নাটক ও নাট্যকলা: দীর্ঘ পথ চলা

প্রকাশিত: ১:৩১ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০২০

নাটক ও নাট্যকলা: দীর্ঘ পথ চলা

Manual1 Ad Code

|| রাহমান চৌধুরী || ২০ জুলাই ২০২০ : নাট্যকলা সমন্বিত একটি শিল্পমাধ্যম। সারা পৃথিবী জুড়েই রয়েছে এর ব্যাপক অস্তিত্ব ও জনপ্রিয়তা। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম শিল্প মাধ্যমগুলোর একটি নাটক, ধর্ম আর দেবতাদের ঘিরে এই নাটকের উৎপত্তি এবং তারপর নানা পথে তার বিকাশ। সেই বিকাশের রয়েছে নানাধাপ, নানা প্রকৃতি। নাট্যচর্চার আদিপর্বে নাটক ছিলো লোকবৃত্তের অধীন, রাজতন্ত্রের যুগে নাট্য প্রযোজনা হলো উচ্চবর্গের অধিপতি সংস্কৃতির অধীন। প্রাচীন গ্রীসের গণতন্ত্রের যুগেই সৃষ্টি হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ট্র্যাজেডি বা শোকগাথাসমূহের। নাট্যকলার উপর তারপর দীর্ঘদিনের জন্য চার্চের খড়গ নেমে এলো এবং ইউরোপে নাটক বহুদিন থাকলো গীর্জা বা খ্রীস্টধর্মের নিয়ন্ত্রণে। মহাকাব্যের যুগে মানুষই ছিল প্রধান বিষয়। কিন্তু মধ্যযুগে শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করেছে ধর্ম। এই প্রথম শিল্পকে তার নিজস্ব গতি থেকে বিকৃত করে চার্চ বা পুরোহিতের ইচ্ছার দাসরূপে পরিণত করা হলো। ফলে মধ্যযুগের শিল্প জীবন থেকে সরে এসে ক্রমে স্বর্গীয় ধারণার বাহক হলো মাত্র। ভাববাদী সব অলৌকিক ধারণার প্রচার শুরু হলো নাটকে। ইতালীয় রেনেসাঁর পর নাটকে মানবিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেল। বীরগাথা হয়ে দাঁড়ালো নাটকের বিষয়বস্তু। ধনতন্ত্রের প্রথম যুগে নাটকে যেমন যুক্তিবাদের অবতারণা করা হলো, তেমনি তা ব্যক্তিত্ববাদের পক্ষে দাঁড়ালো। ধনতন্ত্রেরই আর একটি পর্বে বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে ঘিরে নাটক হতে চাইলো দৈনন্দিনের ঘটনা। ধনতন্ত্রের চূড়ান্ত বিকাশের পর্বেই নাট্যকলাকে করার চেষ্টা হলো পণ্য-সংস্কৃতির অধীন। যেহেতু ধনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই ছিল গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশের পূর্বশর্ত, তাই এই কালেই আবার নাট্য হলো মুক্ত স্বাধীন।

Manual4 Ad Code

মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে, রাজতন্ত্র ও ধর্মের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ফরাসী বিপ্লব এবং পরবর্তীকালে প্যারিস কমিউন গঠনের মধ্য দিয়ে সাধারণ নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটলো নাট্যরচনা ও প্রযোজনায়। শিল্পের ইতিহাসে আদিম সমাজব্যবস্থার পরে এই প্রথম ব্যক্তি নয়, সমবেত মানুষ শিল্পের নায়ক হলো। যে শ্রম থেকে শিল্পের সৃষ্টি, সেই শ্রমদানকারী শ্রমিকরা নায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলো। নাট্যকলা হয়ে উঠলো সর্বশ্রেণীর মানুষের। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নাটক সরাসরি শ্রমিকশ্রেণীর কথা বলতে থাকলো। প্রচার করতে থাকলো শ্রেণীসংগ্রামের কথা। মার্কসবাদের আদর্শ গ্রহণ করে নাটক সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করলো। পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ নাট্যপরিচালক ও একজন শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের জন্ম বিশ শতকের রাজনৈতিক নাট্যরীতির উন্মেষ লগ্নে। সেই নাট্যপরিচালক হলেন রাজনৈতিক নাট্যপ্রযোজনার প্রতিষ্ঠাতা এরভিন পিসকাটর আর নাট্যকার হলেন মহাকাব্যিক নাট্যরীতির দার্শনিক বের্টোল্ট ব্রেশ্ট। ব্রেশ্টের মহাকাব্যিক নাট্যরীতির তত্ত্ব সারা পৃথিবীতে সাড়া জাগিয়েছিল এবং বলাবাহুল্য য়্যারিস্টটলের ‘কাব্যতত্ত্ব’-রচনার পর পৃথিবীর নাট্যতত্ত্বের ইতিহাসে এমন সাড়া জাগানো ঘটনা আর ঘটেনি।

