বাঘ সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও আমাদের করণীয়

প্রকাশিত: ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৩০, ২০২০

বাঘ সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও আমাদের করণীয়

|| তপন কুমার দে || ৩০ জুলাই ২০২০ : সারাবিশ্বে বন উজাড় ও শিকারি কর্তৃক বাঘ হত্যার ফলে বর্তমানে এই প্রাণীটি মহাবিপন্ন (Critically Endangered) প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বাঘ পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে এখনও অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়া অন্যতম। বাঘের ৮টি উপ-প্রজাতির মধ্যে ইতোমধ্যে বালিনীজ টাইগার, জাভানীজ টাইগার ও কাম্পিয়ান টাইগার বিশ্ব হতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বর্তমানে বাঘের (Penthera tigris) ৫টি উপ-প্রজাতি কোনো রকমে টিকে আছে। এগুলো হলো, বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান টাইগার, সুমাত্রান টাইগার, সাউথ চায়না টাইগার এবং ইন্দো-চায়না টাইগার। ১৯০০ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ১,০০,০০০টি এবং বর্তমানে বাঘের সংখ্যা প্রায় ৩,৫০৫ টি এবং এর প্রায় ৮০% এর বেশি বাঘ রয়েছে ভারতে । বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঘের সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার এই প্রবণতা চলমান থাকলে আগামী কয়েক দশকে পৃথিবী থেকে এ সুন্দর প্রাণীটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটাস্র্বার্গ বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার ঘোষণা ছিল। কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনে শুধু ভারত, রাশিয়া, নেপাল ও ভুটান আংশিকভাবে সক্ষম হয়েছে। ২০১৮ সালের জরিপে উল্লখিত ৪টি দেশে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।

২০১৫ সালের IUCN (International Union for Conservation of Nature and Natural Resources) Ges WWF (World Wildlife Fund) এর জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায় কন্বোডিয়ায় কোনো বাঘ নেই। বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি থেকে ১১৪টি, চীনে ৪৫টি থেকে ৭টি, লাউসে ১৭ থেকে ২টি, ইন্দোনেশিয়ায় ৫০০ থেকে ৩৭১টি, মালয়েশিয়ায় ৫০০টি থেকে ২৫০টি, থাইল্যান্ডে ২৫২টি থেকে ১৮৯টি, এবং ভিয়েতনামে ২০টি থেকে ৫টিতে নেমে এসেছে।

বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ
যদিও পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে বাঘের চামড়া, হাড় ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হতে তৈরি পণ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন প্রণয়ন করেছে কিন্তু তবুও চোরাপথে বাঘের চামড়া পাচার ও কালো বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বাঘ ও শিকার প্রাণী (হরিণ, বুনো মহিষ, সাম্বার, শূকর ইত্যাদি) গোপনে নিধন ও পাচার হচ্ছে। বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চল ধ্বংস করে গড়ে উঠছে ভারী শিল্প কল-কারখানা, রাস্তাঘাট, জনবসতি, হাট-বাজার ইত্যাদি। বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এখনও সনাতনী ওষুধ, শ্যাম্পু ও টনিকের জন্য বিশাল বাজার আছে চীনে। এ বাজার চাহিদা না কমাতে পারলে বাঘ সংরক্ষণ আরও সংকটে নিমজ্জিত হবে। বাঘ বিশেষজ্ঞরা সারা বিশ্বে বাঘের সংখ্যা হ্রাসের জন্য যেসব কারণের কথা বলছেন সেগুলো হলো :

১. বাঘ শিকার ও দেহাবশেষ (চামড়া, হাড় ইত্যাদি) পাচার;
২. বাঘসমৃদ্ধ বনা ল ধ্বংস করে রাস্তাঘাট নির্মাণ, খনিজদ্রব্য আহরণ, জবরদখল, জনবসতি ও হাট-বাজার স্থাপন;
৩. বাঘের আবাসস্থলে ও আশেপাশে শিল্পকারখানা স্থাপন করে পরিবেশ দূষণ;
৪. বাঘ শিকার ও নিধনের জন্য ফাঁদ, বিষ টোপ ইত্যাদি ব্যবহার;
৫. বাঘের খাদ্য শিকার প্রাণী নিধন ও মাংস বাজারজাতকরণ;
৬. বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি; এবং
৭. বাঘসমৃদ্ধ বনা লের মধ্য দিয়ে যানবাহন ও নৌচলাচল বৃদ্ধি।

