সিলেট ১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৯:১২ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১০, ২০২০
|| জাহাঙ্গীর হাকিম || ১০ জুলাই ২০২০ : বস্তুসত্যের এই দিকটিকে স্বতঃসিদ্ধ মনে হওয়া সত্ত্বেও তার উপর এত জোর দিতে হয় কেন? কারণ, মানুষ বস্তুসত্য, বিশেষত মানবসমাজ ও ব্যক্তি সম্বন্ধে আলোচনার সময় কার্যত এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুসরণ করে না। মুনাফার জন্য উৎপাদন মানবসমাজের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য নয়। সমাজের এক বিশেষ স্তরে তার উৎপত্তি ও বিকাশ হয় এবং বর্তমানে তা ধ্বংসোন্মুখ। কিন্তু যে ব্যক্তি সত্যকে স্বীকার করে না সে নিশ্চয়ই উপরে বর্ণিত দৃষ্টিভঙ্গীকে কার্যত অস্বীকার করে। ‘যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটিই থেকে যাবে’– এই মনোভাব কার্যত সবক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায় এবং ক্রমাগত ব্যক্তি ও সমাজের প্রগতির পথে বাধার সৃষ্টি করে।
প্রত্যেক জিনিসই যে পরিবর্তনশীল এবং হয় বিকাশ নয় বিনাশের দিকে এগিয়ে চলেছে সেই সত্য পরিষ্কারভাবে উপলব্ধির দ্বারা আর একটি শিক্ষা পাওয়া যায়। যেহেতু সব কিছুই পরিবর্তনশীল সুতরাং আলোচ্য বস্তুটি পরিবর্তনের কোন স্তরে উপনীত হয়েছে তা জানার ব্যবহারিক গুরুত্ব খুব বেশি। চাষি যখন গরু কেনে তখন সে এ কথা ভালো করেই মনে রাখে এবং কোনো ক্রেতা যখন বাড়ি কেনে তখন এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকে। জীবনের ছোটোখাটো ব্যবহারিক প্রয়োজনের ব্যাপারে কেউই উপরোক্ত সাধারণ নিয়মকে উপক্ষে করে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, মানুষের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিশেষত উৎপাদন ব্যবস্থা এবং সেই সংক্রান্ত ভাবধারার ক্ষেত্রে উপরোক্ত নিয়ম প্রয়োগের গুরুত্ব যথেষ্ট পরিমাণে উপলব্ধি করা হয় না। এ সম্বন্ধে পরে বিস্তৃত আলোচনা করা যাবে।
সমস্ত জিনিসের পরস্পর-নির্ভরশীলতা এবং সদা-পরিবর্তনশীলতা-বস্তু সত্যের এই দুটি দিককে সহজবোধ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বন্দ্বমূলক দৃষ্টিতে বস্তুসত্যের তৃতীয় যে দিকটি ধরা পড়ে তা এত সহজবোধ্য নয়, যদিও ব্যাখ্যা করার পর তা বোঝা খুব সহজ হবে।
এই দিকটিকে এইরূপভাবে বর্ণনা করা যায় : বস্তুত বিকাশের প্রক্রিয়া সরল এবং মসৃণভাবে অগ্রসর হয় না। বরং বিশেষ বিন্দুতে হঠাৎ পরিবর্তন দেখা দেয়। হয়তো দীর্ঘকাল ধরে বিকাশের প্রক্রিয়াটি সরল ও সহজভাবে চলতে পারে এবং সেই সময়ে একমাত্র পরিবর্তন হয় আলোচ্য বস্তুটির পরিমাণের দিক থেকে। জলের দৃষ্টান্তই আবার নেওয়া যাক। যখন জলের উত্তাপ আড়ানো হয় তখন তা জলই থাকে ও সমস্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি অপরিবর্তিত থেকে যায়, উত্তাপ হ্রাসের সময়ও জল জলই থেকে যায়, শুধু উত্তাপের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে।
কিন্তু পরিবর্তনের এই ধারায় কিছুক্ষণ পরেই এমন একটা বিন্দু বা সীমা উপস্থিত হয় (জল ফোটা অথবা জমাট বাঁধার বিন্দু) যেখানে দেখা দেয় হঠাৎ পরিবর্তন। তখন জলের গুণগুলি পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং তা আর জল থাকে না, হয় বাষ্প নতুবা বরফে পরিণত হয়। বস্তুসত্তার এই বৈশিষ্ট্যটি বিশেষভাবে লক্ষিত হয় রসায়ন শাস্ত্রের ক্ষেত্রে। সেখানে কোনো যৌগিক পদার্থের অন্তর্গত বিশেষ এক বস্তুত পরিমাণ কম-বেশি হলেই প্রক্রিয়াটির ফল ভিন্নরূপ হয়।
