আমাদের সংগ্রামী তিন নারীর কথা

প্রকাশিত: ৬:১০ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৮, ২০২০

আমাদের সংগ্রামী তিন নারীর কথা

|| মুজিব রহমান || ২৮ জুন ২০২০ : আমাদের সংগ্রামী তিন নারীর কথা নিম্নে তুলে ধরা হলো।

নাঙ্গেলিপ্রায় ২০০ বছর আগে কেরালার নারীদের ঊর্ধ্বাঙ্গে পোশাক পরার জন্য কর দিতে হতো। নারীর স্তনের আকার অনুযায়ী নির্ধারিত এই করকে বলা হতো মুলাক্কারাম। নিম্নবর্ণের মানুষকে অসম্মানিত করতেই প্রচলিত হয়েছিল এই আইন। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত থাকলে নিম্নবর্গ ও আদিবাসীদের সহজে চিহ্নিত করা যেতো। নাঙ্গেলি ছিলেন চেরথালা শহরের বাসিন্দা। ৩৫ বছর বয়েসেও নাঙ্গেলি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। দরিদ্র পরিবারের ভাতকাপড় জোগাতে তাকে প্রায়ই ঘরের বাইরে যেতে হতো। স্তন ঢেকে বাইরে যাওয়ায় তার স্তনকর জমে যায় অনেক। রাজার লোকেরা বারবার তার বাড়ী গিয়ে করের টাকার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করে।কিন্তু দরিদ্র পরিবারের নাঙ্গেলি এতগুলো টাকা একসঙ্গে দিতে পারেন না। তিনি কর সংগ্রহকারীদের অপেক্ষা করতে বলেন।মেঝেতে একটা কলাপাতা বিছিয়ে একটি প্রদীপ জ্বালেন। গৃহদেবতার সামনে প্রার্থনা করেন ও প্রার্থনা শেষ করে কাটারির কোপ দিয়ে একে একে নিজের দুই স্তন কেটে ফেলেন। এরপর কলাপাতায় মুড়ে স্তনগুলো তুলে দেন রাজার পেয়াদাদের হাতে। স্তন কেটে ফেলায় অতিরিক্ত রক্তপাতে নাঙ্গেলির মৃত্যু হয়। শেষকৃত্যের সময় নাঙ্গেলির প্রেমময় স্বামী নিজেও ঝাপিয়ে পড়েন জ্বলন্ত চিতায়। এই ঘটনার কথা লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। তুলে নেওয়া হয় অন্যায় স্তনকরের নিয়ম।

সুলতানা রাজিয়া
প্রায় ৮০০ বছর আগে দিল্লীর শাসক সুলতান ইলতুতমিশ মৃত্যুর আগে তার যোগ্য কন্যা রাজিয়াকে শাসক হিসেবে মনোনিত করেন। সুলতান রাজধানীর বাইরে গেলেই শাসন চালাতেন রাজিয়া। রাজিয়া ছিলেন বুদ্ধিমতী ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। সুলতানের মৃত্যুর পরে তার এক পুত্র দিল্লির শাসন কেড়ে নিলে তিনি ১২৩৬ সালে জনগণের সাহায্য নিায়ে ক্ষমতায় দখল করেন। তিনি রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তিনি নারীদের পোশাক পরিত্যাগ করে পুরুষের পোশাক গ্রহণ করেন। রাজিয়া সুলতানা সম্রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। শাসনকার্য দৃঃঢ় ভাবে পালন করার জন্য তিনি নারীত্বের আবরণ পরিত্যাগ করে, পুরুষের পোশাক গ্রহণ করেণ। ১২৩৯ সালে লাহোরের তুর্কি গভর্নরের বিদ্রোহ দমন করেন। তারপর ভাতিন্ডার গভর্নর বিদ্রোহ করেণ। রাজিয়া যখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন তখন তার তুর্কি কর্মকর্তারা তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে এবং তার ভাই বাহারামকে সুলতান ঘোষণা করে। রাজিয়া ভাতিন্ডার গভর্নরকে বিয়ে করে তার সাহায্যে ক্ষমতা ফিরে পাবার চেষ্টা করেণ। কিন্তু রাজিয়া সুলতানা পরাজিত হন ও পলায়ন করেণ। ১২৪০ পলায়নকালে তাকে আশ্রয়দানকারী একজন ভৃত্য যে কিনা ষড়যন্ত্রকারী চক্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাকে খাদ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করে। নারী হওয়ার কারণে ও প্রকাশ্যে পর্দাপ্রথার বিরোধী হয়ে শাসনকাজ পরিচালনা করার জন্যে উলেমা ও প্রভাবশালী শ্রেনীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহিদ ব্যক্তিত্ব প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তিনি ১৯১১ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন। অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্তের মাধ্যমে আত্মগোপনে থাকা মাষ্টারদা সূর্যসেনের সাথে ১৯৩১ সালে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হন। মাস্টারদার সাথে সভা করার সময় পুলিশ ঘিরে ফেললে তিনি প্রথমে পালিয়ে বাড়িতে আসেন এবং পরবর্তীতে পুলিশি তৎপরতায় আত্মগোপনে চলে যান। চট্টগ্রাম শহরে ইউরোপিয়ান ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। এই ক্লাবটিতে একটি সাইনবোর্ড লাগানো ছিলো যাতে লেখা ছিলো “কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ”। মাস্টারদা এই ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই আক্রমণের নেতৃত্বের ভার পড়ে অবশিষ্ট নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার উপর। ২৩ সেপ্টেম্বর এ আক্রমণে প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের সময় তিনি ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দল পরিচালনা করেন। প্রীতিলতার দলটি ক্লাবটি আক্রমণ করে একজনকে হত্যা ও ১১ জনকে আহত করে। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তারা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতার বাঁ-পাশে গুলির আঘাত লাগে। বিপ্লবীদের দ্রুত আত্মগোপনের নির্দেশ দিয়ে আটক এড়াতে প্রীতিলতা সায়ানাইড গলাধঃকরণ করে আত্মহত্যা করেন।