বাঘ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
ইকোসিস্টেম, ফুড ওয়েব এবং পিরামিডের শীর্ষে অবস্থানের কারণে বনে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং ভারসাম্য রক্ষার উপযোগী পরিবেশরীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাঘের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাঘ বনের পতাকাবাহী (Flagship species) হিসেবে কাজ করে থাকে। সারা দুনিয়া জুড়ে বাঘের সংখ্যা অতি দ্রুত কমে যাওয়ায় বাঘ অধ্যুষিত দেশসমুহ তাদের নিজ নিজ দেশে বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও এ বিষয়ে প্রাথমিক কিছু কার্যক্রম নিয়েছে।

বাঘকে প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য সহায়ক প্রজাতি হিসেবে দেখা হয়। সেজন্যে বাঘ সংরক্ষণের অর্থ কেবল একক প্রজাতি ব্যবস্থাপনা নয়; বাঘ পতাকাবাহী প্রজাতি বিধায় ওই প্রতিবেশের অপরাপর সকল প্রজাতি এবং তাদের আবাস, চারণ, খাদ্য এবং প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণের যোগফলই হচ্ছে বাঘ সংরক্ষণ।

বাঘ সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ
প্রকৃতি হতে বাঘ বিলুপ্তি রোধকল্পে ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে Global Tiger Forum (GTF) প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্লোবাল টাইগার ফোরাম বাঘ অধ্যুষিত এবং বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ে সহায়তাদানকারী দেশসমূহের আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বাংলাদেশ এর সদস্য। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী বাঘ ও বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চলসমূহ সংরক্ষণে সম্মিলিত উদ্যোগের সহায়তাদান করছেন বিশ্বব্যাংক; ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউএসএইড, গ্লোবাল টাইগার ইনিসিয়েটিভস ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত টাইগার সামিটে বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে বাঘ সংরক্ষণকে বেগবান করার জন্য ঘোষণাপত্র তৈরি হয়।

বাঘ একটি বনের জীববৈচিত্র্যের অবস্থা নিরূপণের ইন্ডিকেটর প্রজাতি। যে বনের অবস্থা ভালো সেখানে বাঘের সংখ্যা বেশি থাকে। বাঘ কমে যাওয়ার অর্থ বনাঞ্চলের অবস্থা/বাঘের আবাসস্থল বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন। তাই মহাবিপদাপন্ন প্রজাতির বাঘ রক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশ-বিদেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে বাঘের আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত ১৩টি টাইগার রেঞ্জ দেশ বাঘ সংরক্ষণের জন্য National Tiger Recovery Program (NTRP) ও Global Tiger Recovery Program (GTRP) বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। নিচে ছকটি দেখলে বোঝা যাবে ২০১০ সালের তুলনায় বাঘের বর্তমান (২০১৮) জীবনদশা ভালো নয়।

বিভিন্ন দেশের বাঘের অতীত ও বর্তমান চিত্র:

উৎস: Global Wild Tiger Population Status 2019

বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব
বাঘ বনের হিসাবে কাজ করছে। বাঘ বনের খাদ্য শৃঙ্খলের শীর্ষ অবস্থান করছে এবং এর উপর নির্ভর করছে ওই বনের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতা। সেজন্য বাঘ সংরক্ষণের অর্থ কেবল একক প্রজাতি ব্যবস্থাপনা নয়; এর সাথে অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে তাদের আবাস, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করা। ২০১০ সালে থাইল্যান্ডের হুয়া হিন এ মন্ত্রী পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সভা The 1st Asian Ministerial Conference on Tiger Conservation (1st AMC) অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সের ঘোষণাকে সংক্ষেপে Hua Hin Declaration on Tiger Conservation নামে অভিহিত করা হয়। এই যৌথ ঘোষণায় প্রতিটি দেশে মহাবিপন্ন বাঘ ও বাঘের আবাসস্থল সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে পরিবর্তিত বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য টেকসই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

