সিলেট ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৪:৪৫ অপরাহ্ণ, জুন ১৭, ২০২০
অার কে ব্যানার্জি, ১৭ জুন ২০২০ : জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং এর রাজনৈতিক অর্থনীতিঃ কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা১) ১৯১৮ সনে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের বুকে সর্ব প্রথম ঘোষণা করে যে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক জন্ম থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সব ধরনের চিকিৎসা সুবিধা পাবেন এবং এটা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র নিজেই। শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র ব্যবস্থা জনগণের এই অধিকারকে “সাংবিধানিক অধিকার” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলো।
মহান অক্টোবর বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে সূচিত হয়েছিলো সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক বিনির্মাণের এবং এর নেতৃত্বে ছিলেন শ্রমিক শ্রেণী ও তাঁর প্রধান হাতিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টি। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিটি ক্ষেত্র তথা বৃহৎ ও মাঝারী কল কারখানায় উৎপাদন ও পরিচালনা থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত এক নয়া গণতন্ত্র তথা শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়, এবং স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতও এর আওতাধীন ছিল। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাত জনগণের উপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে গড়ে তোলা হয় একটি ত্রিভুজ তথা পিরামিড আকৃতির পরিচালন ব্যবস্থা, যার ভিত্তি ব্যাপক ব্যাপ্তি নিয়ে গড়ে উঠেছিলো। এই ভিত্তি মুলের অন্তর্গত ছিল হাজার হাজার কমিটি যা গড়ে উঠেছিলো বিভিন্ন কল-কারখানা, যৌথ কৃষি খামার, এবং সব ধরনের অন্যান্য কর্মক্ষেত্র তথা প্রতিষ্ঠানে। এই কমিটি গুলোর কাজের ক্ষেত্রের উল্লেখ যোগ্য দিক গুলোর মধ্যে ছিল ১) স্থানীয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়মমাফিক তথ্য উপাত্ত প্রদান এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নে মতামত জ্ঞাপন, ২) রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অন্তর্গত শ্রমজীবী মানুষের জন্য “সামাজিক বীমা ফান্ড” এর যথাযথ ব্যবহার সুনিশ্চিত করণ, ৩) নিজেদের কর্মস্থলের সকল কর্মীর যথাযথ ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করণ, এবং ৪) প্রতিটি কর্মস্থলে স্বাস্থ্য ও এ সংক্রান্ত বিধি বিধান সঠিক ভাবে প্রতিপালনের জন্য নিয়মিত কর্মশালা, সেমিনার এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা। এই গণ কমিটি গুলো থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়ে উঠেছিলো পরবর্তী ধাপের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাত পরিচালন সংগঠন – যা পরিচিত ছিল স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাত সংক্রান্ত সোভিয়েত নামে। শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত গুলোর কাজের পরিধির অন্তর্ভুক্ত ছিল, ১) সমগ্র দেশের হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও পরিদর্শন, ২) ব্যাপক পরিসরে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংক্রান্ত নিয়মিত কর্মশালা, সেমিনার এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ইত্যাদি। পিরামিড আকৃতির এই পরিচালন ব্যবস্থার তৃতীয় ধাপের অংশ হিসেবে সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে আবৃত করে ৩০০০ হাজার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রেয়ন / জেলা প্রতিষ্ঠা করা হয়, এবং প্রতিটি রেয়ন / জেলার জন স্বাস্থ্যের দায়িত্বে ছিল একটি করে জন স্বাস্থ্য বিভাগ যার প্রতিনিধি নির্বাচিত হত সোভিয়েত সমূহ থেকে। জন স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বের মধ্যে ছিল জেলার অন্তর্গত সকল ধরনের মেডিকেল প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিচালনা, এবং পরিদর্শন। পিরামিড আকৃতির পরিচালন ব্যবস্থার শেষ ধাপটি ছিল জন স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিসারেট বা মন্ত্রণালয় এবং এই প্রতিষ্ঠানটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হত।