নাট্য ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখা যায় তা কয়েকটি পাণ্ডুলিপির ইতিহাস নয় বরং নাটক হলো “নাটকীয় সত্য” সম্বন্ধে দীর্ঘ এক ধারাবাহিকতা, যার মূল দিকটিতে আছে নাট্য প্রযোজনার ইতিহাস। নাট্যকলার ক্ষেত্রে নাটকীয় সত্য হলো কোনো বিশেষ যুগের সঠিক এবং যথার্থ ইতিহাস। রাষ্ট্র সভ্যতার ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকেই নাট্যকলার অস্তিত্ব ছিল। নাট্যকলা অমর তার কারণ এ নয় যে তার মৃত্যু নেই, তার কারণ বরং প্রতি মুহূর্তে তার নবজন্ম হচ্ছে জীবনকে ব্যাখ্যা করার জন্য। বিভিন্ন শিল্প মাধ্যম থেকে নাটকের পার্থক্য হলো, নাটক প্রতিবার অভিনয়ের মাধ্যমে নতুনভাবে সৃষ্টি হয়। নাট্যকলাকে বেঁচে থাকার জন্য প্রতি যুগেই এমন ভঙ্গি আয়ত্ত করতে হয়েছে যা ছিল সময়োপযোগী। নাট্য বা নাটককে মঞ্চের নানা কৌশল যেমন আয়ত্ত করতে হয়েছে তেমনি জীবন সম্পর্কে বারবার পাল্টাতে হয়েছে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। নাটক তাই নানা সময়ে নানা বার্তা বয়ে এনেছে। সেই কারণেই নাট্যকারের রচনাকে বারবার সময়ের সাথে পাল্টে নিয়েছেন বহু নির্দেশক, আবার নাট্যকারের রচনাকে পুনঃনির্মাণ করেছেন অনেকে। বহুজন শুধু পুরানো আখ্যানটাকেই নিয়েছেন; সেই আখ্যানের ভিতর নতুন সংলাপ, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি জুড়ে দিয়ে নতুন বিষয়বস্তু গড়ে তুলেছেন দর্শন প্রচারের লক্ষ্যে। নাটক ও নাট্যকলা এভাবেই বিচিত্রপথে এগিয়ে গেছে গত তিন হাজার বছর ধরে।

শিল্পের অন্যান্য শাখার মতোই নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে নাট্যকলার। নাট্যকলার প্রয়োজনেই ক্রমশ তৈরি হয়েছে মঞ্চ। মঞ্চ যখন আবার বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে এলো সে আবার নিজেই নাটক রচনায়, নাট্য প্রয়োগে প্রভাব ফেলেছে। নাট্যকলার ইতিহাস মানেই তাই নাটক এবং রঙ্গালয় এই উভয়ের ইতিহাস। নাটক সেখানে সাহিত্য বটে। পৃথিবীর প্রথম সাহিত্যগুলির একটি। ফলে নাটকের সাহিত্যমান রক্ষা কথাটি প্রথম থেকেই উচ্চারিত হয়েছে নাট্য মঞ্চায়নের পাশাপাশি। নাটককে অবশ্যই নাট্যসাহিত্য হয়ে উঠতে হবে। নাট্য শব্দটির একটি বিস্তৃত পটভূমি আছে। বহু বিচিত্র ভঙ্গি নিয়ে নাট্যসাহিত্য এবং নাট্যকলা বারবার নতুন করে আবির্ভূত হয়েছে। ফলত মানুষের ধর্মবিশ্বাস, নীতিবোধ, সামাজিক-রীতি ও অনুষ্ঠান, জীবনকে গ্রহণ করার ভঙ্গি; সব মিলিয়ে এর যে পরিমণ্ডল তা পরিবেশ নিরপেক্ষ কোনো শূন্যতায় বেড়ে ওঠে না। সমাজের একজন ব্যক্তির এবং একটি গোষ্ঠীর ধর্মান্ধতা বা প্রগতিশীলতা, তার সমাজচিন্তা, তার বিদ্রোহ সবকিছুই প্রকাশ হতে চায় নাটকে বা নাট্যশিল্পে। সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন পুরানো সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে পড়লে নতুন সামাজিক সম্পর্ক জায়গা দখল করে, নাটকের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনি সামাজিক পরিবর্তনগুলোর সাথে সাথে নাটককে পুরানো ভঙ্গি ছেড়ে নতুন ভঙ্গির আশ্রয় নিতে হয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে তাই নাট্যকলাকে জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রয়োগের ভঙ্গি পাল্টাতে হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে নাট্ক রচনার ধারা পাল্টেছে, নাট্যকলা সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলেছে। নাটক বহু ক্ষেত্রেই বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছে। দার্শনিকরা মনে করেন, নাটককে বিপ্লবী ভূমিকা নেবার জন্য প্রথম নাটক হয়ে উঠতে হবে। নাট্যগুণ বাদ দিয়ে নাটক কখনো সস্তা বুলি বা শ্লোগান হয়ে দাঁড়াবে না।

