ভূমিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করুন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ১:৪৯ অপরাহ্ণ, মে ৩১, ২০২০

ভূমিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করুন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী

ফজলুল বারী, সিডনি (অস্ট্রেলিয়া), ৩১ মে ২০২০ : করোনা মহামারী যখন দেশে চূঁড়ার দিকে ধাবমান তখন চব্বিশ ঘন্টায় চল্লিশজন মরলো না আড়াই হাজার আক্রান্ত হলো এ নিয়ে চিল্লাচিল্লি করে লাভ নেই। দেশের আমজনতাকে দেখাতে হবে তারা করোনার কারনে মৃত্যু ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত।

একটা দেশের ক্ষমতাসীন সরকার নাগরিকদের সতর্ক করতে পারে। নিশ্চিত করতে পারে মহামারী মোকাবেলার নানান ব্যবস্থা। কিন্তু নাগরিকদের মধ্যে মৃত্যুভয় ছড়ানো সরকারের কাজ নয়।

টেলিভিশনগুলোয় দেখুন দেশের প্রিয় তারকারা নানাভাবে বিরামহীন বলে যাচ্ছেন, ঘরে থাকুন। বাংলাদেশে করোনা হামলার শুরুর সময় সেই মার্চ থেকে জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা স্থগিত করে একই আবেদন জানানো হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল থেকে শুরু করে নানান নেতৃবৃন্দ একই আবেদন জানিয়ে আসছেন। কিন্তু বাংলাদেশের আমজনতার এখন পর্যন্ত কোন কাজে এমন প্রমান নেই যে তারা এই পরিস্থিতিতে মৃত্যভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত।

তারা চাকরি-বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেন! এরমাঝে তারা ধুমসে ঈদ শপিং, ঈদে বাড়ি যাতায়াতও করেছেন! যেন এসব করোনা ফরোনাকে তারা থোড়াই কেয়ার করেন! কেয়ার যদি করতেন তারা এখন কলকাতার মতো বিক্ষোভ করতেন!

এই মহামারীর সময়ে নানাকিছু খুলে দেবার নিউজ দেখে এর প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ পরিবারের সদস্যরা বিক্ষোভ করেছেন। কারন এতে করে তাদের পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন। মরছেন।

মানুষের মধ্যে মহামারীর মৃত্যুভয় যদি সৃষ্টি হতো তাহলে এই পরিস্থিতিতে সরকারের সবকিছু খুলে দেবার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাংলাদেশের আমজনতাও বিক্ষোভ করতো। তেমন বিক্ষোভ বাংলাদেশে হবে বলেও মনে হয়না।

বাংলাদেশে বিক্ষোভ হলো সরকার তা আমলে নিতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটা বিভিন্ন সময়ে বলেনও। প্রধানমন্ত্রী মাঝে মাঝে বলেন, আপনারা আন্দোলন করার আগেই আমি এটা সেটা দিয়ে দিয়েছি। বা আন্দোলন করলে দেবো।

এরমাঝে বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য একটি ঘটনা ঘটেছে! যেখানে নিউজ হয় এই করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্ঘুম রাত কাটান সেখানে দেশের এই নাজুক পরিস্থিতির ভিতর বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান করেছেন এক মন্ত্রী!

অঘোষিত লকডাউনের মধ্যে সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সামাজিক দূরত্ব না মেনে বাকদান অনুষ্ঠান হয়েছে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাড়িতে! এতে মন্ত্রীর পরিবার, এক এমপির পরিবার মিলিয়ে উপস্থিত ছিলেন ৭০-৮০ জন!

