সংস্কারের দায়িত্ব সরকারকে কে দিল?

প্রকাশিত: ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ, মে ৩০, ২০২৫

সংস্কারের দায়িত্ব সরকারকে কে দিল?

Manual6 Ad Code

বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ৩০ মে ২০২৫ : একদিকে সচিবালয়ে অস্থিরতায় দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনের কাজে নেমে আসে স্থবিরতা। অন্যদিকে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে বেশ কদিন বন্ধ ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রম। এই দুটি ক্ষেত্রের আন্দোলনের কোনোটাই ‘ষড়যন্ত্র’ না, বরং সরকার সৃষ্ট। আইএমএফের টাকা পেতে সরকার তাদের শর্ত অনুযায়ী এনবিআর বিভক্তির সিদ্ধান্ত নেয়।

আন্দোলনের মুখে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সরকার এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করলেও অস্থিরতা এখনো কাটেনি।
আর সচিবালয়ের সিদ্ধান্ত রীতিমতো গায়ে পড়ে ঝগড়া করার মতো। সরকারের একটি মহল সচিবালয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করতেই যেন এমন কাজ করেছে। হঠাৎ করে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ (সংশোধন) ২০২৫ কেন করতে হবে? দেশজুড়ে যখন এমনিতেই অস্থিরতা, আন্দোলন, বিশৃঙ্খলা চলছে, তখন সরকারকে এই অধ্যাদেশ কেন জারি করতে হবে? বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা নিজেই যেখানে বলেছেন, ‘দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি চলছে।

’তাহলে এই বিপত্তি সেধে আমন্ত্রণ জানানোর কোনো দরকার ছিল কি?

Manual5 Ad Code

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে সরকার গঠিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল দেশের অরাজক ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। নতুন করে কোনো ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারী শক্তি যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেইদিকে মনোযোগ দেওয়া।

সে জন্য দরকার নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার ও তদন্ত সাপেক্ষে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচন করা।

যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই সরকারের প্রধান কাজ তিনটি— প্রথমত, জুলাই গণহত্যার বিচার, মৌলিক রাষ্ট্র সংস্কার এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।

অধিকাংশ রাজনৈতিক দল প্রত্যাশা করেছিল, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার শেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে ও সংবিধানের চার মূলনীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রকাঠামো পরিচালনা করবে।

Manual6 Ad Code

জনগণকে সম্পৃক্ত করে এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, যে বাংলাদেশে নতুন করে কোনো স্বৈরতন্ত্রের জন্ম হবে না। মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করা হবে না। একটি স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির মধ্য দিয়ে দেশ পরিচালিত হবে। কিন্তু এই সরকার দায়িত্বের বাইরে গিয়ে অনেক কাজ করে যেন জটিলতা বাড়াচ্ছে। কেন?
দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করে। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে এসব কমিশন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদনগুলো নিয়ে এখন চলছে আলোচনা। তবে এতগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করা অপ্রয়োজনীয় ছিল। এটি সময় নষ্ট ও অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু না। মোটা দাগে একটি বিষয় সংস্কার করে নির্বাচনের দিকে যাওয়া যেত অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন সংস্কার। এটি সংস্কারের মাধ্যমেই আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে যেতে পারতাম। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কার, সংবিধান সংস্কার, নারী সংস্কার, গণমাধ্যম সংস্কার, জনপ্রশাসন সংস্কারসহ মৌলিক সংস্কার ইত্যাদি স্পর্শকাতর বিষয়ে হাত দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে। ওই বিতর্ক এখনো অব্যাহত আছে। প্রশ্ন হলো, অন্তর্বর্তী সরকার কেন রাষ্ট্র সংস্কার, সংবিধান সংস্কার, নারী সংস্কার, গণমাধ্যম সংস্কার, জনপ্রশাসন সংস্কার করবে? এই ম্যান্ডেট তো তাদের নেই।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যতগুলো বিষয়ে একমত হবে, ততগুলো বিষয় নিয়ে একটি সনদ তৈরি করে নির্বাচনের দিকে যাওয়া। যদি রাজনৈতিক দলগুলো বেশি বিষয়ে একমত হয়, তাহলে আগামী বছরের জুনে, আর যদি কম বিষয়ে একমত হয় তাহলে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা হবে।’ অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব একদম সুনির্দিষ্ট। তারা নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার প্রস্তাব করবে। যেন গণতান্ত্রিক সরকার ঐকমত্যের ভিত্তিতে তারা একটি নির্বাচন করবে। ফলে এই সরকারের অন্য কোনো কাজ করা উচিত না, করার এখতিয়ারও তাদের নেই। কিন্তু অযাচিতভাবে সরকার যেমন রাষ্ট্র সংস্কারের কিছু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে হাত দিচ্ছে, ঠিক তেমনি এমন কিছু বিতর্কিত আইন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যেটি দেশকে একটি অনিবার্য অস্থিরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তার সর্বশেষ উদাহরণ সচিবালয়ে বিক্ষোভ।

