করোনা-উত্তর রাষ্ট্রভাবনার খসড়া আলোচনা সূত্র

প্রকাশিত: ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ, জুন ৯, ২০২০

করোনা-উত্তর রাষ্ট্রভাবনার খসড়া আলোচনা সূত্র

Manual1 Ad Code

ফজলে হোসেন বাদশা, ০৯ জুন ২০২০ : ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরিত্র বাংলাদেশের জনগণের কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে যায়। সেদিন মজলুম জননেতা ভাসানী বলেছিলেন, ‘ওরা (পাকিস্তানি) কেউ আসে নাই’। সেই দুর্যোগের কালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অমানবিক উপেক্ষা আর তা থেকে সৃষ্ট আস্থাহীনতা আজকের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মে ভূমিকা রাখে নিঃসন্দেহে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। আমরা চেয়েছি এই রাষ্ট্রে সব মানুষের অধিকার থাকবে।

Manual3 Ad Code

সংবিধানে স্পষ্ট লেখা আছে, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। কিন্তু করোনার এই মহামারীকালে আমাদের রাষ্ট্রের বহু ঘটনায় সংশয় জেগেছে, রাষ্ট্রটা কাদের নিয়ন্ত্রণে। ঋণ না দেওয়ায় ব্যাংককর্তাকে হত্যাচেষ্টায় অভিযুক্তরা দিব্যি বিমানযোগে দেশ ছাড়ে। ফ্লাইট বন্ধ থাকলেও পয়সা খরচ করে বিমানভাড়া করে বিদেশে যখন যাওয়াই যাচ্ছে, তখন সংশয় তৈরি না হওয়ার কোনো কারণ কি আছে?

Manual5 Ad Code

আবার খোদ রাষ্ট্রীয় কিছু সিদ্ধান্ত প্রশ্ন তুলছে, রাষ্ট্রটা কি সব মানুষের জন্য? যেমন গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ব্যক্তিগত গাড়ি চলেছে ঈদকালে। এটি কি সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত হলো? আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটা বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে। কিছু মানুষের সব সুবিধা, কিছু মানুষের কোনো সুবিধাই নেই। একটা সাম্প্রতিক বিতর্ক খুব চাউর হয়েছে, জীবন আগে নাকি জীবিকা? এর অর্থ একটা শ্রেণি তাদের স্বার্থে শ্রমজীবী মানুষকে মরীচিকার পেছনে ঠেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ কোনটি আগে, তার চেয়ে বড় কথা, জীবন ও জীবিকা দুটোরই দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এক্ষেত্রে প্রণোদনা বা সুবিধা প্রদানের যে যজ্ঞ দেখেছি তা জীবন ও জীবিকা উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কিন্তু সেখানেও ভারসাম্যহীনতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

আজ সবাই বলছেন, কৃষিই আমাদের রক্ষা করতে পারে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও দেশে তিন কোটি টনেরও বেশি চাল উৎপাদন হতে পারে। কিন্তু ধান ক্রয়ের নীতি কী হবে? পূর্বের মতোই মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য থাকবে? কৃষকরা এবারও কি সরকারের ধান ক্রয়ের প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হবেন? তারা কি ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন? এখানেও যারা উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি তারা সংকটে আছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-এবার ধান ক্রয় করা হবে লটারির মাধ্যমে। এ কোন পদ্ধতি? অর্থাৎ কৃষকরা পড়বে আরেক নতুন অনিশ্চয়তায়! কৃষকদের দিশাহারা করার এ এক চৌকস পদ্ধতি বটে! এই লটারির অভিজ্ঞতা কৃষকদের আছে।

গত মৌসুমেও ‘কৃষক’দের কাছ থেকে ধান ক্রয় করা হয়েছিল মাত্র ২৯ শতাংশ। এসব বিক্রেতা মূলত মিল মালিকরা, কৃষকরা নয়। গত বছরের তুলনায় এবার ধান উৎপাদন বেশি হয়েছে ৩ কোটি ৬৪ লাখ মেট্রিক টন। ফলে এবার এই করোনাকালীন পরিস্থিতিতে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় কৃষক রক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকের কৃষিকার্ড দিয়ে একেবারে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ধান ক্রয় করার নীতি গ্রহণ করা জরুরি। কোনো মধ্যস্বত্বভোগী, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ যাতে কৃষকের ক্ষতি করতে না পারে। আমাদের কৃষকরাই আমাদের দেশকে রক্ষা করবে, দেশের জনগণকে খাদ্যে বাঁচিয়ে রাখবে।

Manual3 Ad Code

বাজার অর্থনীতির ফাঁদে ফেলার নতুন কৌশলে কৃষকদের খাবি খাইয়ে, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে বাদ দিয়ে যে কারখানা চালু রাখা যায় না, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। এখন এই মহামারীতে মাস্ক পরা সাধারণ মানুষগুলোর চোখের সামনে বৈষম্য ও লুটেরা পুঁজিতন্ত্র মানবজীবনকে কতটা বিপদে ফেলছে তা ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেন মধ্যম আয়ের মতো একটি দেশ তার সরকারি হাসপাতালগুলোতেও করোনা চিকিৎসার আইসিইউ, ভেন্টিলেশন প্রয়োজন মাফিক দিতে হিমশিম খাচ্ছে; এমনকি পর্যাপ্ত মাস্ক দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে-জনমনে এ নিয়ে গভীরভাবে প্রশ্ন উঠেছে। খোদ রাজধানী ঢাকায় এত এত সব বিশাল পুঁজির ব্যক্তি মালিকানাধীন হাসপাতাল গড়ে উঠেছে।

করোনাকালে এগুলোর একটিও কি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে? সরকারি হাসপাতালগুলো নিয়েই বা অভিজ্ঞতা কতটা সুখকর? এ দেশেরই একজন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন করোনা পজিটিভ হয়ে চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালকে বেছে নেন, তখন পরিস্থিতি আঁচ করতে কষ্ট হয় না। এটি কি রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংকট নয়? বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দুই-দুটি সামরিক স্বৈরাচার ও জামায়াত-বিএনপির চরম প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের বিরুদ্ধে চরম সংগ্রাম করতে হয়েছে দেশের জনগণকে। শুধু মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এই লড়াই করেছে মানুষ। এদিকে এখন আমরা প্রতিনিয়ত শুনছি বাংলাদেশের উন্নয়নের আরেক গল্প। অনেকেই বলেছেন, বাংলাদেশ কানাডা-আমেরিকার মতো হয়ে যাবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে বিশ্বাসী। আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে আস্থা রেখে পথ চলার সংগ্রাম এখনো চালিয়ে যাচ্ছি।

করোনাকালে আমেরিকার মতো তথাকথিত উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুুখি হতে হয়েছে। সেখানে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা সব থেকে বেশি। কিন্তু এসব মৃত মানুষের সিংহ ভাগই অতি দরিদ্র। তাদের ৬০ শতাংশ নিম্নআয়ের কালো মানুষ অথবা বাদামি কিংবা এশিয়ান শ্রমজীবী মানুষ। এদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছেন। আমেরিকার দুরবস্থা আমাদের দৃষ্টি খুলে দিয়েছে। প্রতিবেশী ভারতের অর্থনীতির ও রাষ্ট্রের দরিদ্র-শ্রমজীবী জনগণের প্রতি আচরণ আমরা দেখেছি। শ্রমজীবী মানুষ দলে দলে শত মাইল পথ চলেও নিজ বাড়িতে পৌঁছতে পারেনি। ক্লান্তি ও ক্ষুধায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। ফলে পৃথিবীতে আজ উদার পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর কাছে দীক্ষা গ্রহণের কিছু নেই। আমাদের আবার ফিরে তাকাতে হবে সেই মুক্তিযুদ্ধের উন্নয়ন দর্শনের দিকেই।

নতুন করে এই সংকটে নাগরিকদের সার্বজনীন মৌলিক প্রয়োজনীয়তা তথা খাদ্য, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, বাসস্থান ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রকে কত গভীর মনোযোগী হতে হবে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। ‘সামাজিক নিরাপত্তা জাল’ নামে যে কর্মসূচি আছে তা পর্যাপ্ত নয়, এতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দৃষ্টিভঙ্গিগত সংকট আছে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে আরও গতিশীল ও শক্তিশালী করতে হবে। আসন্ন বাজেটে সার্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও গবেষণায় ব্যয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। আয় সহায়তা, বেকারত্ব ভাতার বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে নিঃসন্দেহে। নিম্নআয়ের মানুষ, যাদের আয় মাসিক ৫০ হাজার টাকার নিচে, তাদের আয়কর আওতার বাইরে রাখতে হবে। সম্পদশালী ব্যক্তিদের ওপর সম্পদ কর আরোপ করতে হবে। পাশাপাশি অতি অবশ্যই ধনীদের ওপর আরোপিত কর আদায়ে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

Manual2 Ad Code

মনে রাখা প্রয়োজন, রাষ্ট্রের প্রকৃতি, রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের আন্তঃসম্পর্ক এবং সামাজিক রূপান্তরে রাষ্ট্রের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তনবাদী জনগণ অথবা প্রগতিশীল মানুষের কাছে রাষ্ট্রের ভূমিকা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

ইতিহাস সাক্ষী, একেকটা মহামারী পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে। পাল্টেছে রাজনীতি, বিশ্ব নেতৃত্ব, শুধু তাই নয়, উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গিও। বর্তমান বিশ^ মহামারী অনেক ইঙ্গিতই দিচ্ছে। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করতে চাই না; কিন্তু প্রত্যাশা করি-বিশ্বে নতুন শুভশক্তির আগমন ঘটুক। যে শক্তি মানুষের জন্য, মানবিকতার জন্য, মানুষকে ভালোবাসার জন্য, মানুষকে সুরক্ষার জন্য একটি নতুন পৃথিবী গড়ে তুলবে।

#
ফজলে হোসেন বাদশা এমপি
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code