শহিদ জামিল খুনের ৩২ বছর: জামায়াত টু এবিপি- যুদ্ধ এখন কক্ষচ্যুত

প্রকাশিত: ৫:৪৬ অপরাহ্ণ, মে ৩০, ২০২০

শহিদ জামিল খুনের ৩২ বছর: জামায়াত টু এবিপি- যুদ্ধ এখন কক্ষচ্যুত

বাপ্পাদিত্য বসু, ৩০ মে ২০২০ : ৩১ মে শহিদ ডা. জামিল আক্তার রতনের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী। দীর্ঘ ৩২ বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠের বিস্মৃতির অতলে নিশ্চয় তলিয়ে গেছেন তিনি ও তার আত্মদান। তবু হাতে গোনা হলেও কিছু মানুষ তাকে স্মরণ করেন আজও, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাস লিখতে গেলে শহিদ জামিলের আত্মদানের ইতিহাস বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব নয়। শুরুতেই ডা. জামিল আর ১৯৮৮ সালের ৩১ মে’র ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে একটু পরিচিত হওয়া যাক।

সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লড়াই সংগ্রামের অন্যতম যোদ্ধা সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি ছিলেন ডা. জামিল আক্তার রতন। ক্যাম্পাসের অত্যন্ত জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। যে কোনো শিক্ষার্থীর যেকোনো প্রয়োজনে সবার আগে এসে দাঁড়াতেন তিনি। অপরদিকে সে সময়ে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজই কেবল নয়, পুরো রাজশাহীতেই অন্যতম নেতৃত্বের ভূমিকায় তখন তিনি। রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ। আর তার দোসর সাম্প্রদায়িক অপশক্তি জামায়াত-শিবির। মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনাকে হত্যা করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠাদানের লক্ষ্যে সংবিধানের ৮ম সংশোধনী বিল সংসদ নেতা মওদুদ আহমেদ সংসদে উত্থাপন করেছেন ১৯৮৮ সালের ১১ মে। দেশব্যাপী এর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ব্যাপক আন্দোলন চলছে। অপরদিকে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান-অভিমুখী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর প্লাটফরম প্রস্তুত করছেন এরশাদ। আর সামরিকতন্ত্রের সমস্ত রাজনৈতিক ফায়দা নিয়ে পরিপুষ্ট হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তি জামায়ত-শিবির চক্র।

১৯৮৮ সালের ৩১ মে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে তুমুল উত্তেজনা। রগকাটা বাহিনী হিসেবে শিবির ততোদিনে দেশে বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে আবির্ভূত। সেদিন ওই ক্যাম্পাসেও তাদের সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি শিক্ষার্থীরা। কলেজের মেইন হোস্টেলে তাদের সন্ত্রাস চলছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কলেজ প্রশাসন। কলেজের অধ্যক্ষসহ একাডেমিক কাউন্সিলের শিক্ষকরা আহ্বান জানালেন ছাত্রনেতা জামিল আক্তার রতনকে। জামিল জানতেন, তিনি ওখানে যাওয়া মানে নিশ্চিত খুনের শিকার হওয়া। কারণ তিনিই ছিলেন সন্ত্রাসী শিবিরের টার্গেট। কিন্তু নিজের জীবনের চাইতে সেদিন তিনি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করাকেই কর্তব্য স্থির করলেন। জামিল গেলেন এবং শিবিরের নৃশংসতার নির্মম শিকার হলেন। জামিলকে পাওয়ামাত্রই শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা হুইসেল বাজিয়ে ৩৫ জন শিক্ষক আর শত শত শিক্ষার্থীর সামনে তাকে একতরফা হামলা করলো। জামিলকে উপর্যুপরি কোপালো। ইট দিয়ে তার মাথা থেঁতলে দিলো। জামিল নির্জীব হয়ে পড়ে রইলেন। এতেও তারা থামলো না। এরপর তলোয়ার ঢুকিয়ে দিয়ে তার পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলো। এতোটাই বর্বর ও নৃশংস শিবিরের হায়েনারা। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামে শহিদ হলেন ডা. জামিল আক্তার রতন। আর শহিদ জামিলের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে ১৯৮৮ সালের ৭ জুন ৮ম সংশোধনী বিল তথা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বিল পাস হয় সংসদে।

এবার আরেকটু পিছনে যাওয়া যাক। এই ইসলামী ছাত্র শিবির সংগঠনটি মূলত পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী জামায়াত-ই তালাবা পাকিস্তান’ এর বাংলাদেশ শাখা। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও মূলত পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামের বাংলাদেশ শাখা। এদের সদর দপ্তর পাকিস্তানের লাহোরে। ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর কয়েকটি টিভি চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জামায়াতের সাবেক আমীর ও যুদ্ধাপরাধের মামলায় কারাদণ্ড ভোগকালে মারা যাওয়া গোলাম আজম নিজের মুখেই তা স্বীকার করেছে। জামায়াত-ই তালাবা নামের সংগঠনটি জামায়াতের ছাত্র শাখা হিসেবে জন্মলাভ করে ১৯৪৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর। পরে ১৯৫৫ সালের তাদের পূর্ব পাকিস্তান শাখা হিসেবে এটি যাত্রা শুরু করে ইসলামী ছাত্র সংঘ নামে। এই ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়েই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে ‘আল-বদর’ নামে মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হয়। আল-বদর বাহিনীর প্রধান ছিলো মতিউর রহমান নিজামী, পরবর্তীকালে যে জামায়াতের আমীর হয় এবং প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। আল-বদর বাহিনীর আরো তিন সক্রিয় নেতা ছিলো মীর কাশেম আলী, কামারুজ্জামান এবং আব্দুল জাহির মুহাম্মদ আবু নাসের। ব্যাপক বিতর্কের মুখে অবশেষে ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘ তার নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির’ নামে যাত্রা শুরু করে। এর প্রথম তিন কমিটির সভাপতি ছিলো পূর্বোক্ত মীর কাশেম, কামারুজ্জামান এবং আবু নাসের। এদের মধ্যে প্রথম দুইজন ইতোমধ্যেই প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে।

১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্র শিবির নামে যাত্রা শুরুর সময়ই নানা কিসিমের সামরিক কিংবা সামরিক-সমর্থিত সরকারের অনুকূল হাওয়া বাতাস পেয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে শিবির। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড কেবল ব্যক্তিক হত্যাকাণ্ড ছিলো না। বরং মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও আদর্শকেও হত্যা করা হয়েছিলো। মূলত তখন থেকেই আবারো বাংলাদেশের উল্টোরথে যাত্রা শুরু হয় পাকিস্তান অভিমুখে। ফলে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী মোস্তাক-সায়েম-জিয়া-সাত্তারের আমলে ব্যাপক শক্তি অর্জন করে ছাত্র শিবির। এই সরকারগুলো মূলত সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান এবং জিয়া পূর্ববর্তী বা জিয়া পরবর্তী সময়ে জিয়া-ভাবধারারই সরকার। এদের মধ্যে সায়েম-জিয়া-সাত্তারের শাসনকাল সম্পূর্ণ অবৈধ বলে ইতিমধ্যেই রায় দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। এই জিয়া আমলেই রাষ্ট্র ও সংবিধানের পূর্বোক্ত উল্টোযাত্রা শুরু হয়। সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চার মূল স্তম্ভ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র’কে হত্যা করা হয়। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে আসে ‘পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’, সমাজতন্ত্রের বদলে আসে তথাকথিত ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’। আর সংবিধানের প্রস্তাবনায় যুক্ত করা হয় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রবর্তনের সময় ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করেছিলেন, জিয়া তা রদ করেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অধিকার দেওয়ার ফলে জামায়াতে ইসলামী সহ অপরাপর সাম্প্রদায়িক দলগুলো আবারো বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। জিয়া এবং পরবর্তী এরশাদের সামরিক সরকারের আমলে সাম্প্রদায়িকতা নতুন করে প্রাণ পায় এদেশে।

ইসলামী ছাত্র শিবিরও তাই অনুকূল জল-হাওয়ায় পরিপুষ্ট হয়। তারা তাদের পূর্বোক্ত রূপে ফেরত যায়। অস্ত্রের রাজনীতিতে নতুন করে হাত পাকায় তারা। ১৯৮১ সাল থেকেই তারা শুরু করে খুনোখুনি আর রগকাটা রাজনীতি। দেখে নেওয়া যাক ওই সময়কালে শিবিরের সন্ত্রাসের কয়েকটি নজির:

১৯৮১ সালের মার্চে শিবির ক্যাডাররা চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নির্বাচিত এজিএস ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে কলেজ ক্যাম্পাসেই কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিরিচের এলোপাথাড়ি কোপে মুমূর্ষু তবারক যখন ‘পানি পানি’ করে কাতরাচ্ছিলেন তখন এক শিবিরকর্মি তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। সেই থেকে শুরু। এরপর ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তিন বাস ভর্তি বহিরাগত সন্ত্রাসী নিয়ে এসে শিবির ক্যাডাররা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। এই সহিংস ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজের সোহরাওয়ার্দী হলে শিবির কর্মিরা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শাহাদাত হোসেনকে জবাই করে হত্যা করে। ১৯৮৬ সালে নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের প্রভাবশালী নেতা আব্দুল হামিদের ডান হাতের কবজি কেটে নেয়। কর্তিত হাতটি বর্ষার ফলায় গেঁথে তারা উল্লাস প্রকাশ করে প্রকাশ্যে। এরপর ১৯৮৮ সালের ৩১ মে রাজশাহী মেডিকেলে জামিল আক্তার রতন খুন। এর কিছুদিন পরেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাসদ নেতা জালালকে তার নিজ বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করে। ওই বছরেরই ১৭ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে হামলা চালিয়ে সিনেট সদস্য ও জাসদ ছাত্রলীগের সহ সভাপতি আইয়ূব আলী খান, সিনেট সদস্য ও জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আহসানুল কবির বাদল এবং হল সংসদের ভিপি নওশাদের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সিলেটে জাসদ ছাত্রলীগের তিন নেতা মুনির-ই কিবরিয়া, তপন জ্যোতি দেব এবং এনামুল হক জুয়েলকে হত্যা করে। ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিজয় মিছিলে হামলা চালিয়ে ছাত্র মৈত্রীর সহ সভাপতি ফারুকুজ্জামান ফারুককে জবাই করে। ২৪ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। ১৯৯২ সালের ১৯ জুন রাজশাহীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে জাসদের মিছিলে হামলা চালিয়ে জাসদ নেতা মুকিমকে হত্যা করে। ১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের মিছিলে হামলা করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা বিশ্বজিৎ, সাধারণ ছাত্র নতুন এবং ছাত্র ইউনিয়নের তপনসহ ৫ জনকে হত্যা করে। একই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলে হামলা চালিয়ে ছাত্র মৈত্রী নেতা জুবায়ের চৌধুরী রীমুকে হাত-পায়ের রগ কেটে ও কুপিয়ে হত্যা করে। ১৯৯৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের সামনের রাস্তায় ছাত্র মৈত্রী নেতা প্রদুৎ রুদ্র চৈতীর হাতের কব্জি কেটে নেয় এবং সারা শরীরে কুপিয়ে জখম করে। ১৯৯৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী চৌদ্দপাই নামক স্থানে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী সকাল-সন্ধ্যা বাসের ভিতর হামলা চালিয়ে ছাত্র মৈত্রী নেতা দেবাশীষ ভট্টাচার্য রূপমকে যাত্রীদের সামনেই কুপিয়ে ও হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। ১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা-কর্মিদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা ফরহাদের হাতের কবজি কেটে নেয় এবং অন্তত ২৫ জনের রগ কেটে দেয়। ১৯৯৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জাসাসের সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমানকে কুপিয়ে হত্যা করে এবং ছাত্রদল নেতা ডুপ্লের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেও তাদের হত্যা-সন্ত্রাস-রগকাটা বন্ধ করা যায়নি। বরং সমানতালেই তা চলে। এমনকি ওই আমলে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের ছাত্রলীগের ৮ নেতাকর্মিকে মাইক্রোবাসের মধ্যেই ব্রাশফায়ার করে হত্যা করার ঘটনাটি তো বেশ আলোচিত। এর বাইরেও অসংখ্য হত্যা-সন্ত্রাস-রগকাটার বর্বর নজির স্থাপন করে তারা। শিবিরের হত্যা-সন্ত্রাসের আরো বিবরণ দিতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার লেখা যাবে।

