শহিদ জুবায়ের চৌধুরী রীমু’র খুনী জামাত-শিবিরের বিচার কতোদূর?

প্রকাশিত: ৩:৩৭ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০

শহিদ জুবায়ের চৌধুরী রীমু’র খুনী জামাত-শিবিরের বিচার কতোদূর?

|| বাপ্পাদিত্য বসু || ঢাকা, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ : আজ ১৯ সেপ্টেম্বর, শহিদ জুবায়ের চৌধুরী রীমু’র ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ছাত্রমৈত্রী নেতা রীমু’র আত্মদান এবং তৎপরবর্তী সংগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রাম, যুদ্ধাপরাধী জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

১৯৯৩ সালের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয়মুখ রীমুকে কুপিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে জামাত-শিবিরের খুনীরা। রীমু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেবল একজন ছাত্রনেতাই ছিলেন না, সেই সাথে তিনি ছিলেন একজন সম্ভাবনায় ক্রিকেটার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। একটি স্বপ্ন, একটি সম্ভাবনা সেদিন খুন হয়েছিলো স্বাধীনতাবিরোধী অপচক্রের হাতে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ মে জুবায়ের চৌধুরী রীমু’র জন্ম হয়। রীমু’র মা জেলেনা চৌধুরী গাইবান্ধার মেয়ে আর রীমু’র বাবা আব্দুল মুত্তালিব চৌধুরী নীলফামারীর সৈয়দপুরের। অবশ্য মুত্তালিব চৌধুরীর চাকরির সুবাদে তারা পরে স্থায়ী বসতি গেড়েছিলেন সাতক্ষীরায়। রীমু’র জন্ম হয় গাইবান্ধায়।

জুবায়ের চৌধুরী রীমু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। ছিলেন ওই ক্যাম্পাসে জামাত-শিবির-সাম্প্রদায়িক চক্রের বিরুদ্ধে বজ্রসম কণ্ঠ। জামাত-শিবিরবিরোধী আন্দোলনে রীমু’র ভূমিকার কারণেই তিনি ওদের প্রধানতম শত্রুদের একজনে পরিণত হন। ফল হিসেবে সেদিনের সেই বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটায় ওরা।

স্বাধীনতাবিরোধী জামাত-শিবির চক্র পঁচাত্তর-পরবর্তী পরিবর্তিত বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হয় সামরিক ও সামরিক-সমর্থিত দোসর সরকারগুলোর আনুকূল্যে। দুই জেনারেল জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এ কাজের প্রধান দুই কাজী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন জামাতের সশস্ত্র ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ তাদের এ নতুন যাত্রাপথে নাম পাল্টে হয় ইসলামী ছাত্র শিবির। ইসলামের লেবাস গায়ে জড়িয়ে কার্যত ধর্মের নামে খুনখারাবি আর দখলবাজির উন্মত্ততায় মেতে ওঠে তারা সারাদেশের শিক্ষাঙ্গনে। আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেন এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ছাত্র মৈত্রী নেতা জামিল আক্তার রতন খুনের মধ্য দিয়ে তাদের হত্যা-খুনের নয়া মিশন শুরু হয়। তাদেরকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দেয় জিয়া-এরশাদ ও তাদের অনুগতরা।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্মলাভ, জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করার মধ্য দিয়ে তার উল্টোপথে যাত্রা। সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সন্নিবেশ আর সমাজতন্ত্র উৎখাত করে এই উল্টোপথে কার্যত লাভবান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি। এরাই শহিদ জুবায়ের চৌধুরী রীমু’র খুনী।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী ছিলো এই জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রতিরোধী শক্তি। ১৯৯৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে ক্যাম্পাসে ছাত্র শিবির পরিকল্পিতভাবে ছাত্র মৈত্রী, ছাত্রদল, ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে জড়ায়। ওইদিনই রাতের বেলা আবাসিক হলগুলোর শিক্ষার্থীরা যখন পড়াশুনা কিংবা ঘুম কিংবা টেলিভিশন দেখায় মত্ত, তখন পূর্বপরিকল্পিতভাবে শেরেবাংলা হলে আক্রমণ শানায় হায়েনা শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।

