সিলেট ২৪শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:০৯ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২২, ২০২৫
বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ২২ অক্টোবর ২০২৫ : একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কিছু নাম আছে, যাদের বীরত্ব, আত্মত্যাগ আর দেশপ্রেমের গল্প প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। তাঁদেরই একজন, দক্ষিণাঞ্চলের কিংবদন্তি গেরিলা কমান্ডার — বীর বিক্রম হেমায়েত উদ্দিন।
আজ (২২ অক্টোবর) এই মহান মুক্তিযোদ্ধার নবম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৬ সালের এই দিনে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হন। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া ইতিহাস, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ এখনো জীবন্ত, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাটিতে প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে আছে তাঁর নাম।
যুদ্ধের আগে—এক সাধারণ মানুষ, অসাধারণ সংকল্প
হেমায়েত উদ্দিন তখন ছিলেন এক তরুণ। স্বাধীনতার ডাক যখন চারদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো, তখন তিনিও যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াল বাস্তবতা তাঁর জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল।
দেশীয় রাজাকাররা তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছিল। সেই খবর শুনে তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছুটে আসেন বাড়িতে। কিন্তু এসে দেখেন — তাঁর স্ত্রী সতীত্ব রক্ষার জন্য গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সন্তানরাও কেউ বেঁচে নেই।
যে মানুষটির সবকিছু কেড়ে নিয়েছিল যুদ্ধ, তিনি তখন সেই শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। বাড়ি ছেড়ে তিনি আবার ফিরে গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে, কিন্তু এবার তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল — দেশকে মুক্ত করা।
হেমায়েত বাহিনী: দক্ষিণাঞ্চলের কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এক গেরিলা শক্তি
বিপুল সাহস ও নেতৃত্বগুণে তিনি গড়ে তোলেন এক দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনী — “হেমায়েত বাহিনী” নামে পরিচিত। প্রায় পাঁচ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত এই বাহিনী দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও বাগেরহাট জেলাজুড়ে দুর্ধর্ষ অভিযান চালায়।
তাঁদের হঠাৎ আক্রমণ, রাতের গেরিলা কৌশল, সাঁকো উড়িয়ে দেওয়া, ট্রান্সপোর্ট লাইন কেটে দেওয়ার মতো পদক্ষেপে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বারবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। স্থানীয় রাজাকাররাও আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াতো।
ইতিহাসবিদদের মতে, হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন এ বাহিনী ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কার্যকর গেরিলা ইউনিট — যার কৌশল আজও সামরিক ইতিহাসে অধ্যয়নযোগ্য।
বুলেট গালে, দাঁত ঝরে—তবু যুদ্ধ থামেনি
একটি সম্মুখযুদ্ধে হেমায়েত উদ্দিনের গালে বুলেট লাগে। বুলেট এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আটটি দাঁত পড়ে যায়, রক্তে ভেসে যায় মুখমণ্ডল।
কিন্তু এই গুরুতর আহত অবস্থাতেও তিনি যুদ্ধ থামাননি। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান তাঁর সৈন্যদের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত সে যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদাররা পরাজিত হয়।
সহযোদ্ধারা বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম কমান্ডার মরে গেছেন। কিন্তু যখন শুনলাম তিনি এখনো বেঁচে, তখন সবার চোখে জল এসে গিয়েছিল। এমন মানুষ ক’জন জন্মায়!”
বীরের স্বীকৃতি
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার তাঁর বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ “বীর বিক্রম” খেতাবে ভূষিত করে। তবে হেমায়েত উদ্দিন কখনো নিজের কৃতিত্ব নিয়ে বড়াই করেননি। নীরবে, সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন তিনি, দূরে থেকেছেন প্রচার ও আলোচনার কেন্দ্র থেকে।
তাঁর সহযোদ্ধারা বলেন, “হেমায়েত ভাই ছিলেন লড়াইয়ের মেশিন, কিন্তু মনের দিক থেকে শিশুর মতো কোমল।”
শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত দেশপ্রেমে অবিচল
২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর তিনি পরপারে পাড়ি জমান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছড়িয়ে গেছেন তরুণ প্রজন্মের মাঝে। দেশের নানা জায়গায় তাঁর নামে স্থাপিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, স্কুল ও স্মৃতিস্তম্ভ।
আজ, তাঁর নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশ তাঁকে স্মরণ করছে গভীর শ্রদ্ধায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজারো মানুষ লিখছেন —
“যে মানুষ নিজের সব হারিয়ে দেশকে জিতিয়েছেন, তিনি শুধু বীর নন, তিনি বাংলাদেশের আত্মার প্রতীক।”
পরিশেষে
হেমায়েত উদ্দিনের জীবন কেবল মুক্তিযোদ্ধার কাহিনি নয়, এটি এক অনমনীয় ইচ্ছাশক্তির প্রতিচ্ছবি। পাহাড়সম শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করা এই মানুষটির গল্প আজও শেখায় — দেশপ্রেম কখনো হারায় না, শুধু রূপ বদলায়।
আজ তাঁর নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে পুরো জাতির কণ্ঠে একটাই উচ্চারণ—
“বীর বিক্রম হেমায়েত উদ্দিন, আপনাকে সালাম।”
????️
বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি
বীর বিক্রম হেমায়েত উদ্দিন
(— ২২ অক্টোবর ২০১৬)

সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি