ছোট বেলার সেই গল্প, যা আজো শেষ হয়নি

প্রকাশিত: ১:১৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৮, ২০২০

Manual1 Ad Code

হাফিজ সরকার, ২৮ এপ্রিল ২০২০ : আমরা ছোটবেলা থেকে দাদা-দাদি মুখে, নানা-নানিমুখে, বাবা-মা’র মুখে গল্প শুনেছি। রাজা-রানির গল্প। শুনেছি রাজার গল্প। “রাজার কাছে অনেক ধন-সম্পদ রয়েছে।

হাফিজ সরকার

তিনি সোনায় মোড়া চেয়ারে বসেন। তার রানিরা গোলাপে মোড়া পাপড়িতে গোসল করেন। তার কাছে হাতি রয়েছে, ঘোড়া রয়েছে, লোক-লস্কর রয়েছে। প্রচুর..। প্রচুর মানি-মানিক্য, প্রচুর সোনা-দান, প্রচুর অর্থের মালিক তিনি।

আর সেই রাজার রাজ্যে যারা প্রজারা থাকতেন সেই প্রজাদের দুর্দশা খুউব। তাদে ঘরে ফসল নেই, পেটে খাবার নেই, শোবার ঘর নেই। তারা চাষ করেন কিন্তু সেই চাষের তারা ন্যায্য মুল্য পায়না।
তারা রাজার কাছে আসেন, কখনো জমিদারের কাছে যান, কখনো মহাজনের কাছে যান কিছু টাকা চেয়ে, কিছু আর্থিক সাহায্য চাইতে।

আমরা ছোটবেলা থেকেই এই রাজা-রানির গল্প সেই যে রাজার অনেক ধন-সম্পদ থাকবে, প্রজারা যে অনেক গরীব হবে সেটা বিশ্বাস করতে শিখেছি। ছোটবেলা থেকেই আমাদের খুউব নরমালাইজ করা হয়েছে যে আমাদের সমাজে, আমাদের পৃথিবীতে এই গোটা ব্যবস্থাতে কিছু অল্প সংখ্যক মানুষের কাছে অনেক টাকা থাকা, আর বেশির ভাগ মানুষের কাছে টাকা না থাকা এটাই সাভাবিক। আমাদের শেখানো হচ্ছে, যে মানুষের কাছে অনেক টাকা থাকে, যে মানুষের কাছে অনেক ধন-সম্পদ থাকে তারা কাজ করেনা। রাজা-রানিরা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেন তারপর তারা মকমলে মোড়া তাদের যে ঘর-বাড়ী সেই বাড়িতে হেটে বেড়ান। তারপর সুন্দর কিছু খাবার দাবার সেগুলো তারা খান তারপরে সভাসদসহ সভায় যান। এভাবেই তাদের দিন কাটে। আর সেখানেই আমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে, সেই রাজারই যারা প্রজা তারা খুউব সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্ষেত-খামারে মাঠে যান। ক্ষেতে তারা খুউব হাড়ভাংগা খাটুনি করেন। তারপরেও তাদের বাড়িতে এনাফ খাবার থাকেনা। তাদের দু’বেলা দুমুঠো খাবার, থাকেনা যথেষ্ট পরিমাণ শস্য ঘরে।

ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয় এই যে সত্য দু’টো, বড়লোক মানুষ বিনা কাজকর্ম করে কোন কাজকর্ম না করে অনেক অর্থবান হতে পারেন সম্পদশালী হতে পারেন এবং গরিব মানুষ প্রতিদিন প্রতিনিয়ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করেও তার কাছে কোনো অর্থ সম্পদ থাকতে পারে না। এটে আমাদেরকে বিশ্বাস করানো হয়েছে। এটা আমরা ছোটবেলা থেকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি। আর ঠিক এই জায়গাটিতে এই কথা বলতে চায় এই যে ধরে নিন আমরা আজকে যখন রাস্তায় যায়, আমাদের ছোটদের কিছু উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করি। যদি কোন রিক্সা ওয়ালা আমাদের সামনে দিয়ে যায় বা কোন ঝাড়ুদার যদি আমাদের সামনে দিয়ে যায়, মেহনত করে এমন মানুষ যদি আমাদের সামনে দিয়ে যায় আমরা আমাদের ছোটদের বলি “দেখো বাবু ভাল করে পড়াশুনা করো,স্কুলে গিয়ে ভাল করে হোম ওয়ার্ক করো, কারন তোমরা যদি পড়াশুনা না করো তাহলে ঐ রিক্সা চালক হতে হবে।”
আচ্ছা যারা রিক্সা চালাচ্ছেন, যারা ঐ রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছেন, যারা হয়তো ছোটো খাটো ঝালমুড়ি বিক্রি করেন, বাদাম বিক্রি করেন, আলু-কাবলি বিক্রি করেন, আইসক্রিম বিক্রি করেন রাস্তায় রস্তায় তারা কি খারাপ লোক? তারা কি এই কারনে বড় হয়ে ফেরিওয়ালা হয়েছেন? তারা কি এই কারনে বড় হয়ে রিক্সওয়ালা হয়েছেন? কারন তারা ছোটবেলায় পড়াশোনা করেননি? নাকি তারা এই কারনে পড়াশোনা করতে পারেননি কারন তারা যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই পরিবারের দিন আন্তে দিন খায় অবস্থা। সেই পরিবারে প্রতিদিন দুবেলা দুমুঠো খাবারটাই তাদের প্রাথমিকতা। পড়শোনা তাদের কাছে বিলাসিতার মত ছিল।

