রবীন্দ্রনাথকে ‘ব্যাঙ্গ’ করে কবিতা লিখলেন বনফুল, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দিলেন গল্পের প্লট

প্রকাশিত: ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২১, ২০২০

রবীন্দ্রনাথকে ‘ব্যাঙ্গ’ করে কবিতা লিখলেন বনফুল, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দিলেন গল্পের প্লট

Manual3 Ad Code

সৈয়দ অারমান জামী || শ্রীমঙ্গল, ২১ জুলাই ২০২০ : বিহারের সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে হাইস্কুলে পড়াশোনা চলছে আপন খেয়ালে। ক্লাস এইটের এক ছাত্র সেখানে ছাত্র-শিক্ষক সবার কাছেই খুব পরিচিত। ছেলেটা কবিতা লেখে। সেই সময় ‘মালঞ্চ’ ও ‘বিকাশ’ পত্রিকাদুটিতে ওর কবিতা ছাপা হল। সবাই খুশি; ব্যাতিক্রম একজন। স্কুলের হেড মাস্টারমশাই। তাঁর ধারণা, কবিতা লিখেই বিগড়ে যাচ্ছে ছেলে। সংস্কৃতে নম্বর কম পাচ্ছে। তাই নির্দেশ এল, কবিতা লেখা চলবে না কিছুতেই। এবার কী হবে? অবশেষে উপায় বার হল। ঠিক হল, ছদ্মনামে লেখা যাবে এবার থেকে। সেই থেকে কিশোর বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুড়ে গেল আরও একটি নাম – ‘বনফুল’। বাকিটা, ইতিহাস…

বন চিরকালই তাঁর কাছে ছিল ‘রহস্য নিকেতন’। অসম্ভব ভালবাসতেন গাছপালা, ফুল। সেই ছোটো থেকে বন, প্রকৃতির সঙ্গে সাহচর্য পরবর্তীকালে লেখাতেও ফিরে ফিরে এসেছে। তবে কবিতা দিয়ে শুরু হলেও, বনফুলকে সাহিত্য চেনে একজন ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে। অবশ্য তাঁর আরও পরিচয়ও আছে। তিনি শুধু সাহিত্যিক নন, নিজের সময়ের একজন নামকরা ডাক্তারও।

ছোট থেকেই সমস্ত বিষয়ই স্বাধীনচেতা ছিলেন বনফুল। নিজে যেটা ঠিক বলে মনে করতেন, সেটাই করতেন। এই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আলাপ রবীন্দ্রনাথের। সালটা ১৯৩৫। রাজস্থানের এক অধিবাসী, মন্দিরে মন্দিরে পশুবলি বন্ধের জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। হঠাৎ তিনি কালীঘাট মন্দিরের কাছে শুরু করলেন অনশন। সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে এল এই ঘটনা। গোটা বাঙালি সমাজ প্রতিবাদ করল ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু সমর্থন জানালেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবি ঠাকুরের এই অবস্থানের বিরোধিতায় একটি কবিতা লিখলেন বনফুল। ছাপাও হল সেটা। খানিক ব্যঙ্গের সুরই ছিল তাতে। রবীন্দ্রনাথ পড়লেনও সেটা। না, এতটুকুও রাগ করেননি। বরং নিমন্ত্রণ জানালেন বনফুলকে, সপরিবারে।

Manual3 Ad Code

সখ্যের সেই শুরু। যা বজায় ছিল রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু অবধি। তবে খাদ্যরসিক বনফুল একবার রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলেন ওঁর খাওয়া দেখে। ১৯৩৯ সালের ঘটনা। নভেম্বরের ঠান্ডায় শান্তিনিকেতনে এসেছেন বনফুল। রবীন্দ্রনাথও তখন ওখানে। তখন ভোররাত। ‘শ্যামলী’র সামনে এসে হঠাৎ শুনতে পেলেন জল ঢালার শব্দ। ব্যাপার কী! এত ঠান্ডায় কে স্নান করে? পরিচারক উত্তর দিল, বাবামশাই (রবীন্দ্রনাথ) স্নান করছেন। তারপর বেরিয়ে এলে বসলেন জলখাবারের জন্য। রবীন্দ্রনাথের সেই বিপুল ‘রাজকীয়’ জলখাবারের পরিমাণ দেখে প্রবল খাদ্যরসিক বনফুলেরও চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল।

Manual3 Ad Code

বনফুলের লেখাও বিশেষ পছন্দ করতেন গুরুদেব। সেই সময়ই একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ্য। ১৯৩৯ সালের মার্চে রবীন্দ্রনাথ একটি বিশেষ চিঠি লিখলেন বনফুলকে। তিনি তখন ভাগলপুরে। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ একটি গল্পের প্লট দিলেন তাঁকে। কারণ তাঁর মতে, এই গল্প লেখা তাঁর পক্ষে অশোভন হবে। বনফুল ঠিক এই প্লট ধরতে পারবেন, এই বিশ্বাস তাঁর। বনফুলেরও ইচ্ছা ছিল লেখার। কিন্তু কোনো কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তবে রবি ঠাকুরের দেওয়া গল্পের নায়ককে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তাঁকে নিয়েই লিখেছিলেন একটি উপন্যাস ‘নির্মোহ’। ‘অমর’ চরিত্রটি ওই প্লট থেকেই নেওয়া।

Manual5 Ad Code

যেমন ছিলেন স্বাধীনচেতা, তেমনই ছিল মেজাজ। শুধু সংসার বা সাহিত্য জগতই নয়, বনফুলের মেজাজের সাক্ষী তাঁর কর্মজগতও। নামী ডাক্তার হওয়ার দরুণ, নানা স্তরের মানুষরা আসত তাঁর কাছে। সেইভাবেই এসেছিলেন ভাগলপুরের ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর স্ত্রীর শরীর খারাপ। মুত্র পরীক্ষা করাতে হবে বলে, বনফুলের কাছে নিয়ে এসেছেন ইউরিন। এসেই শুরু করে দিলেন হম্বি তম্বি। ম্যাজিস্ট্রেট বলে কথা! কিন্তু তিনিও যে ডাঃ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। বোতল ভর্তি ইউরিন এক টানে নর্দমায় ফেলে দিলেন। শুধু তাই নয়, ম্যাজিস্ট্রেটকেও বের করে দিলেন ঘর থেকে!

Manual7 Ad Code

১৯৬৮ সালে ভাগলপুর থেকে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন কলকাতায়। যেদিন চলে আসবেন, গোটা ভাগলপুর চলে এসেছিল স্টেশনে, তাঁকে বিদায় জানাতে। দিন যে আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে, বুঝতে পারছিলেন তিনি। শেষ উপন্যাসে লিখে গিয়েছিলেন- “আমি আর ফিরব না। তোমরা যন্ত্র সভ্যতার বিলাসে সুখে থাকো।” এটা কি স্রেফ উপন্যাসের সংলাপ, নাকি নিজেরও কথা? যন্ত্র সভ্যতার এই ভয়ংকর ‘বিলাস’ যে জাঁকিয়ে বসেছে আমাদের। যার ছদ্মনামে একসঙ্গে রয়েছে বন আর ফুল, তিনি কী করে এমনটা মেনে নেবেন?

ঋণ-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০১৮, ‘বনফুলের মর্জিমহল’
২) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০১৭, ‘রান্নাতেও বনফুলের ছিল চমৎকার হাত’
৩) চিঠিপত্র (চতুর্দশ খণ্ড) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code