জন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত এই বিপুল কর্ম যজ্ঞ তথা সমগ্র দেশের শ্রমজীবী মানুষকে সম্পৃক্ত করার ফল শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়ন খুব দ্রুতই লাভ করতে থাকে, ১৯৩৭ সনের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিত চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৩৭,০০০ জনে এবং বিপ্লব পূর্ববর্তী জার শাসিত রাশিয়াতে চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২,০০০ জন। বিপ্লব পরবর্তী এই বিপুল সংখ্যক চিকিৎসা কর্মীর প্রায় পুরো অংশটাই এসেছিলেন কারখানা শ্রমিক ও গরীব কৃষক পরিবার থেকে। জার শাসিত রাশিয়ায় শিশু ও মাতৃত্ব কালীন সেবা দানের সেন্টার ছিল মাত্র ৯ টি, এর বিপরীতে শ্রমিক শ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৩৮ সনের মধ্যে গড়ে তুলেন ৪,৩৮৪ টি শিশু ও মাতৃত্ব কালীন সেবা দান সেন্টার। এবং দ্বিতীয় পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনা যথা সময়ে বাস্তবায়নের ফলে দেখা গেল সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে সব ধরনের চিকিৎসা প্রদানে সক্ষম হাসপাতাল, হাইজিন ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান, এবং বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সেবা দানকারী সেন্টার। হাইজিন মেনে চলার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপের ফলশ্রুতিতে প্রতিটি আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছিলো স্যানেটারি কমিশন, এবং এই কমিশনের সদস্য নির্বাচিত করতেন স্থানীয় জনগোষ্ঠী। স্যানেটারি কমিশনের সদস্যদেরকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় খরচে হাইজিন এডুকেশন সেন্টারে প্রশিক্ষন দেয়া হত। ১৯৩৭ সনের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে জন স্বাস্থ্যের বাজেট ৭৫ গুন বৃদ্ধি পেয়েছিলো জার শাসিত রাশিয়ার আমল থেকে। ঔষধ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সেবা শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ পেতেন বিনা মূল্যে। ১৯৩৬ সনে লিখিত একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান এখানে প্রাসঙ্গিক, “The habits of the Russian people have been changed radically in a very short time. The cities are spotlessly clean, and the foreigner soon learns that cigarette butts are not supposed to be thrown on the street but into special cans placed at every corner. I remember a long railroad ride from Moscow to Kazan during which the conductor came to clean my compartment every two hours, which was more often than I liked, when I asked her to let me sleep in peace, she said ‘well, citizen, I have to clean the compartment because the inspector may come in at any station, and the car must be kept clean as it was when we left Moscow – but I will do it without disturbing you’. No visitors is allowed to go into food factories, medical institutions, or nurseries without sterilized gown and cap. Such regulations may sometimes seem exaggerated, but they are part of a great educational program, and far-reaching results cannot be expected unless there are strict rules which must be followed literally.”
২) গত দুই মাস ধরে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সারা বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব চালাচ্ছে মহামারী রুপ ধারন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিম ইউরোপের দেশ গুলো বিশেষ করে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি প্রভৃতি দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং হাজার হাজার মানুষ এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ বলে পরিচিত এই রাষ্ট্র গুলো তাদের আর্থ- রাজনৈতিক কাঠামো (যার নাম তাঁরা দিয়েছেন পশ্চিমা গণতন্ত্র), জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, শিক্ষা কাঠামো, এবং এর পরিপূরক সংস্কৃতির প্রচার তাঁরা বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামনে এমন ভাবে করে থাকেন যাতে মনে হবে উন্নত জীবনের জন্য পশ্চিমা গণতন্ত্রই শেষ কথা। পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ব বিদ্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বিশেষ করে ইতালি এবং স্পেনের সাধারণ মানুষ করোনা ভাইরাসের ছোবলে এক ভয়ঙ্কর ক্রান্তিকাল মোকাবেলা করছেন। অনেক বিশেষজ্ঞ বেদনা নিয়ে বলছেন ইতালি এবং স্পেন সম্ভবত ৭০ ঊর্ধ্ব বয়সী একটা প্রজন্ম হারাতে চলেছেন, এত কষ্ট এবং মর্মপীড়ার মধ্যেও সচেতন ও বিবেকবান মানুষের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে যে পশ্চিমা দেশ গুলোর জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কি প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল? সর্বপ্রথম চীন যখন এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেই পর্যবেক্ষণ লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে নিজ দেশে ব্যবস্থা গ্রহনে কি বিলম্ব করেছে?