টাইগার সামিট ঘোষণাপত্র
বিগত ২০-২৪ নভেম্বর, ২০১০ তারিখে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে টাইগার সামিট অনুষ্ঠিত হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উক্ত সম্মেলনে যোগ দেন। ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশের সরকারপ্রধানরা উপস্থিত ছিলেন এবং উক্ত ঘোষণার মূল বিষয়গুলো নিম্নরূপ:

ক. আগামী ২০২২ সালে বাঘের সংখ্যা বর্তমান সংখ্যা থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে হবে।
খ. বাঘ ও বাঘের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত বনাঞ্চলসমূহকে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
গ. বাঘের আবাসস্থলসমূহকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মূল আধার হিসেবে চিহ্নিত করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
ঘ. বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চলে কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন, খনিজ পদার্থ উত্তোলন বা পরিবেশ দূষণের মতো কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাবে না।
ঙ. বনাঞ্চলে চলমান টহল ব্যবস্থাকে উন্নত করে বাঘ ও বাঘের শিকার প্রাণীর নিধন বন্ধ করতে হবে।
চ. বাঘ সংরক্ষণের মাধ্যমে ইকোট্যুরিজমকে সম্প্রসারিত করে উক্ত কর্মকাণ্ডের সাথে স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
ছ. বাঘ ও মানুষের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত নিরসনের জন্য গণসচেতনতা সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ প্রদান ও সময়োপযোগী বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জ. দুই দেশের সীমান্ত সংলগ্ন বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চলে বাঘের চলাচল যাতে ব্যাহত না হয় তার জন্য ট্রান্সবাউন্ডারি ইস্যু নিয়ে যৌথ প্রটোকল স্বাক্ষর করতে হবে।
ঝ. বাঘ, বাঘের দেহাবশেষ ও চামড়া পাচার রোধ করার জন্য CITES, INTERPOL, ASIAN-WEN ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা গ্রহণ করতে হবে।
ঞ. বাঘ ও বাঘের শিকার প্রাণী নিধনের জন্য চলমান বন্যপ্রাণী আইনসমূহে শাস্তির বিধান বৃদ্ধি করে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
ট. বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ও জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
ঠ. বনাঞ্চলে বাঘ ও শিকার উপযোগী প্রাণীর অবস্থা ও সংখ্যা নির্ধারণের জন্য নিয়মিতভাবে তথ্য, উপাত্ত ও উন্নত বৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগ করতে হবে।
ড. বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চলে বনজদ্রব্য আহরণ সীমিত ও হ্রাস করতে হবে এবং এর বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার নিকট হতে Forest Carbon Financing ইত্যাদি সহায়তা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢ. প্রতি দেশকে বাঘ সংরক্ষণে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
ণ. সরকার অনুমোদিত জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
প. প্রতিবছর ২৯ জুলাই ‘‘বিশ্ব বাঘ দিবস” উদযাপন করে বাঘ সংরক্ষণে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

বাঘ সংরক্ষণে ঢাকা ঘোষণা, ২০১৪
২০১৪ সালে ১৪-১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বাঘসমৃদ্ধ দেশ আন্তর্জাতিক সংস্থা, বাঘ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নিবেদিত প্রতিষ্ঠান ও এনজিও-সমূহের সন্মিলিত প্রয়াসে Second Stocktaking Conference of Global Tiger Recovery Programme (GTRP) অনুষ্ঠিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উক্ত সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন এবং বাঘ সংরক্ষণে ঢাকা ঘোষণাপত্র (Dhaka Recommendation) প্রকাশ করা হয়।

বাঘ সংরক্ষণে দিল্লি ঘোষণা, ২০১৬
বিগত ১৪ এপ্রিল ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাঘ সংরক্ষণ সন্মেলনে বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের মন্ত্রী, বাঘ বিশেষজ্ঞ ও ঊর্ধ্বতন সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তারা অংশ নেন। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সম্মেলন শেষে একটি ঘোষণাপত্র তৈরি হয়।

বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব
বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় গত এক দশক পূর্বে প্রতিবছর বাংলাদেশে গড়ে ৩০-৫০ জন মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা যায়। এদের অধিকাংশ বাওয়ালী, জেলে, মৌয়ালী ও জ্বালানি কাঠ আহরণকারী। সুন্দরবনের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশে বিশেষ করে সাতক্ষীরা রেঞ্জ সংলগ্ন লোকালয়ে মাঝে মাঝে গবাদিপশু বাঘ দ্বারা নিহত হয়ে থাকে। গড়ে বছরে ২-৩ টি বাঘ লোকালয়ে মানুষ দ্বারা নিধন হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা সুন্দরবনের প্রতিবেশ চক্রের পরিবর্তন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, হরিণ পাচার, শিকার প্রাণী এবং খাদ্য সংকটসহ বিবিধ কারণে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

উৎসঃ বাংলাদেশ বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড টিম

সাম্প্রতিককালে বন বিভাগ ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির ফলে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্বে জীবনহানির ঘটনা হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে ২০১২, ২০১৩, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে লোকালয়ে চলে আসা কোনো বাঘ মারা যায়নি এবং বাঘের আক্রমণে মানুষ মারা যাওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে চোরাশিকারির উৎপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় র‌্যাব ও পুলিশের হাতে বাঘের চামড়া ধরা পড়েছে। বাঘ বিশেষজ্ঞদের ধারণা সুন্দরবনে বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব কমে যাওয়ার অর্থ বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাওয়া। ১০ বছর আগেও যে বনে ২০-২৫ জন মানুষ বাঘের আক্রমণে নিহত হত কিন্তু বিগত ৩ বছরে বাঘের আক্রমণে কোন মানুষ মারা যায়নি। বনের মধ্যে গোলপাতা, মধু ও মাছের আহরণে আগের মতোই মানুষের আগাগোনা থাকলেও হতাহতের সংখ্যা আগের মতো নয়। এ বিষয়টি আমাদের সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে।

বাঘ জরিপ পদ্ধতি
প্রজাতি সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রজাতির প্রাণীসংখ্যা নিরূপণ অত্যন্ত জরুরি। বাঘ সচরাচর দেখা যায় না, তাই বাঘের অবস্থান এবং সংখ্যা জানার জন্য পরোক্ষ নানা চিহ্ন বা উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয়। কোনো নির্দিষ্ট আবাসভূমিতে বাঘ জরিপের বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি হচ্ছে “বাঘের থাবা জরিপ” ইংরেজিতে যাকে Pugmark Census Technique বলা হয়। বর্তমানে ক্যামেরা ক্যাপচার পদ্ধতিতে বাঘ গণনা পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এই জরিপ কৌশল বনবাসী মানুষ এবং শিকারিরা হাজার বছর ধরে প্রয়োগ করে আসছে। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানীরা সেই চর্চার ফসলকে পরিমার্জন, পরিশীলন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যেমন, প্রকৃতিবিজ্ঞানী সরোজ রাজ চৌধুরী ভারতের বিভিন্ন বনে বাঘ জরিপের কাজে এই পদ্ধতির ব্যাপক প্রয়োগ, পরীক্ষা ও নিরীক্ষা করে এই পদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রদান করেন।

বাঘ জরিপ
Pugmark print, scat analysis, camera trapping, radio-telemetry technique হচ্ছে আধুনিক পদ্ধতি যেগুলো বনে বাঘের সংখ্যা নিরূপণে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এসব ব্যয়বহুল পদ্ধতি অবলম্বনের তেমন আবশ্যিকতা নেই। কারণ, বন অধিদপ্তর এবং বনকর্মীরা যে প্রক্রিয়া, পদ্ধতি ও কর্মধারায় অভ্যস্ত, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কলাকৌশল প্রয়োগই আমাদের জন্য উপযোগী ও ব্যয়সাশ্রয়ী।

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা
সুন্দরবনে বাঘের সঠিক সংখ্যা অদ্যাবধি জানা যায়নি। তবে আনুমানিক সংখ্যা অনেকেই নিরূপণ করেছেন। WWF পরিচালিত ১৯৬৭ সালের বন্যপ্রাণী জরিপে গাই মাউনটফোর্ড ৫০-১০০টি বাঘের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এর দীর্ঘদিন পর ১৯৭৫ সালে হেন্ডরিখ ৫৫টি কম্পার্টমেন্টে জরিপ চালিয়ে সুন্দরবনে ৩৫০টি বাঘের উপস্থিতির কথা বলেন। ১৯৮২ সালে সরাসরি বন বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকদের সহায়তায় সুন্দরবন দক্ষিণ অভয়ারণ্যে ১১ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ১৫টি বাঘের সন্ধান পান। বাঘের পদচিহ্ন মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রয়োগে তারা এই সংখ্যায় উপনীত হয়। সেই নমুনার ভিত্তিতে সমগ্র সুন্দরবনে বাঘের আনুমানিক সংখ্যা ৪৫০টি বলে প্রচার করেন। এটা বলাই বাহুল্য যে, এ সংখ্যা কোনো সার্বিক জরিপের ফলাফল নয়। ১৯৯৩ বন বিভাগ এক প্রকল্পের আওতায় একজন বিদেশি বন্যপ্রাণিতত্ত্ববিদের সহযোগিতায় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা পুনরায় নিরূপণ করেন। সেবার বাঘের পাদচিহ্ন প্রয়োগে সুন্দরবনে ৩৬২টি বাঘের কথা উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয় বাঘের সংখ্যা ঘনত্ব প্রতি ১০.৯ বর্গ কিমি-তে ১টি বাঘ: বাঘ-বাঘিনীর আনুপাতিক হার ১ঃ২/৩; কিশোর ও শাবক ৪০%।

অতীতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা সম্পর্কে নানাজনে নানা কথা বলেছেন। ১৯৭১ সালে এক গণনায় বন বিভাগ বলেছে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৩৫০টি। এরপর ১৯৮১ সালে ৪৫০টি এবং ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ ছিল বলে দাবি করে। ২০০০ সালে ইউএনডিপি ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঘ বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় বন বিভাগ ৪৪০টি বাঘের সংখ্যা নিরূপণ করেন। এক্ষেত্রে বাঘের থাবা চিহ্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৫ সালে “স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রটেকশন” প্রকল্পের আওতায় বন বিভাগ ও Wildlife Institute of India যৌথভাবে ক্যামেরা ট্রাপিং জরিপ পদ্ধতিতে বাঘের সংখ্যা ১০৬টি নির্ধারণ করেন।
সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নিরূপণে যেসব গণনা হয়েছে তার ছকবন্ধ বিবরণ এখানে দেওয়া হলো:

সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণের প্রধান হুমকিসমূহ

বাঘ শিকার ও চামড়া পাচার;

বাঘের খাদ্য শিকার প্রাণী (হরিণ) শিকার ও লোকালয়ে মাংস বাজারজাতকরণ;

বনের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিতভাবে নৌযান চলাচল;

চোরাশিকার ও ডাকাতের উপদ্রব;

সুন্দরবনের পাশে ভারী শিল্প, কলকারখানা, বিদ্যুৎ প্রকল্প, সাইলো, মাছের ঘের ও রাস্তাঘাট নির্মাণ;

সুন্দরবনের সর্বত্র যথেচ্ছভাবে মাছ ধরার জন্য মাছের পাস ইস্যু ও হাজার হাজার মানুষের অনুপ্রবেশ; এবং

বনাঞ্চলে বন বিভাগের নিয়মিত টহল ও জলযানের অভাব।

বাঘ সংরক্ষণে বনবিভাগের গৃহীত পদক্ষেপ

বন বিভাগ বাঘ সংরক্ষণে বিশেষ অগ্রাধিকার কর্মসূচি ও আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরিত প্রটোকল অনুসারে সুন্দরবনের বাঘ রক্ষার জন্য বন বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। চলমান তথ্য-উপাত্ত ও বাঘ বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে জানা যায় বাংলাদেশ সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুসারে সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণের সংখ্যা ধারণ ক্ষমতায় (Carrying capacity) রেখে অবৈধ হরিণ শিকার বন্ধ, আবাসস্থলের উন্নয়ন ও নিয়মিত টহল প্রদান করে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য যথোপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য বদ্ধপরিকর:

বাঘ নিধন ও হরিণ শিকার বন্ধের জন্য অধিকতর শাস্তির বিধান রেখে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ বিগত জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে এবং উক্ত আইনের ৩৬ ধারায় বাঘশিকারি বা হত্যাকারী জামিন অযোগ্য হবেন এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর সর্বনিম্ন ২ বছর কারাদন্ড এবং জরিমানা ১ (এক) লক্ষ থেকে ১০ (দশ) লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বন বিভাগ ইতোমধ্যে Bangladesh Tiger Action Plan (২০১৮-২০২৭) প্রণয়ন করেছে যা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সুন্দরবনসহ সারাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সমাপ্তকৃত Strengthening Regional Co-operation for Wildlife Protection প্রকল্পের ৫০ জন দক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বন বিভাগের ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট (WCCU), RAB, Police, BGB, Coast Guard এর যৌথ উদ্যোগে নিয়মিতভাবে মাঠ পর্যায়ে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী পাচার, বিক্রি ও প্রদর্শন রোধ প্রকল্পে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত অনেক বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় অসুস্থ বাঘকে সেবাদানের জন্য খুলনায় একটি Wildlife Rescue স্থাপন করা হয়েছে।

সুন্দরবনের চার পাশের গ্রামগুলোতে বন বিভাগ, Wild Team ও স্থানীয় জনসাধারণের সমন্বয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় একটি এবং সুন্দরবন Tiger Response Team সংলগ্ন গ্রাম এলাকায় ৪৯টি Village Tiger Response Team (VTRT) গঠন করেছে। এর ফলে লোকালয়ে বাঘ আসামাত্র খবরাখবর আদান-প্রদান ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এই উদ্যোগটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। সাম্প্রতিককালে লোকালয়ে চলে আসা বাঘ মারার প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে।

স্থানীয় জনসাধারণকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করার জন্য সুন্দরবনের আশেপাশের উপজেলায় ৪টি CMC (Co-Management Committee) গঠন করা হয়েছে এবং জনসাধারণকে জীবনমান উন্নয়নের জন্য আয়বর্ধক কর্মকান্ড এবং সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

বন্যপ্রাণী দ্বারা নিহত বা আহত মানুষের ক্ষতিপূরণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এর আলোকে ২০১১ হতে নিয়মিতভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উভয় স্ন্দুরবনের বাঘ সংরক্ষণ, বাঘ ও শিকারি প্রাণী পাচার বন্ধ, দক্ষতা বৃদ্ধি, মনিটরিং ইত্যাদির জন্য একটি Protocol ও একটি MoU স্বাক্ষর করা হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত কর্তৃক সাক্ষরিত প্রটোকল ও সমঝোতা স্বারকের আওতায় বাংলাদেশ হতে বিভিন্ন্ পর্যায়ের বন কর্মকর্তাদের ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউটে প্রেরণ করা হয়েছে। লোকালয়ে আসা বাঘ চেতনানাশক ওষুধ প্রদান করে অন্যত্র স্থানান্তরকরণ ও সংরক্ষণের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।

উভয় দেশের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক ও তথ্যাদি আদান প্রদান।

বাঘ সংরক্ষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের করণীয়

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের দৈনন্দিন করণীয় কিছু কর্মকান্ডের বর্ণনা এখানে দেওয়া হয়:

ক. টহল পদ্ধতি ব্যাপক প্রসার ও নিয়মিত টহল উপাত্ত প্রদান;

খ. বন্যপ্রাণী রক্ষায় পাহারা নিত্যদিনের এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাই পাহারা কর্মসূচি তৈরি, অনুমোদন এবং সেটির যথাযথ বাস্তাবায়ন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে করা বাঞ্ছনীয়।

গ. এতদবিষয়ে ডিউটি বই, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অর্থ, অস্ত্র, লোকবল, আয়োজন, বণ্টন এবং সময়সূচি প্রণয়ন।
অভয়ারণ্য ও যানবাহনের লভ্যতা বিবেচনা করে প্রহরা এলাকা নির্ধারণ ও দায়িত্ব বণ্টন।