২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় এসে দু’টো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পায়। জামায়াতের তৎকালীন আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ মন্ত্রী হবার সুবাদে তাদের সন্ত্রাসবাদ এবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। এবার বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবেই উগ্র সশস্ত্র জঙ্গিবাদের রূপ নেয়। শুরুতে সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই এবং শায়খ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বাধীন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং মুফতি হান্নানের নেতৃত্বাধীন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) সহ বিভিন্ন উগ্র জঙ্গি সংগঠন রাষ্ট্রীয় মদদে জঙ্গিবাদের আস্তানায় পরিণত করে বাংলাদেশকে। আর তার সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে ও ওই সরকারের নেপথ্য চালক তারেক রহমানের সরাসরি মদদ এসব জঙ্গিগোষ্ঠীকে প্রচণ্ড শক্তিদান করে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোও এদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), সেনা গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই), পুলিশ সহ অন্যান্যা সংস্থাগুলোও এসব জঙ্গিবাদের প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলার রায় এবং ওই মামলার আসামী তালিকা বিশ্লেষণ করলেই এর সত্যাসত্য পরিষ্কার হয়। এসব রাষ্ট্রীয় সংস্থার তৎকালীন কর্তা ব্যক্তিগণ থেকে শুরু করে সরকারের খোদ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, এমনকি তারেক রহমানের নিশ্চিত জড়িত থাকার প্রেক্ষিতে সাজাপ্রাপ্তির ঘটনা গভীর চিন্তার দাবি রাখে। ওই আমলের দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ওই সময় জঙ্গিবাদের বাড়বাড়ন্ত সত্বেও সরকারপ্রধান খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে জামায়াতী মন্ত্রী নিজামী-মুজাহিদরা বহুদিন পর্যন্ত জঙ্গিবাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এসেছেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে যখন তাকে আর আড়াল করা সম্ভব হয়নি, তখন লোকদেখানো কিছু অভিযান চালিয়ে বাংলা ভাই-শায়খ রহমানদের দমন করতে বাধ্য হয়। ওইসব জঙ্গি নেতাদের আদালতে দেওয়া জবানবন্দী বিশ্লেষণ করলেও সরকার তথা রাষ্ট্রীয় মদদপ্রাপ্তি পরিষ্কার হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই যেমন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, ঠিক একই আদলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে ওই আমলে সন্ত্রাসবাদের প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। আবার এসব জঙ্গি নেতা ও সংগঠকদের অধিকাংশই এসেছে জামায়াত-শিবির থেকে। শুধু তারাই নয়, এখন পর্যন্ত দেশে যতো সশস্ত্র জঙ্গি ধরা পড়েছে, বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের সিংহভাগই জামায়াত-শিবিরের কর্মি।

জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির এদেশের সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধ ও তার মৌলিক চেতনাকে অস্বীকার করে। আল্লাহর আইনের নামে তারা প্রকৃতপক্ষে পলিটিক্যাল ইসলাম তথা মওদুদীবাদী-ওয়াহাবী মতবাদকে জবরদস্তি করে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে আবারও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে একটানা এতোদিন বিদ্যমান আছে। এই সময়কালে দেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি মোটামুটি কোণঠাসা অবস্থায় আছে। বলা চলে, নিষিদ্ধ না হলেও তাদের প্রকাশ্য কোনো কার্যক্রম চালানোর সুযোগ আর অতীতের মতো নেই। জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তথা মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের হোতারা ইতিমধ্যেই বেশিরভাগই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছে। এই অবস্থায় স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ধরে নেওয়া যায় যে জামায়াতের রাজনীতির আদতে মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? জামায়াত-শিবিরকে কিন্তু এখনও পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জামায়াত সেই পাকিস্তান আমল থেকে দফায় দফায় নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু যখনই নিষিদ্ধ হয়েছে তখনই ভোল পাল্টে অন্য কোনো ছাতার তলে তারা বারবার আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে জামায়াত-শিবির কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর তিনটি ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। প্রথমত তারা আওয়ামী লীগের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। দ্বিতীয়ত তারা হেফাজতে ইসলামের ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছে। তৃতীয়ত তারা রঙ বদলে নতুন করে নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করেছে।

আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে এবং দেশে কার্যকর কোনো বিরোধী দল না থাকার কারণে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে নানামুখী বিরোধ তৈরি করে নিয়েছে। নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব আর ক্ষমতাবাজির বদঅভ্যাস আজ তাদের অনেকাংশেই গ্রাস করেছে। এই ক্ষমতাবাজির মোহ জিইয়ে রাখতে গিয়ে স্থানীয় থেকে কেন্দ্রীয়- সব পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারা দলবাজি-গ্রুপবাজিতে জড়িয়েছেন। দলবাজিতে শক্তিধর হতে গিয়ে তারা বিপুল সংখ্যক জামায়াত-শিবির কর্মিকে নিজেদের গ্রুপে ভিড়িয়েছেন। তারা হয়তো মনে করছেন, ক্ষমতার রাজনীতিতে এটাই উৎকৃষ্ট পথ। কিন্তু এতে করে যেটা হয়েছে, তা হলো- আগে যেখানে শত্রু চিহ্নিত ছিলো পরিষ্কার, এখন শত্রু ভোল পাল্টে নিজেদের ঘরেই ঢুকে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের দ্বারা শত্রু চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই রঙ বদলানো জামায়াতী লীগেরা তৃণমূল পর্যায়ের শাসনব্যবস্থা থেকে শুরু করে পার্লামেন্টেও ঢুকে পড়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন আবার রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে আগাবে, তখন কোনোভাবেই এই জামায়াতী লীগেরা যে শেখ হাসিনার সঙ্গী হবে না- এটা হলফ করেই বলে দেওয়া যায়। ঝাঁকের কইয়ের মতো এতো বিপুল সংখ্যায় জামায়াত-শিবির এখন আওয়ামী লীগের ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে যে তাদের চিহ্নিত করে বের করে দেওয়াটাও আর এখন সোজা কাজ নয়। আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের ক্ষমতাবাজির খায়েশে অন্ধের মতো এদের দলে ভিড়ালেও এরা কিন্তু একদম সাংগঠনিক পরিকল্পনামাফিক এ রঙ বদলের কাজটি করেছে।

অপরদিকে ২০১৩ সালের প্রথমার্ধ থেকে জামায়াত-শিবির দুর্বল হতে শুরু করলো যখন, বিশেষ করে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়, তখন তাদের দ্বিতীয় কর্তব্য স্থির করতে তারা খুব একটা দেরি করেনি। অত্যন্ত সন্তর্পণে তারা হেফাজতে ইসলাম নামক বৃহত্তর ছাতার নিচে সাম্প্রদায়িক ও ইসলামভিত্তিক সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিকে এক করে ফেললো। অপরাপর ইসলামীপন্থী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জামায়াতের তরিকাভিত্তিক বিভক্তি ও ভিন্নমতের গল্প যতোই প্রচার করা হোক না কেন, জামায়াতের কৌশলের কাছে বিরুদ্ধ শক্তি এসব ব্যাপারে নিতান্তই শিশু। ফলে আহমেদ শফিকে সামনে রেখে মূলত জামায়াতীরাই হেফাজতে ইসলামের নিয়ন্তা হয়ে উঠলো। এই হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে সরকার শুরু থেকেই দ্বিমুখী ভূমিকা নেয়। শুরুতেই ইসলামী শক্তিকে না ঘাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের তোয়াজ করা শুরু করে সরকারপক্ষ। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী পর্যন্ত এইসব তোয়াজের কাজে নিয়োজিত হন। তারা আহমেদ শফির দরবারে গিয়ে তার পায়ের কাছে মাথানত হয়ে বসে থাকেন। চট্টগ্রামে ও ঢাকায় তাদের সমাবেশ আয়োজনে সহায়তা এবং নানা ধরনের আর্থিক সহায়তাও করা হয়। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম যখন জামায়াতী রূপ ধারণ করে মতিঝিলের শাপলা চত্বর দখল করে রাষ্ট্র দখল ও সরকার পতনের অবস্থানে চলে যায়, তখন কঠোর হাতে সরকারে তাদের দমন করে। তবে পরে ‘জামায়াত-শিবিরমুক্ত’ বাংলাদেশে অপরাপর ইসলামী শক্তিকে হাতে রাখার লাইন গ্রহণ করে শেখ হাসিনা সরকার। একটা পর্যায়ে এই হেফাজতে ইসলাম সরকারের আস্কারা পেয়ে পেয়ে এমন অবস্থান আজ পৌঁছেছে যে তাদের দাবির উপরই পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নীতি নির্ভর করছে। এটাও এই সরকারের মারাত্মক ভুল এবং এই ভুলেরও খেসারত সরকারকে বড় কিছুর বিনিময়েই দিতে হবে। পূর্বোক্ত চূড়ান্ত রাজনৈতিক মেরুকরণের সময় এইসব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সামান্যতম পক্ষপাতও আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকবে না- এটাও হলফ করে বলা যায়।