এই দুটি প্রশ্নের উত্তর ইতালির একজন রাজনীতিক Marco Rizzo, সাধারণ সম্পাদক, ইতালির কম্যুনিস্ট পার্টি (Partito Comunista) তিনি দিয়েছেন। ইতালির বর্তমান সময় ও অবস্থাকে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “The dramatic health situation that Italy is experiencing these days shows clearly how in the last 30 years, since the fall of the Berlin Wall and the disappearance of the Soviet Union, the entire welfare state and public healthcare of our country has been dismantled”। অর্থাৎ বার্লিন ওয়ালের পতন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর গত ৩০ বছরে ইতালির কল্যাণমুখী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করা হয়েছে। তাঁর এই উত্তর পশ্চিমা অন্যান্য দেশ গুলোর জন্যও প্রযোজ্য। সঙ্গত কারনেই প্রশ্ন উথাপিত হবে কাদের স্বার্থে এই ব্যবস্থা সমূহের উচ্ছেদ বা বিলোপ সাধন করা হয়েছে? আমরা জানি একটি শ্রেণী বিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র কোন না কোন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে থাকে, এবং বর্তমানে ইতালি সহ পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের ক্ষমতায় একচেটিয়া পুঁজির মালিক বুর্জুয়া শ্রেণী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ও এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ সারা বিশ্বব্যাপী লুণ্ঠন, দখল ও যুদ্ধ সৃষ্টির জন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে পরিচিত।
সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলোর জন স্বাস্থ্য খাত থেকে শুরু করে ব্যাংক, বীমা, ভারী শিল্প, কল- কারখানা, আন্তর্জাতিক বানিজ্য, শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা, পর্যটন, যোগাযোগ সহ সব ধরনের খাত আজকে এক চেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন। এক চেটীয়া পুঁজির কাছে মুনাফা প্রাপ্তিই মুখ্য বিষয়, এবং ফ্রান্সের প্রখ্যাত মাইক্রোবাইওলজিস্ট Professor Didier Raoult এর (যিনি দীর্ঘদিন যাবদ চেষ্টা করে চলেছেন নিজ দেশের জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গণ মুখী করার জন্য) একটি উক্তি জন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পশ্চিমা দেশগুলোর বর্তমান অবস্থা বুঝতে সাহায্য করবে, তিনি বলেন, “because we (Big Pharma Companies in France) abandon medicine that is not profitable, even if it’s effective. That’s why no antibiotics are manufactured in the West.” মুনাফাই যে মুখ্য তার আরেকটি উদাহরণ হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্ব বৃহৎ মোটর গাড়ী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরস করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ক্রিটিক্যাল রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটর তৈরিতে শুরুতে বেশ সময় ক্ষ্যাপন করছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “জেনারেল মোটর সময় নষ্ট ও দর কষাকষি করছিলো। ফলে ডিফেন্স প্রোডাকশন আইন অনুসারে জেনারেল মোটরসকে ভেন্টিলেটর তৈরির আদেশ দিয়েছেন তিনি।“ স্পেনে করোনা ভাইরাসের মহামারী রুপ ধারনের কারণ চিহ্নিত করতে গিয়ে সে দেশের বিশেষজ্ঞ বৃন্দ এবং গণমাধ্যম গুলো বলছেন, “স্পেনের জন স্বাস্থ্য সেবার মানহীনতা ও রোগ নির্ণয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য সম্পদের অভাব।“ স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব নাভারার জন স্বাস্থ্য ও প্রতিষেধক ওষুধ বিভাগের অধ্যাপক সিল্ভিয়া কার্লোস চিলারসন বলেছেন, “করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে স্পেনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একটি বিরাট অংশ সমাজের সবচেয়ে অরক্ষিত মানুষ।“ ব্যাক্তি মালিকানা ভিত্তিক এক চেটীয়া পুঁজির রাষ্ট্র তার অন্যান্য সব খাতের মত জন স্বাস্থ্য খাতটিকেও বৃহৎ পুঁজির হাতে সমর্পণ করে দিয়েছে বহু আগেই, এবং কয়েক দিন আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় তাঁর সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, “The government shall be funding to encourage businesses to convert their resources to the production of medical equipment.” এক সময়ের শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতি বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণী চরিত্র ও ক্ষমতা হারিয়ে বৃহৎ বুর্জুয়ার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আজ বৃহৎ ব্যবসায়িক কোম্পানি গুলোকে ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজের অঙ্গিকার করে অনুরোধ করছেন দেশের জন স্বাস্থ্য রক্ষার্তে চিকিৎসা সামগ্রী তৈরি করার জন্য। রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্রের কি অসাধারণ মিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ ইতালিই ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সবচেয়ে বেশী ভয়াবহতা মোকাবেলা করছে, এবং সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোর প্রতি – দুঃখজনক হলেও সত্য ইতালির আহ্বান কোন সাড়া পায়নি। ইতালির আহ্বান সাড়া পেয়েছে কিউবা, ভেনিজুয়েলা, ভিয়েতনাম এবং চীনের কাছ থেকে, যারা পাশ্চাত্যের দেশ গুলোর তুলনায় ভিন্ন ভাবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন মোকাবেলা করছেন।
করোনা ভাইরাসের মহামারী রুপ জন জীবনে ভয়ংকর ত্রাস সৃষ্টির পাশপাশি জনগণের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য তথা শ্রেণী বৈষম্যকেও প্রকট ভাবে উন্মোচিত করে দিয়েছে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে। বিশ্বের সরচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক জীবনের সমস্ত খাত ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত হয় এবং সে কারণেই একজন নাগরিককে যথাযথ জন স্বাস্থ্য সেবা পেতে গেলে বিভিন্ন মেয়াদী “জন স্বাস্থ্য প্যাকেজ” ক্রয় করতে হয়। ছয় মাস মেয়াদী এরকম একটি প্যাকেজের মুল্য প্রায় ৮০,০০০ ডলার থেকে ১,০০,০০০ ডলার। সঙ্গত কারণেই শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে এই উচ্চ মূল্যের “জন স্বাস্থ্য প্যাকেজ” খরিদ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। New York Times পত্রিকা বলছে, “In New York, well-off city dwellers have abandoned cramped apartments for spacious second homes. In Texas, the rich are shelling out hundreds of thousands of dollars to build safe rooms and bunkers. And across the country, there is a creeping consciousness that despite talk of national unity, not everyone is equal in times of emergency.“ অর্থাৎ নিউইয়র্ক সিটির ধনিক শ্রেণীর লোকজন করোনা ভাইরাসের সংক্রমন থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের সেকেন্ড হোমে চলে গেছেন। আর টেক্সাস এর ধনীরা হাজার হাজার ডলার খরচ করছেন নিজেদের জন্য নিরাপদ ঘর এবং বাঙ্কার নির্মাণের পেছনে। এবং জাতীয় ঐক্যের ডামাডোল ও দুর্যোগের মুহূর্তে ফুটে উঠেছে যে আমেরিকাতে সব মানুষ সমান নয়। ফ্লোরিডার মাইয়ামি (Miami) ভিত্তিক একটি ওয়াইন প্রস্তুতকারক কোম্পানির মালিক বলছেন, “This is a white-collar quarantine. Average working people are bagging and delivering goods, driving trucks, working for local government.” এই হচ্ছে পশ্চিমা গনতন্ত্রের ফেরিওয়ালা, ব্যাক্তি মালিকানা ভিত্তিক রাজনৈতিক অর্থনীতির পূজারী, নিজ দেশের জন স্বাস্থ্য খাতকে বৃহৎ এক চেটিয়া পুঁজির হাতে তূলে দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা।