ঘ. প্রহরাকালীন লক্ষণীয় বিষয়সমূহ নির্ধারণ; যেমন: অরণ্যে কোনো বেআইনি অনুপ্রবেশকারী আছে কিনা? থাকলে তার পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ।

অভয়ারণ্য বা সংরক্ষিত বনে পর্যটকের অনুপ্রবেশ ঘটলে তাদের অনুমতিপত্র পরীক্ষা করা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পর্যটন সংক্রান্ত বিধিবিধানের যথাযথ অনুসরণ হচ্ছে কিনা সেটা যাচাই করা ও বিধান লঙ্ঘিত হলে নিকটবর্তী স্টেশনে রিপোর্ট করা।

অভয়ারণ্যে যেকোনো আইন লঙ্ঘনের বিষয় বা ঘটনা জানা গেলে সেটা তাৎক্ষণিকভাবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানো; এবিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে প্রমাণসূত্র সুনির্দিষ্ট ফর্মে উপস্থাপন করা।

বন্যপ্রাণী বে-আইনি শিকার প্রতিহত করা। এতদবিষয়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে বর্ণিত সকল ধারা, উপধারার যথাযথ বাস্তবায়ন।
যেমন, অভয়ারণ্যে যেহেতু কোনো বন্যপ্রাণী শিকার করা চলবে না, তাই কোনোপ্রকার জাল, ফাঁদ, তীর-ধনুক, বন্দুক, বিস্ফোরক, বিষটোপ অথবা প্রচলিত শিকার পদ্ধতি বা কৌশল প্রয়োগ করে বন্যপ্রাণী ধরা বা নিধন প্রতিহত করা। কোথাও কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে সেটা অতিদ্রুত নিকটবর্তী স্টেশনে রিপোর্ট করা।

বন্যপ্রাণী শিকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ডাটা ফর্ম প্রণয়নপূর্বক তাতে সংশ্লিষ্ট তথ্য লিপিবদ্ধ করা।

বনে শিকারের যেকোনো চিহ্ন যেমন বুলেটের খোসা, ফাঁদ, জাল, টোপ ইত্যাদির নমুনা সংগ্রহ।

বাঘ সংরক্ষণের আমাদের আশুকরণীয়

১. বাঘ ও হরিণ শিকারি এবং ডাকাতের উপদ্রব বন্ধের জন্য র‌্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও বন বিভাগ সমন্বয়ে সমগ্র সুন্দরবনে নিয়মিতভাবে যৌথ অভিযান পরিচালনা;
২. চিহ্নিত বাঘ ও হরিণ শিকারিদের ধরার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে;
৩. প্রতিটি এলাকায় বন বিভাগের টহল জোরদার ও ঝসধৎঃ চধৎড়ষষরহম পদ্ধতি ব্যবহার;
৪. সুন্দরবনের আশেপাশে সকল ধরনের ভারী শিল্প ও কলকারখানা নির্মাণ বন্ধ রাখা;
৫. সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নৌযান চলাচল হ্রাস করে বিকল্প পথে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা করা; এবং
৬. বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসন।

বিশেষজ্ঞের ধারণা, বাঘের অস্তিত্ব রক্ষায় বাঘের অন্যতম প্রধান হুমকি চোরাশিকারিদের বাঘ হত্যা ও পাচার, বনের ভেতর দিয়ে লাগামহীনভাবে নৌচলাচল, সুন্দরবনের পাশে বৃহৎ আকারে শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লোকালয় সংলগ্ন খাল-নদী ভরাট এবং শিকার প্রাণী পাচার ইত্যাদি। সুন্দরবনে বাঘের শিকার প্রাণীর মধ্যে চিত্রা হরিণ, শূকর ও বানর রয়েছে। বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হলে শিকার প্রাণীর (হরিণ) সংখ্যা বাড়াতে হবে। এখনই সকলকে আমাদের জাতীয় প্রাণী বাঘ সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় এ বিপন্ন প্রাণীটি আমাদের দেশ থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে।

#

তপন কুমার দে

বাংলাদেশ বন বিভাগের সাবেক উপ-প্রধান বন সংরক্ষক।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