আমরা যারা ছোটদের ভয় দেখায়, “তুমি যদি ভাল করে পড়াশুনা না করো তাহলে তোমাকে ঐ নিক্স চালকের মত হতে হবে।” আমরা কোথাও না কোথাও কায়িকশ্রমকে ভয় পাই। আমাদের মনে হয় কায়িকশ্রম যারা করেন, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শস্য উৎপাদন করেন, কলকারখানায় যান উৎপাদন করেন,নিজের মেহনত দিয়ে নিজের পরিশ্রম দিয়ে টাকা উপার্জন করেন, তাদেরকে সম্মান করতে আমরা কখনো আমাদের বাচ্চাদের শিখাইনা। তাদের শ্রমকে সম্মান করতে আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, যাদের আমাদের বাড়িতে খাবার হয়ত কোন অসুবিধা নেই, যাদের হয়তো সকালবেলা উঠে ভাবতে হয়না আজকে বাবা যদি উপার্জন করে না আনেন তাহলে রাত্রিবেলা উনুন জলবেনা। আমরা ছোটবেলা থেকেই আমাদের প্রজন্মকে আমাদের পাশাপাশি লোকজনকে, মেহনতকে, শ্রমকে খুউব ঘেন্না করতে শেখাই এবং এটা আমাদের কোনো ব্যক্তিগত ভুল নয়, আমরা যে সমাজ ব্যবস্থায় বাস করি, যে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বাস করি অথবা যে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় বাস করি সেখানে সমস্ত জায়গায় শ্রমকে ছোট ও লঘু করে দেখানো হয়। সমস্ত জায়গায় বলা হয় যারা শ্রকিক তাদের জীবনের যে মুল্য তা সব চাইতে কম। আমাদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় যারা ঘর মুছেন,যারা ঝাড় দেন, যারা ছোট ছোট কাজ করেন তাদের নিচু হিসাবে দেখতে।

Manual3 Ad Code

আপনি ভেবে দেখুন আপনার বাড়ির কথা। আপনার বাড়ির চৌহরদিতে যে মহিলা ঘর মুছে দেন, ঝাড় দিয়ে দেন, তাকে কি আপনি সম্মানের সাথে দেখেন? তার শ্রম আর আপনার বাড়ির যে মানুষটি বাইরে কাজ করতে যান তার শ্রমকে সমান ভাবে দেখেন?
ছেড়ে দিন আমি অতো দুরে যাচ্ছিনা। আপনার পরিবারের মধ্যে আপনার মা যে কাজগুলো করেন, ঘর মুছা হোক, রান্না করা হোক, জামা কাপড় ধোয়স হোক, তার শ্রমকেই কি আপনি এতটুকু সম্মান দেন?
তার শ্রমকে আমরা সম্মান দিনা কারন তিনিতো অর্থ উপার্জন করেন না। তিনি বাড়তে যে যে শ্রমগুলি দিচ্ছেন তার শ্রমের বিনিময়ে কেউ অর্থ দিচ্ছেন না অথচ সেই একই শ্রম রান্না করা, বাসন মাজা, জামাকাপড় ধোয়া কাজ যদি অন্যকারো বাড়িতে গিয়ে করতেন তাহলে তিনি অর্থ উপার্জন করতেন।
আমরা আমাদের সমাজে, আমাদের পরিবারগুলোতে এইধরনের কায়িক শ্রমকে বলছি যে কায়িক শ্রমগুলি মহিলাদের দায়িত্ব। আমরা বলছি যে যদি মহিলা হন তাহলে বাচ্চা পালন করা, সংসারের কাজ করা, স্বামির দেখভাল করা, মহিলা হওয়ার কারনে আপনার দায়িত্ব। আর সেকারনে আপনি শ্রম দানের কারনে কিছু এস্পেক্ট করতে পারেন না। কিছু আশা করতে পারেন না।

Manual2 Ad Code

আমরা একটা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা অথবা একটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই যে কায়িক শ্রম এই কায়িক শ্রমকে খাটো করে দেখতে শিখি, লঘু করে দেখতে শিখি। আর সেই কারনেই কারখানায় যে মানুষটি দিনে ৮ঘন্টা কাজ করেন, যিনি কারখানায় যাচ্ছেন তার দিনের সম্পুর্নটা সময় দিয়ে কাজ করছেন। তিনি হয়ত মাস গেলে ৪০০টাকা হতে ৪০০০টাকা ম্যাক্সিমাম পাচ্ছেন। আর সেই কারখানারই মালিক যিনি ৮ ঘন্টাই কাজ করেন। যতটা শ্রমিক করছেন তার মতই ৮ঘন্ট তিনি কাজ করেন। তবুও আমরা দেখবো তিনি মাসে যা আয় করেন তা হয়ত লাক ছাড়িয়ে যাবে।

Manual3 Ad Code

তিনি কোনো কাজ না করেও অথবা তিনি ৮ঘন্টা কাজ করেও ৮লাক টাকা পাবেন। আর ৮ঘন্টা কাজ করে একজন মজুর বা একজন শ্রমিক ৮ হাজার টাকা পাবেন। আরও হয়ত আমরা বিশ্বাস করি যে কায়িক শ্রম সেই কায়িক শ্রমকে আমরা ছোট করে দেখতে পারি।
কিন্তু জমির যে মালিকানা, কারখানার যে মালিকানা, পুঁজির যে মালিকানা তাকে আমরা ছোট করে দেখতে পারিনা।
(চলবে)

Manual1 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code