বিড়ালের কণ্ঠে বাঘের হুংকার এবং বু‌দ্ধিজীবী

প্রকাশিত: ৭:৩০ পূর্বাহ্ণ, মে ৮, ২০২০

বিড়ালের কণ্ঠে বাঘের হুংকার এবং বু‌দ্ধিজীবী

রাহমান চৌধুরী, ০৮ মে ২০২০ : রাশিয়াতে তখন জারের শাসন চলছে। জারের বিরুদ্ধে হঠাৎ বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় জারের পুলিশের বড়কর্তা বললেন, ‘রাশিয়ায় বিপ্লব ঠেকানো জন্য দরকার কারো বিরুদ্ধে ছোট একটা যুদ্ধ লাগানো আর তাতে জয়লাভ’। জারের রাশিয়া ভেবেছিল, রাশিয়া বিরাট শক্তি ফলে যুদ্ধ করে যে কোনো একটা দেশ জয় করে নিলেই হলো। কিন্তু বাস্তবে যুদ্ধের ফলাফল হলো উল্টো। রাশিয়া তখন চীন আর গোটা প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে নজর দিয়েছে। জার যখন ভিন্ন রাষ্ট্রে অভিযান চালাবে ভাবছে তখন ক্ষুদ্র জাপান রাষ্ট্র ‘পোর্ট আর্থার’-এ রুশ নৌঘাঁটি আক্রমণ করে বসে। কারণ জাপানের স্বার্থ ছিল চীনে। দুদিনের টানা আক্রমণে বেশ কয়েকটি রুশ যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। সময়টা ১৯০৪ সাল। পরে পাইকারি হারে সব জায়গাতেই জারের বাহিনী মার খেতে থাকে। সর্বত্রই সাধারণ সৈনিকরা সাহস দেখালেও শেষপর্যন্ত জাপানের হাতে প্রচণ্ড মার খায়। কারণ রুশ সৈনিকদের হাতে যুদ্ধের কোনো সরঞ্জাম পৌঁছাতো না। যুদ্ধে আহত সৈন্যদের জন্য চিকিৎসার ঠিকমতো বন্দোবস্ত পর্যন্ত ছিল না। দু-চারজন ব্যাতিক্রমকে বাদ দিলে জারের সেনাপতিরা ছিল একে অপদার্থ তার উপর আবার দুর্নীতিগ্রস্ত। রুশ একজন সেনাধ্যক্ষ জেনারেল গ্রিপেনবার্গ যুদ্ধক্ষেত্রে হেরে গিয়ে বাহিনীকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল সেন্ট পিটার্সবার্গে। ভিন্ন আর একজন সেনাপতি জেনারেল স্টাকেলবার্গ লড়াই যখন চলছে সে তখন যুদ্ধের মাঠে নিয়ে যেত এক ধরনের গোয়াল গাড়ি। বাস্তবিক সে গোয়ালে গরু থাকতো, কারণ রোজ সকালের কফিতে টাটকা দুধ চাই তার। যুদ্ধে জয় হোক আর না হোক টাটকা দুধের কফি খাওয়া চাই সকালে সেনাপতি মহোদয়ের।

সত্যি ঘটনা হলো এই যে, সৈনিকরা যদি অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ চাইতো তো তাদের পাঠানো হতো গাড়ি বোঝাই পুতুল। সৈনিকরা বিরক্ত হতো কিন্তু উপায় নেই। শেষপর্যন্ত পোর্ট আর্থার দখল করলো জাপানীরা। সমূদ্রের বিভিন্ন প্রণালীতেও রাশিয়াকে হার মানতে হলো ভয়ঙ্করভাবে। রাশিয়ার যুদ্ধ জাহাজগুলোর বেশিরভাগই বিধ্বস্ত হলো। জাপানের সঙ্গে সন্ধিচুক্তিতে রাশিয়া মাঞ্চুরিয়া থেকে সৈন্য সরিয়ে নিল এবং রুশ সাম্রাজ্যকে কোরিয়াতে জাপানের দখলদারী মেনে নিতে হলো। জারের রুশিয়ার এই অবস্থায় ভয়াবহ অর্থসঙ্কট দেখা দেয়, যার ফলাফলে ১৯০৫ সালের শ্রমিকদের বিরাট আন্দোলন আরম্ভ হয়। ভ্লাদিমির লেনিন যাকে বলেছিলেন, রাশিয়ার প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম। সর্বত্র শ্রমিকদের বিদ্রোহ দেখে জারের প্রতিনিধি গিয়েছিল গ্রামে কৃষকদের কাছে। কৃষকরা সরাসরি জানিয়ে দেয়, ‘আমাদের দাবি তিনটি শব্দে বলতে পারি: আমরা চাই রুটি, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতা। কৃষকের স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ‘সরকারের কাছ থেকে আমাদের কোনো প্রত্যাশা নেই। কারণ আমরা জানি, সেন্টপিটার্সবার্গে শ্রমিকদের সঙ্গে এই সরকার কেমন নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। এতসব জুলুমের পরেও আমরা এ সরকারের উপর ভরসা রাখবো তেমন আহাম্মক নই।’ জারের ফৌজরা অনেকে বিদ্রোহ করেছিল সেসময়ে যার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ “ব্যাটেলশিপ পটেমকিন”। ‌সে‌র্গেই অাই‌জেনস্টাইনের বি‌শ্বের সেই সেরা চল‌চ্চিত্র “ব্যা‌টেল‌শিপ প‌টেম‌কিন” নি‌র্মিত হ‌য়ে‌ছিল সে ঘটনা নি‌য়ে। কিন্তু নেতৃত্বের ব্যর্থতা আর মেনশেভিকদের সুবিধাবাদের কারণে এই বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।