আর দেশের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির দায়িত্ব-কান্ডজ্ঞানহীন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন চট্টগ্রামের দু’জন গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি সহ কমপক্ষে দশ জন! বলা হচ্ছে দুই পরিবারের সবার টেস্ট হলে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়তে পারে।
এর আগে চট্টগ্রামে তিন জন মিলে বিয়ে করতে যাবার ঘটনা প্রশাসনের উদ্যোগে জরিমানা, পন্ড, সংশ্লিষ্টদের কোয়ারিন্টানে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু এই মন্ত্রী যেন প্রমান দিতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের আইন সবার ক্ষেত্রে সমান নয়!
এখানে মন্ত্রীর জন্যে এক আইন! আমজনতার জন্যে আরেক আইন! নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা মনে করেননা। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের মেয়ে জেবা জামান চৌধুরীর বিয়ে উপলক্ষে অনুষ্ঠানটি হয়।
আইন ভঙ্গ করে আয়োজিত বিয়ের পাত্র এস আলম শিল্পগ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ লাবুর ছেলে আতিকুল আলম। বাংলাদেশে বিয়ে একটি ছেলে ও মেয়ের আইনানুগ সম্পর্কের বৈধ সনদপত্র।
কিন্তু মন্ত্রিত্বের দাপট দেখাতে গিয়ে এই ছেলেমেয়ের বিয়েটাই অবৈধপন্থার মাধ্যমে শুরু হলো! মন্ত্রীর চট্টগ্রামের সার্সন রোডের বাড়ির বাকদানে উভয় পরিবারের প্রায় সত্তুর জন উপস্থিত ছিলেন!
ওই বিয়ের অনুষ্ঠানের পরপরই এস আলম পরিবারের ৯ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হন। আক্রান্ত হন বিয়ে পড়াতে আসা বায়তুশ শরীফের পীর মাওলানা শাহ কুতুব উদ্দিনও। মন্ত্রীর ভয়ে প্রশাসন এখানে চুপ মেরে গেলেও নিয়তির শাস্তি থেকে তিনি বাদ যাননি!
ঢাকার আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০ মে মারা যান বিয়ে পড়ানো হুজুর পীর মাওলানা শাহ কুতুব উদ্দিন। এস আলম গ্রুপের ব্যবসা-বিয়ে সহ নানান শুভকাজে বরাবর এই পীরের দোয়া নিয়ে শুরু করানো হতো।
এবার এই বেআইনি সময়ের বিয়ে পড়াতে এসে প্রান হারালেন সেই পীরও! এস আলম পরিবারের আক্রান্ত অন্যরা চট্টগ্রাম মহানগরীর সুগন্ধা এলাকার বাড়িতে আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
পাত্রের চাচা অর্থাৎ এস আলমের বড় ভাই ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের পরিচালক মোরশেদুল আলমের অবস্থার অবনতি ঘটলে ২২ মে তাকে স্থানান্তর করা হয় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে।
সেখানকার আইসিইউতে আগে থেকে চিকিৎসাধীন ছিলেন পাত্রের আরেক চাচা রাশেদুল আলম। আইসিইউর শয্যা সংকটে রাশেদুল আলমকে সরিয়ে সেখানে মোরশেদুল আলমকে শুইয়ে অক্সিজেন দিয়েও বাঁচানো যায়নি।
মোরশেদুল আলমের শোক সংবাদ সেই থেকে দেশের বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়ায় ভাসছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিয়েতে গিয়ে সাইফুল আলম মাসুদের ৮৫ বছর বয়সী মা চেমন আরা বেগমও আক্রান্ত হয়েছেন।
আক্রান্ত অন্যরা হলেন এস আলম গ্রুপের পরিচালক রাশেদুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ লাবু, পরিচালক মো শহীদুল আলম, পরিচালক ওসমান গনি, ৩৬ বছর বয়সী এক নারী সহ ৯ জন।
তাদের ৭ জনকে ঢাকার ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বিয়েতে গিয়ে প্রান হারানো মোরশেদুল আলমের ছেলে মাহমুদুল আলমের স্ত্রী ইশফাক আরা জাহান রাফিকাও সেখানে নতুন যোগ দিয়েছেন।
এই রাফিকা আবার চট্টগ্রাম-৪ আসনের এমপি দিদারুল আলমের মেয়ে। ভূমিমন্ত্রীর পরিবারের কয়জন করোনায় আক্রান্ত সে তথ্য চেপে যাওয়া হচ্ছে। বলাও হচ্ছেনা যে তার পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়নি।
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের চার ভাইর দু’জন এরমাঝে করোনা মুক্ত হয়েছেন। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী আর এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলম মামাতো-ফুফাতো ভাই।

আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর বোন চেমন আরা বেগম সাইফুল আলম মাসুদের মা। আরামিট গ্রুপ তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।
স্বাভাবিক অন্য সময় হলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এস আলম গ্রুপের একজন পরিচালকের মৃত্যুতে শোকের বন্যা বয়ে যেত। কারন দেশে তাদের নিমক খাওয়া লোকজনের সংখ্যা কম নয়।
কিন্তু বিয়েটি যেহেতু একটি নিষিদ্ধ সময়ের সে জন্যে করোনা আক্রান্তের শুরু থেকে কে কিভাবে খবরটি লুকোবেন তা নিয়েই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বুদ্ধিমান অনেক মূলধারার মিডিয়াও সরকারের আইন ভঙ্গ করে বিয়ের খবরটিও চেপে গেছে!
এরআগে করোনা বিধি লংঘন করে বিয়ের অনুষ্ঠান পন্ড করে প্রশাসনের যারা গৌরব কামিয়েছেন তারাও চাকরি রক্ষায় চেপে গেছেন এই ঘটনা। উন্নত সভ্য বিশ্বে এমন আইনভঙ্গের খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করতেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী।
কিন্তু বাংলাদেশের এই মন্ত্রী সে যোগ্যতায় উত্তীর্ন হতে পারেননি। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে স্রেফ ফাজলামো করেছেন। করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে যেখানে নির্ঘুম রাত কাটান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেখানে এই মন্ত্রীর ভূমিকা ফাজলামো ছাড়া আর কী?
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলবো এমন কান্ডজ্ঞানহীন মন্ত্রীকে আপনি বরখাস্ত করুন। অথবা পদত্যাগ করতে বলুন। তার বাবা’র প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপনি তাকে মন্ত্রী করেছিলেন। কিন্তু এই মন্ত্রী আপনার কৃতজ্ঞতার মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন।