জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক

প্রকাশিত: ৩:০৬ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৭, ২০২৫

জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক

Manual5 Ad Code

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

(প্রয়াণদিবসে নিবেদন)

Manual7 Ad Code

যে মানুষ সারাটি জীবন কাটান জ্ঞানের স্বপ্নে,
যার শ্বাস-প্রশ্বাসে বহে চলে ভাবনার নদী,
যিনি বইয়ের পাতায় খুঁজে পেতেন মহাবিশ্বের আলো—
তার প্রয়াণদিবসে মাথা নুইয়ে আজ বলে উঠি,
এমন মানুষ আর কবে আসবে বাংলা মাটির কোলে?

Manual4 Ad Code

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক—
এ নাম যেন এক নৈঃশব্দ্যের দীপশিখা,
এক দার্শনিকের মূর্তি,
যিনি সংসারের রঙিন বিভ্রমে ডুবেননি কখনো।
জীবন তার ছিল স্টোয়িক চিন্তায় মগ্ন,
সক্রেটিসের মতো প্রশ্নে প্রশ্নে
তিনি উন্মোচন করতেন জ্ঞানের নতুন পথ।

ফুলার রোডের লাল-ইটের সেই ঘর,
বইপত্রে ভরা, চিন্তায় ভরা,
যেখানে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতো
মুহূর্তেই যেন মহাবিশ্বের দরজা খুলে যেত।
রাত গভীর হলে তিনি বলতেন—
“এসো, দেখো, জানো;
সমাজকে বুঝতে হলে
দেখো বাজার—দেখো বইয়ের দোকান।”
এ যেন ছিল তার অদ্ভুত অথচ নির্মোহ দর্শন,
বিচারের সহজ ভাষা।

Manual3 Ad Code

ধবধবে খদ্দরের পাঞ্জাবী,
কখনো চাদর, কখনো লুঙ্গি,
এতেই ছিল তার স্বাধীনতার ছাপ।
হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা করতেও
পুরোনো জামায় যিনি গিয়েছিলেন,
তিনি তো জানতেন—
মানুষের মূল্য পোশাকে নয়,
মস্তিষ্কের দীপ্তিতে।

জ্ঞানতাপস রাজ্জাক ছিলেন
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনকসম এক আলো।
তিনি দেখিয়েছিলেন বৈষম্যের গহ্বর,
পূর্ব-পশ্চিমের অর্থনীতির অসাম্য,
যেখান থেকে জন্ম নিয়েছিল
দুই অর্থনীতি তত্ত্ব, ছয়দফার বীজ।
দেশের রাজনৈতিক চিন্তাধারায়
তার অবদান এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

কিন্তু এই আকাশচুম্বী মানুষটি
জীবন কাটিয়েছেন অদ্ভুত সরলতায়—
যে খাটে ঘুমাতেন, তার এক পায়া ভাঙা,
সেখানে বই দিয়ে সামলে রাখা পায়া
হয়তো ছিল তার চরিত্রেরই প্রতীক—
ভেঙে যাওয়া সমাজকে
তিনি জ্ঞানের বই দিয়েই তো বাঁচাতে চেয়েছিলেন।

শত অপবাদ, শত মামলা,
“আব্দুর রাজ্জাকের কল্লা চাই” স্লোগান—
কিছুই তাকে নত করতে পারেনি।
কারণ তিনি জানতেন—
সত্য কখনো পরাজিত হয় না।
তিনি ছিলেন শিক্ষকদের শিক্ষক,
ছাত্রদের আশ্রয়,
মানবিকতার প্রতিমূর্তি।
সবাইকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করা
শিক্ষকের এই অনন্য সৌজন্য
এখনো বাতাসে ভাসে।

যে সলিমুল্লাহ খান তাকে নিয়ে বই লিখে বকেছেন,
তারই বিদেশযাত্রার সুপারিশপত্র
হাসিমুখে লিখে দিয়েছিলেন তিনি—
এমন মহৎ মানুষের অন্তরে
কোনো ক্ষোভ জমে থাকেনি কখনো।
অহংকারের বদলে থাকত
মমতার স্নিগ্ধ ছায়া।

রান্নাঘরে যেমন ছিলেন শিল্পী,
দাবার বোর্ডে ছিলেন কৌশলের কারিগর।
কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে
রাতভর দাবার লড়াই,
আবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চায়ের আড্ডা—
এই মানুষটি জীবনের যেকোনো প্রান্তেই
ছিলেন সহজ, স্বচ্ছ, মানবিক।

Manual3 Ad Code

আজ ২৮ নভেম্বর, তার প্রয়াণদিবস—
আমাদের কাছে এ দিন
এক আলোকবার্তার দিন।
কারণ তিনি চলে গেলেও রেখে গেছেন
জ্ঞানের অপরিমেয় দীপস্তম্ভ,
যে আলো
প্রজন্মের পর প্রজন্মকে পথ দেখাবে।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক—
আপনি বই লেখেননি ঠিকই,
কিন্তু আপনি লিখে গেছেন মানুষ—
আপনার ছাত্ররা, আপনার চিন্তাধারা,
আপনার মানবিকতার মহাকাব্য।
আপনার জীবনই আমাদের পাঠ্যপুস্তক।

শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাই আপনাকে—
বাংলার জ্ঞানের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র,
প্রাজ্ঞ, অমিতপণ্ডিত,
কিন্তু সারল্যে-সরলতায় ভরা
এক অনন্য মানব-অস্তিত্বকে।

আপনার প্রদীপ নিভে যায়নি—
তা জ্বলছে, জ্বলে থাকবে—
বাংলার চিন্তাশীল প্রতিটি মন
যতদিন আপনাকে স্মরণ করবে।

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