বলশেভিকদের কাছে ১৯০৫ এর বিদ্রোহের বিরাট গুরুত্ব ছিল। বলশেভিকদের নেতা লেনিন চাইছিলেন বিদ্রোহকে চূড়ান্ত রূপ দিতে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক নামধারী বিভিন্ন গোষ্ঠী তখন বুর্জোয়াদের সঙ্গী হয়ে জার সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা গেল বিভ্রান্তি। সরাসরি অনেকেই চলে গেলেন জারের পক্ষে আর মুণ্ডপাত করতে থাকলো বলশেভিকদের। জারের মন্ত্রীসভার প্রধান ব্যক্তি তখন স্টলপিন। স্টলপিনের সকল কাজের পক্ষে তখন বুদ্ধিজীবীদের উচ্ছ্বাস। সমাজতান্ত্রিক নামধারী মেনশেভিকরা তখন স্টলপিনের সঙ্গে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। বললো, ‘বিপ্লবের দিন খতম’। সংসদে তখন স্থান পেয়েছে ব্ল্যাক হান্ড্রেডের মতো গুণ্ডার দল। বুদ্ধিজীবীদের তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই, স্টলপিনের সংস্কার কর্মসূচীতে তারা জোর সমর্থন জানাচ্ছে। স্টলপিনের সংস্কারে যে কৃষি আইন তৈরি হয়েছিল, সেই আইনের বলে ক্ষমতাবানরা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সস্তাদরে কৃষকদের জমিগুলি নিয়ে নিল। লক্ষ লক্ষ চাষি এইভাবে পরিণত হলো ভূমিহীনে। কৃষিসংস্কারের নামে অসংখ্য ভূমিহীনকে নামমাত্র জমি দিয়ে তাড়িয়ে পাঠানো হলো দূর সাইবেরিয়াতে বা মধ্য এশিয়ার জনবিরল জায়গায়। সেখানে প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝতে না পেরে বহু মানুষ প্রাণ হারালো। ১৯০৭ সালের একটি হিসেবে দেখা যায় এসব জায়গায় মৃতের হার পঁচিশ থেকে ত্রিশ শতাংশ। যতগুলি ঘর ততগুলিই প্রায় কবর। ১৯১০ সালে দেখা দিল কলেরা। দক্ষিণ রাশিয়ার কলেরায় মারা গেল প্রায় এক লক্ষ মানুষ। তারপরে এলো প্লেগ। ফলে ১৯১১ সালের অজন্মার বছরে দুর্ভিক্ষে তিনকোটি কৃষক আক্রান্ত হলো। কিন্তু জমিদারি ব্যবস্থা ফুলে-ফেঁপে উঠছে তখন। সাধারণ মানুষের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা দিয়েছিল কমবেশি ছয় হাজার কৃষকবিদ্রোহ। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা সমর্থন দিয়েছিল এই সংস্কারকে। বিভ্রান্ত বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে লেনিনকে মতাদর্শিকভাবে লড়াই করতে হয়েছিল তখন। বু‌দ্ধিজীবীরা কিন্তু তবুও শাসক জা‌রের প‌ক্ষে তা‌দের দালালী বন্ধ কর‌লো না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে। বিশ্বযুদ্ধের একদিকে জার্মানী, অস্টিয়া-হাঙ্গেরী, তুরস্ক আর বুলগেরিয়া। ভিন্নদিকে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স আর রাশিয়া। যুদ্ধের ভিতর দিয়ে রাশিয়ার প্রধান একটি লক্ষ্য ছিল তুরস্ককে ভাগবাঁটোয়ার করে নেয়া। কিন্তু জারতন্ত্রই উল্টে গেল। রাশিয়া যুদ্ধে গেছিল বটে, কিন্তু যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার ঠিকমতো প্রস্তুতি ছিল না। তার অর্থনীতি তেমন তেজি ছিল না যে যুদ্ধের চাপ সহ্য করা সম্ভব হবে। কিন্তু মুখে ছিল বড় বড় কথা, বিশ্বে যেন তারাই শ্রেষ্ঠ। ফলে যুদ্ধ যখন শুরু হলো, দেখা গেল ফাঁকা বুলি কাজে লাগছে না। রাশিয়ার বিপদ বাড়তে থাকলো। সামগ্রিকভাবে এই যুদ্ধে রাশিয়া বারবার হারতে থাকলো। রাশিয়ার পশ্চিমী প্রদেশগুলির সাত কোটি মানুষ শত্রুপক্ষের দখলে চলে গেল। তিন বছরের যুদ্ধে বড় শক্তিগুলির মধ্যে রাশিয়ার মতো মার আর কেউ খায়নি। প্রায় তেত্রিশ লক্ষ মানুষ মারা গেল। প্রায় আশি লক্ষ আহত। রাশিয়া মার খাবেই বা না কেন? যুদ্ধের জন্য যে পরিকল্পিত প্রস্তুতি লাগে জার সরকারের তা ছিল না। গোলা-বারুদ, রাইফেল ঠিকমতো জোগাড় হয়নি। তিনজন সৈনিককে একটা রাইফেল দিয়ে বলা হতো ভাগাভাগি করে লড়াই চালাতে। কী আশ্চর্য! যুদ্ধ কি সেভাবে সম্ভব? রুটির অভাবে মানুষ না খেয়ে মরছে, ওদিকে দূর রেল স্টেশনের গুদামে লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যশস্য স্রেফ পরিবহনের অভাবে পচছে। যুদ্ধের বিপুল ব্যয়ভার বহনের জন্য যথেচ্ছ ছাড়া হয়েছিল কাগুজে মুদ্রা। ফলে রুবলের দাম কমে গিয়েছিল।