এদিকে জন স্বাস্থ্যের কি অবস্থা আমাদের বাংলাদেশ এবং এই উপমহাদেশের। পদ্ম ভূষণ খেতাব প্রাপ্ত ভারতের বিখ্যাত চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ Dr. D Nageshwar Reddy, ২৯শে মার্চ ২০২০ দি নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার সম্পাদকের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “………. unfortunately there are also issues in terms of health infrastructure. It can’t be changed in just a few months or years. This is a very long process and it can sometimes take more than decades. You can see that in our country, compared to other countries, health infrastructure is definitely lacking especially when we are dealing with an epidemic like this. We have to work on it. We can’t do it on a massive scale like in other countries but at least we can improve by having more epidemiologists, and having in each state a center that can deal with epidemics in a very specific way. Also, what will help is having hospitals that are specifically dedicated to epidemics and encouraging doctors and health workers to specialize in this area. So, I think all these are important steps.” অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাষায় Dr. Reddy ভারতের বর্তমান জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং এর কাঠামোর চিত্র তূলে ধরেছেন। সম্ভবত একই চিত্র বিরাজ করছে উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ গুলোতেও। গত মাসে ভারতের ফ্যাসিবাদী নরেন্দ্র মোদী সরকার কয়েক বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের চুক্তি স্বাক্ষর করলেন সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে, এর আগেও বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে আরেক সাম্রাজ্যবাদী দেশ রাশিয়ার সঙ্গে। শাসক শ্রেণীর এই সব গণ বিরোধী চুক্তির বিরোধিতা ভণ্ডুল করা হয়েছে কখনোবা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে রক্তের হোলি খেলায় আবার কখনোবা নাগরিকত্ব আইনের ধোঁয়া তূলে। Dr. Reddy তাঁর সাক্ষাৎকারে উন্নত বিশ্বের তুলনায় ভারতের বর্তমান স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা ও পিছিয়ে থাকার কথা উল্লেখ করে বলছেন যে উন্নত বিশ্বের কাঠামোর কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছুতে হলেও এক দশকের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর অনেকগুলো দশক তো পার হয়েছে – এত দিনেও কেন হোল না। কেনই বা অন্যান্য খাতের মত স্বাস্থ্য খাত ব্যক্তিমালিকানা খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জন স্বাস্থ্য খাতের অবস্থাও তথৈবচ, দেশের ছয় কোটির উপর মানুষ নিজেদের প্রতিদিনের শ্রম বিক্রি লব্ধ সামান্য মজুরীর উপর নির্ভরশীল। অথচ এই শ্রমজীবী মানুষ গুলোর মধ্য থেকে একটা অংশ গত চল্লিশ বছরে নিজেদের শ্রম বিক্রি করে “গার্মেন্টস শিল্প খাত” গড়ে তুলেছেন, এবং এই সৃজনশীল ও সভ্যতার নির্মাতা মানুষ গুলো এখনো সবেতনে ছুটি পায়নি – যদিও সরকার দশ দিনের সরকারী ছুটি ঘোষণা করেছেন। চল্লিশ বছরের পুরনো বাংলাদেশের “গার্মেন্টস শিল্প খাত” আজও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি, এ দেশে এখনও গার্মেন্টস পণ্য তৈরি করার যে মেশিন সেই মেশিন তৈরি করতে পারে না, প্রায় সব ধরনের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সরকার এবং গার্মেন্টস শিল্প মালিক বা তাদের সংগঠন এই ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোন দৃশ্যমান উদ্দ্যেগ গ্রহন করেননি। একই চিত্র বাংলাদেশের ঔষধ প্রস্তুতকারী শিল্পে – এখানেও কাঁচামাল থেকে শুরু করে উৎপাদনের সকল ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানি নির্ভরশীল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে প্রায় ঊনপঞ্চাশ বছর হতে চলল, অথচ বিগত ও বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর কেউই “Machine making Machine Industry তথা ভারী শিল্প” গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি – এবং এই না গড়ে তুলতে পাড়ার পেছনে একমাত্র কারণ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলোর খবরদারী।