মানবসমাজে বহুকাল ধরে ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটতে থাকে, তাতে সমাজের মূল প্রকৃতির রূপান্তর হয় না। কিন্তু তারপর এক সময় সেই একটানা পরিবর্তনের ছন্দে রূঢ় আঘাত লাগে, বিপ্লব দেখা দেয়। সমাজের পুরাতন রূপ ধ্বংস হয়ে নতুন রূপের প্রতিষ্ঠা হয় এবং তার নিজস্ব অগ্রগতির ধারা এগিয়ে চলে। সামন্ত-সমাজের ভিত্তি ছিল স্থানীয় ব্যবহারের জন্য উৎপাদন, তারই ভিতরে উদ্বৃত্ত জিনিস ক্রয়-বিক্রয়ের প্রক্রিয়া থেকে শুরু হয় বাজারের জন্য উৎপাদন এবং এইভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদনের সূত্রপাত হয়। এ পর্যন্ত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে ধীরে ধীরে কিন্তু একটি বিন্দুতে পৌঁছে উদীয়মান পুঁজিপতি শ্রেণির সঙ্গে সামন্ত-ব্যবস্থার সংঘাত বাঁধে। তারা সেই ব্যবস্থাকে পাল্টে দেয় এবং উৎপাদনের প্রক্রিয়ার সমগ্র চরিত্রে পরিবর্তন ঘটায়। সামন্ত-সমাজের স্থান দখল করে পুঁজিবাদী সমাজ এবং তা ঝড়ের বেগে বিকাশের পথে যাত্রা শুরু করে।
উপরে বর্ণিত প্রক্রিয়াটি সমস্ত ক্ষেত্রেই সর্বজনীনভাবে দেখতে পাওয়া যায়। সেই প্রক্রিয়াটির অন্তর্নিহিত কারণ সম্বন্ধে ধারণাই হল ডায়েলেকটিকস বা দ্বন্দ্বতত্ত্বের চতুর্থ বিশেষত্ব। দ্বন্দ্ববাদী দৃষ্টিতে সমস্ত বস্তুকে পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে কোনো জিনিসই সরল বা অবিমিশ্র প্রকৃতিসম্পন্ন নয়। প্রত্যেক বস্তুরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক এই দুটি দিক থাকে। প্রত্যেক জিনিসের ভেতরেই দেখা যায় যে একটি দিক বিকাশমান, তা ক্রমে প্রবল হয়ে উঠে এবং অপর দিকটি ক্ষয়িষ্ণু ও তা ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে। একটি দিক ক্রমাগত বেড়ে চলে এবং অপর দিকটি তার বৃদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি করে। পরিবর্তনের সমগ্র প্রক্রিয়ার মূলে রয়েছে দুই বিপরীতের সংঘাত; উদীয়মান দিকটি পুরাতনের আধিপত্য নষ্ট করার জন্য লড়াই করে আর পুরাতন দিকটি লড়াই করে নতুনের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য। সেই দ্বন্দ্বই পরিবর্তনের প্রবাহে বা প্রক্রিয়ায় অশান্ত রূপান্তর ঘটায়।
এ প্রক্রিয়াটি মানবসমাজের ক্ষেত্রে খুব স্পষ্ট। প্রত্যেক ঐতিহাসিক স্তরে দেখা যায় যে সমাজ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত, তাদের মধ্যে একটি উদীয়মান এবং অপরটি ধ্বংসোন্মুখ। সামন্ত-সমাজের ভেতরে পুঁজিবাদের অঙ্কুর দেখা দেয় এবং সেই অঙ্কুরের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার সাথে সামন্ত-প্রথার সংঘাত তীব্রতর হয়ে ওঠে। পুঁজিবাদী যুগেও একই প্রক্রিয়া দেখা যায় যেখানে উদীয়মান শ্রেণি হল শ্রমিকশ্রেণি। “ভবিষ্যতের চাবি তাদেরই হাতে।” পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধ ও শ্রেণিভেদ থেকে সঞ্জাত বাস্তব সংগ্রাম পরিশেষে রূপ নেয় অশান্ত রূপান্তর অর্থাৎ বিপ্লবের।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D