যুদ্ধের মাঠে একের পর এক হার মানছে রাশিয়া। জার্মানী এগিয়ে আসছে। কিন্তু রাশিয়ার ফৌজদের হাতে রসদ নেই, গোলাবারুদ নেই। শোনা গেল জার মন্ত্রীসভার কেউ কেউ চেষ্টা চালাচ্ছে জার্মানীর সঙ্গে হাত মেলাতে। রাসপুটিন নামে তবলস্ক গুর্বেনিয়া থেকে আসা এক কৃষক নাকি তখন বনে গেছিল ভবিষ্যতদ্রষ্টা কিংবদন্তী। তার কথাতেই তখন জারের মহিষী আর দরবারের অনেক উঠছে-বসছে। সেই রাসপুটিনের কথায় চলছে তখন রাশিয়া। রাসপুটিনের কথায় বা কু-মন্ত্রণায় বারবার মন্ত্রীসভার পরিবর্তন হচ্ছিলো। গরীব মধ্যবিত্তের কথা বাদ দেয়া গেল, বুর্জোয়া আর উচঁতলার মানুষরা পর্যন্ত তখন বীতশ্রদ্ধ জারের উপর। মানুষের মুখে সেই সময়ের প্রবাদ ছিল, “রাশিয়া চালায় জার, জারকে চালায় জারিনা, জারিনাকে চালায় রাসপুটিন”। জার কারো পরামর্শ তখন শুনতেন না রাসপুটিন আর নিজ মহিষী জারিনী ছাড়া। জার কিছুতেই মানতে চাইতেন না তার শাসনে রাশিয়া সঙ্কটের মুখে পতিত। রাশিয়ার ডুমা বা সংসদে তিনি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতেন। ঘটনার ধারাবাহিকতা ১৯১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাতে খুন হলো রাসপুটিন কিন্তু জারের ঘুম ভাঙলো না। বরং সবকিছু সামলাবার জন্য তিনি দমনপীড়ন বাড়িয়ে দিলেন। বিরাট গণ অভুত্থানের ফলে ১৯১৭ সালের দোশরা মার্চ কয়েকশো বছরের জার বংশের পতন হলো। ক্ষমতা ছাড়লের জার দ্বিতীয় নিকোলাস। ক্ষমতা তুলে দিতে চাইলেন ভাই মাইকেলের হাতে কিন্তু জনতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তা পারলেন না। জারের ক্ষমতা ছাড়ার পর বিভিন্ন জন সংসদের প্রধান হয়ে দেশ চালালেন। মন্ত্রী পরিষদের শেষ প্রধান ছিলেন কেরেনেস্কি। ঠিক তারপরেই ঘটলো লেনিন এবং অন্যান্যদের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। দিনটি ছিল পুরানো ক্যালেন্ডারের ১৯১৭ সালের ২২ অক্টোবর আর নতুন ক্যালেন্ডারে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর। বিপ্লবটি সেজন্য “অক্টোবর বিপ্লব” আবার “নভেম্বর বিপ্লব” দুভাবে পরিচিত। বিপ্লবটি অনুষ্ঠিত হয় প্রথম মহাযুদ্ধের ভিতরেই।

বিশ শতকে জারের সব বড় বড় কথাগুলি ছিল আসলে বিড়ালের কণ্ঠে বাঘের হুংকার। বু‌দ্ধিজীবীরা কিন্তু সেই মিথ্যা হুংকারের স‌ঙ্গে কণ্ঠ মি‌লি‌য়ে‌ছিল।