৩) উপরের দুটি পরিচ্ছদে আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি এক চেটিয়া পুঁজির রাষ্ট্র ব্যবস্থার তুলনায় শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিভাবে জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পরিচালনা করে থাকেন – ঔষধ ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের বিনিময়ে মুনাফার পরিবর্তে সেখানে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছিলো বিনামুল্যে ঔষধ ও স্বাস্থ্য সেবা। এখন পর্যন্ত কিউবা গণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পরিচালনা করে থাকেন। এবং এ কারণেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত চীন, ইতালি, ভেনিজুয়েলা প্রভৃতি দেশে কিউবা তাঁদের সুপ্রশিক্ষিত চিকিৎসা কর্মীর টীম পাঠিয়েছেন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকানো ও আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা সহযোগিতার জন্য। এখানে উল্লেখ্য যে কিউবা এখন পর্যন্ত ২২ টি এন্টিভাইরাস ঔষধ তৈরি করেছেন, এবং এর মধ্যে “Interferon Alfa 2-B” ঔষধটি চীন তাঁর নিজ দেশে ব্যবহার করেছেন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসায়। কিউবায় জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসা কর্মীর সংখ্যা সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় দিগুণেরও বেশী। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে থেকেও গণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে কিউবা তাঁদের এই অর্জন সুসংহত করেছেন। ১৯৪৭ সনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ভারত, পাকিস্তান সাত দশকেরও বেশী সময় অতিক্রম করেছে, কিন্তু Dr. Reddy এর বক্তব্য প্রতিধ্বনি করে বলতে হয় “we can improve by having more epidemiologists, and having in each state a center that can deal with epidemics.” বাংলাদেশেরও এখন দরকার অনেক epidemiologists এবং সেই সাথে দরকার প্রচুর সংখ্যায় সুপ্রশিক্ষিত চিকিৎসা কর্মীর। অনেক রক্তের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হয়ে ইতিমধ্যে ৪৮ টি বছর অতিক্রম করেছে এবং বুর্জুয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দল রাষ্ট্র ক্ষ্মতায় আসীন হয়েছে, কিন্তু তাঁরা কেউ জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গণ মুখী করেননি। এ দেশের চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায় কারখানার শ্রমিক অথবা দরিদ্র কৃষকের সন্তানদের প্রবেশাধিকার প্রায় নেই বললে চলে। কারণ শোষণ ও লুণ্ঠনের চাপে পিষ্ট হয়ে প্রাথমিক শিক্ষার বৈতরণী তাঁরা পাড়ি দিতে পারছেন না। এই অবস্থার পরিবর্তন শুধুমাত্র তখনই সম্ভব যখন এ দেশের শ্রমিক শ্রেণী তাঁদের মিত্র দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে নিজেদেরকে শাসক শ্রেনিতে উন্নীত করবেন অর্থাৎ বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার সবল উচ্ছেদ ঘটিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র গঠন। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে ১৯১৭ সনে সর্বপ্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নে, ১৯৪৯ সনে চীনে, পরবর্তীতে পূর্ব ইউরোপের দেশ গুলোতে, উত্তর কোরিয়া, কিউবা এবং ভিয়েতনামে শ্রমিক শ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে গণ মুখী জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণী নিশ্চয় পারবেন নোতুন ইতিহাস নির্মাণের। গণ মানুষের কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছেন, “শ্রমজীবী মানুষ ইতিহাসের নির্মাতা”।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D