Manual2 Ad Code

প্রচীনকাল, মধ্যযুগ এবং এই আধুনিককালেও নাটক সম্পর্কে সাধারণ ধারণা একই; নাটককে হতে হবে শিক্ষার বাহন। বহু জন আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, নাটক হবে মানুষের সচেতনভাবে গড়ে উঠবার অস্ত্র। সমাজের শোষণ-বঞ্চনা, সামন্তযুগ ও ধনতন্ত্রের বর্বরতা, সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন, কৃষক-মজদুরদের ওপর মালিকদের অত্যাচার, গণতন্ত্রকে হত্যা; এসবের বিরুদ্ধে নাটকেই প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নাটক নির্যাতিতের পক্ষ অবলম্বন করেছে। নাটক এমন এক শক্তিশালী মাধ্যম যা নিয়ে প্লেটো, য়্যারিস্টটল থেকে শুরু করে রুশো, ভলতেয়ার, দিদেরো, ম্যাকিয়াভেলি, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও সবাই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। উৎপল দত্তের একটি রচনায় দেখা যায়, নাটক যে কীভাবে জনগণকে মুগ্ধ করে এবং প্রভাবিত করে নাটকের সে শক্তি সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে লণ্ডনের টনব্রিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষক পাদ্রী জন স্টকউড ক্ষেপে গিয়ে নাটক বন্ধ করে দেবার জন্য যে যুক্তি তুলেছিলেন তাহলো; গির্জায় একঘণ্টা ধরে ঘণ্টাধ্বনি করলে যদি একশত লোক প্রার্থনা সভায় আসে, তাহলে এইসব নোংরা নাটকের তূর্যধ্বনি শোনা মাত্র কি হাজার মানুষ জড়ো হয় না? কথাটা খুবই সত্যি, সাধারণত নাটক দেখার জন্য যতো মানুষের ভীড় হয় গির্জার প্রার্থনা সভায় তা হয় না। নাটকের এই জনপ্রিয়তা অতীতে যেমন ছিলো বর্তমানেও সমভাবে রয়ে গেছে। নাটকের আখ্যান ও বিষয়বস্তু সেক্ষেত্রে যেমন হতে হয় উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী চাঞ্চল্যকর ঘটনায় ভরপুর, ঠিক তেমনি প্রযোজনা হতে হয় গতিময় এবং কখনো কখনো উচ্চকিত। কিন্তু সর্বদা রক্ষা করতে হবে নাটকের সাহিত্যগুণ এবং শিল্পমান।

মানুষকে সচেতন ও শিক্ষিত করে তোলার জন্য যতোগুলো শিল্পমাধ্যম আছে নাটক তার মধ্যে অন্যতম। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চেতনার নানা স্তর এবং সামাজিক উত্থান পতনের বিচিত্র তরঙ্গ নাটকেই ধরা পড়ে সবচাইতে বেশি। নাটকে নানা চরিত্রের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব দেখানো হয় তার মধ্যে ফুটে ওঠে সমাজের বৃহত্তর দ্বন্দ্বের প্রতিরূপ। নাটক তাই সমাজকে তুলে ধরে সমাজ-দ্বন্দ্বের প্রতিরূপ হিসাবে এবং তার প্রধান চরিত্ররা হয়ে ওঠে সমাজের একেকটা শক্তির প্রতিনিধি। এ কথা সত্যি যে, মানুষকে নাটক দ্রুত উদ্দীপ্ত করে। বহুজনই বলেন, বিদ্রোহের উস্কানি নাটক থেকেই আসে সর্বাগ্রে। সমাজে যে বিশ্বাসগুলো শেকড় গেড়ে থাকে, যে বিশ্বাসগুলো আর কোনোভাবেই মানুষের সার্বিক কল্যাণে আসতে পারে না তার বিরুদ্ধে নতুন চিন্তাগুলোকে মুখোমুখি এনে দাঁড় করানো, দর্শকদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরাই হচ্ছে নাটকের মূল প্রতিপাদ্য। যার জন্য মঞ্চে যখন কোনো নাটক মঞ্চায়িত হয়, দর্শক তখন যতোই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে যাক না কেন পুরান আর নতুন চিন্তার দ্বন্দ্বে তার ভিতরের পুরানো বিশ্বাসগুলো মনের অবচেতনে ভেঙ্গে পড়তে থাকে। নাট্যের এই শক্তিকেই প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে কাজে লাগাতে চেষ্টা করা হয়েছে, আর সে কারণেই পৃথিবীর কোনো মহৎ নাট্যকারের পক্ষেই শুদ্ধ শিল্পের জয়গান করা সম্ভব হয়নি।

প্রাচীন গ্রীক নাট্যকলা তো বটেই, পরবর্তীতে শেক্সপিয়ারের নাটক থেকে শুরু করে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য নাট্যকারের নাম কি উচ্চারণ করা যাবে যিনি তাঁর নাটকে অন্যায়কে সমর্থন করেছেন, অথবা অত্যাচারী শোষক কিংবা অসৎ লোকের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন কিংবা তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করেননি? ইউরোপের নবজাগরণ বা রেনেসাঁস যুগে যে নাট্য ঐতিহ্য গড়ে উঠেছি জার্মানীতে, স্পেনে, ফ্রান্সে, ইংল্যাণ্ডে তারও প্রধান চরিত্র ছিল সমাজ ও রাজনীতি। মলিয়ের বা বেন জনসন, কল্দেরন বা মার্লো সকলেই নাট্যশিল্প ও সমাজ-ভাবনাকে একীভূত করে নিয়েছেন তাঁদের সৃষ্টিতে। এরই চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় শেক্সপিয়ারে। এতোই সর্বগ্রাসী ছিল তাঁর নাট্যজগৎ যে তার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁর যুগের সবকিছু। পরবর্তী নাট্যকারদের মধ্যে গ্যাটে-শিলারের দেশপ্রেমমূলক নাটক বা গোগলের ক্ষুরধার ব্যঙ্গ থেকে ইবসেন, বার্নার্ড শ, হাউপ্টমান, চেখভ, গোর্কি, গলসওয়ার্দি, সকলের নাট্যরচনায় ছিল মানব সমাজ ও তাদের জীবনযাত্রা, তাদের আশা-আকাক্সক্ষা ও সংগ্রামের কথা। মানুষকে উদ্দীপ্ত করবার রসদও ছিল তা।

Manual3 Ad Code

শিল্প সৃষ্টির পিছনে উপযোগিতার কথা বলা হলেও বিভিন্নজন এ ব্যাপারে তাদের জোরালো মতামত প্রদান করলেও শিল্প সৃষ্টির কারণ সবসময় এক ছিল না। শিল্পকলার উৎপত্তি অন্বেষণে দেখা গেছে, আদিতে এর যে ভূমিকা ছিল সমাজকাঠামো পরিবর্তনের সাথে সাথে সে ভূমিকারও পরিবর্তন হয়েছে। শিল্পের বা নাটকের শুরুর দিকে ব্যাপারটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা; মানুষ যখন নাচলো ছন্দোবদ্ধ তালে তালে সৃষ্টি হলো প্রথম শিল্প। বিশ্বপ্রকৃতিই তাকে শিখিয়েছিল এই ছন্দতাল। মানুষ দেখেছে জলের উপর ঢেউয়ের সুশৃঙ্খল নিয়ম। দেখেছে মাঠের উপর হাওয়ার নাচন। দেখেছে চন্দ্র, সূর্যের উদয় ও অস্ত। শুনেছে নিজের হৃদয় স্পন্দনের ছন্দোময় ধ্বনি; তাই প্রথমবার সে যখন নাচলো প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চেই নাচলো ছন্দে-সুরে-তালে। সেইটুকুই ছিল তার স্বতঃস্ফূর্ততার ইতিহাস, সেই সুদূর আদিম যুগে। কিন্তু মানুষের তৈরি মঞ্চে যখন সে নাচলো স্বতঃস্ফূর্ততার পরিবর্তে সেখানে এলো উদ্দেশ্য। শিল্পকলার সাথে সেই যে উদ্দেশ্যের যোগাযোগ, বিভিন্ন সমাজে বিভিন্নভাবে তা আজও চলমান। সুতরাং শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টিতে মানুষ প্রবৃত্তির অন্ধ কারাগারে বন্দী হয়ে নেই, নিজের সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করে নিজের ইচ্ছাপথে তাকে নিয়ন্ত্রিত করছে। তবে তার সে ইচ্ছাপথও নিয়ন্ত্রিত হয় পূর্বনির্দিষ্ট বাস্তবতার দ্বারা।

শিল্প-সাহিত্য সর্বদাই কোনো-না-কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই পথ চলেছে। শিল্পকলা ও সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন শাখার এক‌টি নাটক। নাটক তার প্রাচীন যুগ থেকেই উদ্দেশ্যমূলক। সব যুগে সব দেশের নাট্যকলার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের পেছনে সুনির্দিষ্ট বাস্তব কিছু কারণ সর্বদাই ক্রিয়াশীল ছিল। বিশেষ বিশেষ বাস্তবতায় বিশেষ বিশেষ নাট্যরীতির প্রচলন ঘটেছে। নাট্যশিল্পীরা সেই বিশেষ বাস্তবতার আলোকে নাট্যচর্চা চালিয়ে গেছেন। নাট্যশিল্প হচ্ছে সমাজ উপরিকাঠামোর একটি চলক। তাই বিশেষ একটি বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ভিত্তিটিই নির্ধারণ করে দিয়েছে নাট্যশিল্পের স্বভাব ও চরিত্রটিকে। সমাজ বাস্তবতা তথা উৎপাদন ব্যবস্থা যেমন নাট্যচর্চার ধারাকে প্রভাবিত করেছে তেমনি বিভিন্ন সময় যে-সমস্ত শিল্প আন্দোলন হয়েছে সেগুলোও নাট্যতত্ত্ব, নাট্যরীতি, নাট্য-ভাবনা ও নাটক লেখার সূত্রসমূহকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়েছে। নাট্যধারাকে সজীব রেখেছে। ইতিহাস সেটা করেছে নিজের পক্ষে নাটকের উপযোগিতা সৃষ্টির জন্যই। ট্রটস্কি লিখেছেন, ‘ইতিহাসের বস্তুবাদী দৃষ্টিতে দেখলে শিল্পকলা সবসময় ছিল সমাজের ভৃত্য ও ঐতিহাসিকভাবে উপযোগবাদী’। সমাজ ও পরিবেশের উপরও শিল্পকলা প্রভাব ফেলে। ট্রটস্কি মনে করতেন, যদি সমাজ-পরিবেশের পরিবর্তনে মানসিকতার কোনো পরিবর্তন না হতো, তবে শিল্পকলায় কোনো চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেতো না; পুরুষপরম্পরায় মানুষকে শুধু বাইবেলের কবিতা বা প্রাচীন গ্রীক কবিতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো। ট্রটস্কির মতের পাশাপাশি অঁরি আরভোঁ মনে করেন, মানব জাতির এই ঊর্ধ্বমুখী অগ্রগতিকে স্বীকার করে নিলে শিল্পের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় মানুষকে তার পশুসুলভ সুষুপ্তি থেকে জাগ্রত করা। মানবের চিন্তা করবার প্রক্রিয়াকে বিকশিত করা। বিজ্ঞান মানুষের প্রতিদিনের কাজের ধরনকে বদলে দিচ্ছে। সমাজও বদলে যাচ্ছে। শিল্পকলায় তার প্রভাব পড়বেই। শিল্পকলারও প্রভাব পড়বে সমাজের ওপর এবং এর ভিতর দিয়েই সমাজ বিকশিত হবে। কথাটা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। নাটকের সৃষ্টি তো হয়েছে জনমানসে কোনো না কোনো বিষয় প্রচার করার জন্যই। বর্তমান ব্যবস্থাই শ্রেষ্ঠ এই ধারণা জনমনে গ্রথিত করা শাসকগোষ্ঠীর নাট্য মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য। কিন্তু বিপরীত দিকে নাটক যে শাসক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, তাদের ভীতির কারণ হতে পারে তারও প্রমাণ রয়েছে।

Manual7 Ad Code

[চলবে।]

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code