রকাশ, এর সবই হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির ঐশ্বর্য, বৈভব – ‘নব নবরে নিতুই নব নব’।

বাঙালি সবসময় তাই তার জীবনকে বিচিত্র রাগিনীতে ভরিয়ে তোলে, সেই নতুনকে সাদরে বরণ করে নেয়। আর বরণ মানেই তো উদযাপন। এই উদযাপনেরও আছে বিচিত্র প্রকাশ। এরই অংশ হিসেবে বাঙালিরা নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষকে বরণ করবার ঐতিহ্য এভাবেই চলে আসছে আমাদের এই জনপদ ও জনজীবনে। বাঙালি জানে জীবনকে কীভাবে উপভোগ করতে হয়।

আজ বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে বছরের শেষ দিন, অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি। ঋতুরাজ বসন্তেরও শেষ দিন। লক্ষণীয়, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে উৎসবও। বসন্তে ছিল বসন্ত উৎসব, এবার হবে নববর্ষকে বরণ করে নেয়ার উৎসব। বাংলা সনটি শেষ রাগিনীর বিষাদ বিধুর সুর আর আসন্ন নববর্ষের আনন্দগীতে ভরে উঠবে। আবার ঋতুচক্রের পরিক্রমায় শুরু হবে গ্রীষ্মকাল। কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তি পালন করা হয় পুরানো বছরকে শুধু বিদায় জানাবার জন্য নয়, বরং আগের বছরের সঙ্গে পরের বছরের যোগসূত্র রচনা করবার জন্য। কী চমৎকার ভাবনা। দিনটি পালিত হবে মানুষের শরীর ও প্রকৃতির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের লক্ষ্যে। প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে পাওয়া মৌসুমী শাক-সব্জি কুড়িয়ে এনে পাতা-মুড়া ইত্যাদি খেয়ে চৈত্র সংক্রান্তি পালনের রীতি এদেশের মানুষ – ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে – পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই ধরিত্রী, এই প্রকৃতি, তার সহজ-সরল জীবনযাপনই মানুষকে এটা শিখিয়েছে। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগ নেই। যোগ আছে প্রাকৃত জীবনের। নও-মুসলমানরা এই ইতিহাস জানেন না। তারা যা কিছু শিখেছেন, তা শুধু পশ্চিম এশিয়ার মরু-অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে পাওয়া। ধর্মের নামে তারা জানেন না বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির শিকড়টা কোথায়।
ঢাকাসহ সারা দেশে, সমস্ত বাঙালি জনপদে, সাধারণ মানুষ আজ চৈত্র সংক্রান্তি পালন করবে, সেই সঙ্গে প্রস্তুতিও চলবে নববর্ষ বরণের।

Manual7 Ad Code

রাত পোহালেই গাজনের উৎসবে গ্রাম বাংলা উদ্বেল হয়ে উঠবে। এই উৎসব মূলত হাড়ি, বাগদি, বাউড়ি, ডোম, মুচি প্রভৃতি ‘নিম্নবর্ণের’ মানুষের উৎসব। এরা কারা? এরাই তো আমাদের এখানকার আদি বাশিন্দা। এরাই তো বাঙালি মুসলমানের পূর্বপুরুষ। নৃতত্ব আমাদের সেকথাই বলে। এই নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সদগোপ প্রভৃতি শ্রেণিও এই উৎসবে সক্রিয়ভাবে যোগ দেবে।
কিন্তু ‘ধর্মান্তরিত’ বাঙালি মুসলমান? তারা কি বাদ পড়বেন? না, নিজের ঐতিহ্য থেকে তো মানুষ বিচ্যুত হতে পারে না। তাদের পূর্ব-পুরুষেরা যে উৎসব পালন করে এসেছেন, তারাও সেই ধারাবাহিকতায় পালন করবেন চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব। অন্তত সেটাই চলে আসছে বহুকাল ধরে। চৈত্র সংক্রান্তি এখন তাই সর্বধর্মের, সর্বশ্রেণির মানুষের উৎসব। এই উৎসবের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে প্রাকৃত জীবন ও প্রকৃতির। এরই প্রভাবে নববর্ষ উদযাপন করে সব ধর্মের বাঙালিরা। ‘হালখাতা’র ঐতিহ্য এভাবেই এখনও বহমান রয়েছে। যা কিছু পুরাতন, যা কিছু জীর্ণ, ক্লিষ্ট করেছে বিগত দিনগুলোকে, তাকে অতিক্রম করে ঐশ্বর্য়মণ্ডিত দিনের আশায় বাঙালি বরণ করবে নতুন বছরকে। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হচ্ছে এরই প্রতীকী বরণোৎসব।

Manual5 Ad Code

মহাকাল আদি-অন্তহীন। এক একটা দিন, মাস, বছর ক্রমশ মহাকালের গহ্বরে বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু মানুষের দৃষ্টি থাকে ভবিষ্যতের দিকে। আগামীকালের নতুন সূর্য কী নতুন বার্তা বয়ে আনবে, তারই অপেক্ষায় থাকে মানুষ। নববর্ষের এটাই হচ্ছে দার্শনিক দিক, জীবনের সঙ্গে যার গভীর সম্পর্ক। ধর্মের সঙ্গে নয়। কাজেই যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী, তাদের এই উৎসব পালনের জন্যে দ্বিধা থাকার কোনো কারণ নেই। চৈত্র সংক্রান্তিই বলি আর নববর্ষ, এই উৎসব বাঙালির উৎসব, এই অঞ্চলের মানুষের যুগ যুগ ধরে পালিত উৎসব। আসুন, আমরা উৎসব পালন করি। বরণ করে নিই নতুন আরেকটি বছরকে।

আমি এ উপলক্ষে সবাইকে চৈত্র সংক্রান্তি আর নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। মঙ্গল হোক সবার।

#
ড. মাসুদুজ্জামান

Manual7 Ad Code

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code