জামায়াতের তৃতীয় কৌশল হলো পুরোপুরি খোলস বদলে নতুন নামে আবির্ভূত হওয়া। জামায়াতের অভ্যন্তরীণ বিরোধ হিসেবে একে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হলেও তা মূলত পরিপূর্ণ আইওয়াশ ছাড়া কিছুই নয়। জামায়াতের কতিপয় নেতা নতুন করে ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবিপি)’ নামে এক নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এই নতুন সন্তানের আসল বীর্য জামায়াতেরই বটে। জামায়াত-শিবিরের ঔরসজাত কোনো সন্তান অন্য কোনো চরিত্র ধারণ করবে- এটা ভাবা বোকার স্বর্গে বাস করারই নামান্তর। প্রমাণিত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রাক্তন সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু যে দলের সাধারণ সম্পাদক, যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতের অন্যতম থিঙ্কট্যাঙ্ক ব্যারিস্টার ড. আব্দুর রাজ্জাক যাদের ভাবগুরু, তারা জামায়াতের মতাদর্শ বৈ অন্য কিছু ধারণ করবে- এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সরকার এখানেও তাদের কৌশলের ফাঁদে পা দিয়েছে। জামায়াত যেখানে কোণঠাসা, সেখানে নতুন জামায়াত তথা এবিপি এবং তাদের প্রি-প্রাকটিসিং প্লাটফরম জনআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ স্বাচ্ছন্দ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারছে। এমনকি এই করোনাকালে যেখানে সরকারি দল আওয়ামী লীগ তাদের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে, সেই সময়ে এসে এবিপি’র জন্মঘোষণা এবং পরবর্তীতে একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্বিঘ্নে পালন করা সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব না। জামায়াত-শিবিরের বিপরীতে নতুন মডারেট ইসলামী গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে বিরোধী পক্ষের জন্য প্লাটফরম দাঁড় করানোর সুযোগ তৈরি করে দেওয়া আবারও সরকারের বিরাট ভুল হলো। শেখ হাসিনা যদি একে আপাত নিরাপদ কৌশল হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে থাকেন, তবে সেই একই কথার পুনরাবৃত্তিই করতে হবে- চূড়ান্ত রাজনৈতিক মেরুকরণের সময় সবচেয়ে বড় ছোবল এদের দ্বারাই আসবে।

পরিষ্কারভাবে মনে রাখতে হবে- ধর্মতন্ত্রের বিপরীতে কোনো ধর্মতন্ত্র দিয়ে লড়াই করা যায় না। লড়তে হবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেই ভিত্তি করে। সংবিধান সংশোধন করে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি তথা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র’ ফিরিয়ে আনবেন, অপরদিকে ইসলামোফোবিয়াকে ভয় পেয়ে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বহাল রাখবেন, তাতে করে যুদ্ধ জিততে পারবেন না, পারবেন না, পারবেন না। ধর্মের মোড়কে নিজেদের আবদ্ধ করে কখনোই এ যুদ্ধে জেতার কোনো লাইন নেই। পলিটিক্যাল ইসলামের এই মাজেজা অনুধাবন করতে না পারলে আপাতত ২০২১ সাল কিংবা শেখ হাসিনার জমানা হয়তো পার করতে পারবেন, কিন্তু তার পরবর্তী যুগের জন্য যে রাজনৈতিক মহাঝুঁকি তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছেন, এর মাশুল আওয়ামী লীগকে কেবল না, মেটাতে হবে বাংলাদেশকে।

শহিদ ডা. জামিল আক্তার রতনের এই ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এসে অন্তত সেই সত্যটুকু অনুধাবন করার চেষ্টা করুন।

_______________
লেখকঃ
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী
সাধারণ সম্পাদক, ইয়ুথ ফর ডেমোক্রেসি এন্ড ডেভেলপমেন্ট

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