সরকার হঠাৎ করে সরকারি চাকরি সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫ তৈরি করেছে। এই আইনকে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘নিবর্তনমূলক’ এবং ‘কালাকানুন’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। এ নিয়ে সচিবালয়ে চলছে উত্তেজনা। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের ব্যানারে তাঁরা নতুন করে আন্দোলন তৈরি করছেন। গত ২২ মে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ সংশোধন করে সরকারি চাকরি সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া অনুমোদনের পর গত রবিবার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। কর্মচারীদের অভিযোগ, সাড়ে চার দশক আগের বিশেষ বিধানের কিছু নিবর্তনমূলক ধারা এখানে সংযোজন করা হয়েছে। আন্দোলনকারী কর্মচারীরা অধ্যাদেশটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। এই আইনের মধ্যে বেশ কিছু বিধান আছে, যেখানে একজন সরকারি কর্মচারীকে সহজেই চাকরিচ্যুত করা যাবে, বিনা কারণে কর্মস্থলে অনুপস্থিতি বা অন্য কিছু অপরাধের কারণে তাঁকে সহজে চাকরিচ্যুতি করার বিধান রয়েছে।

এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের চারটি বিষয়ে অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো—সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে; অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন; অন্য যেকোনো কর্মচারীকে তাঁর কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তাঁর কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন; এবং যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে তাঁর কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন।

এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলা হয়েছে, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে। এই আইনটি যৌক্তিক কি অযৌক্তিক সেটি পরের বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে এ রকম একটি আইন করতে হবে কেন? এই আইন করা কি খুব জরুরি ছিল? এ সময় এই আইনটি করে সরকার কেন অস্থিরতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করল?

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার পর দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’ কিন্তু সাধারণ মানুষ মনে করে, সরকারের ভেতরের কিছু ব্যক্তির বাড়াবাড়ি, ভুল পদক্ষেপের কারণে উসকানিমূলক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

Manual1 Ad Code

সরকারকে কেন রাখাইন করিডর নিয়ে কথা বলতে হবে? সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার সিদ্ধান্ত কিংবা পলিথিন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত—কোনোটাই এই সরকারের কর্মপরিধির মধ্যে পড়ে না। এ ধরনের বহু সিদ্ধান্ত নানা ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। সরকার নানা ধরনের বিতর্কে নিজেদের জড়াচ্ছে কেন? এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি রাষ্ট্রের সব বিষয়ে নাক গলাতে চায়, সেটি বিপর্যয় ডেকে আনতে বাধ্য। এই সময় যতগুলো আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে আমরা যদি তা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব, এর বড় অংশ হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত এবং কালক্ষেপণের কারণে। তাহলে কি অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে এমন কেউ আছেন, যাঁরা ইচ্ছা করে দেশে হানাহানি, আন্দোলন এবং বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন? এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চাইছেন?

Manual2 Ad Code

অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ার সুনির্দিষ্ট, শুধু একটি কাজ করার জন্য। এই কাজের বাইরে মৌলিক নীতিনির্ধারণী কাজ করে যদি পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারে, তাহলে এর দায় এই সরকারকেই নিতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিচক্ষণ এবং বিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি জানেন, রাজনৈতিক দলগুলোই তাঁর একমাত্র শক্তি। নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে না স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code