রীমু’র সেদিন পালিয়ে আত্মরক্ষার সুযোগ ছিলো। কিন্তু রীমু হল অরক্ষিত রেখে, হাজারো সহপাঠী আর শত শত রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের মৃত্যুমুখে ফেলে রেখে নিজে বাঁচতে চাননি। বীরের মতো নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও শত্রুর মুখোমুখি হয়েছেন। শিবিরের প্রশিক্ষিত ঘাতকরা তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে, হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করেছে।

শহিদ জুবায়ের চৌধুরী রীমু’র এই আত্মদান বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে এক যুগান্তকারী ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। রীমু’র রক্তের বদলা নেওয়ার শপথ নিয়ে ছাত্র মৈত্রীই নয়, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সকল ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি সেদিন আন্দোলনের নতুন দিশা পায়।

শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তখন একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনে সোচ্চার। তিনি তখন বাংলাদেশের সকল শহিদ সন্তানের জননী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। রীমু’র মায়ের পুত্রশোক ছুঁয়ে গেলো তাঁকেও। জাহানারা ইমাম সেদিন জেলেনা চৌধুরীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন একই শোকগাঁথা বুকে নিয়ে। রীমু’র হত্যাকারী শিবির ক্যাডারদের বিচারের দাবিতে তিনিও সোচ্চার হয়েছিলেন। রীমু’র মাকে নিজ হাতে লেখা শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন শেখ হাসিনাও। বরেণ্য কবি ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামের আরেক অভিভাবক শামসুর রাহমান কবিতা লিখেছিলেন শহীদ রীমু’র আত্মদানকে উপজীব্য করে। কবিতা লিখেছিলেন আসাদ চৌধুরীও।

ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন জাতীয় সংসদে এ ঘটনা তুলে ধরে জামাত-শিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাব আনেন। সকল রাজনৈতিক দল এমনকি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বেগম খালেদা জিয়া’র বিএনপি’র সংসদ সদস্যরাও সেদিন এই ইস্যুতে সংসদে ঝড় তুলে একমত পোষণ করেন। তৎকালীন সংসদ উপনেতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, খন্দকার দেলোয়ার হোসেনসহ বিএনপি’র অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাই এ প্রস্তাবের পক্ষে কথা বলেন এবং শেষ পর্যন্ত জামাত-শিবির নিষিদ্ধের পক্ষে জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। যদিও এই বিএনপি-ই পরবর্তীতে জামাত-শিবিরের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে রাজনৈতিক সহবাস করে চলেছে।

শহীদ রীমু’র খুনের পর শহিদ জননী জাহানারা ইমাম রীমু’র মা জেলেনা চৌধুরীকে একটি আবেগঘন চিঠি লেখেন। ওই চিঠি সে সময়কার বিক্ষোভের আগুনে আরো ঘি ঢালে। আন্দোলন আরো জোরদার হয়। সে সময় রাজশাহীতে যান স্বয়ং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে সর্ব-বিরোধী দলীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনা সে সমাবেশে ভাষণ দেন। তিনি জামাত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি তোলেন। আজ তিনি টানা তৃতীয় ও মোট চতুর্থ দফা শাসনক্ষমতায়। কিন্তু জামাত নিষিদ্ধ হয়নি তো বটেই, এমনকি একটি আইনের সামান্য সংশোধন করলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামাত-শিবিরের দলগত যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়, তাও বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। উপরন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জামাতের পরিবর্তিত সংস্করণ হেফাজতে ইসলামের সাথে আপোস আর ভোটের রাজনীতির নানা হিসাবনিকাশ শেখ হাসিনার সরকারকেই কার্যত ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ক্ষতিগ্রস্ত করছে বাংলাদেশকে।

যে এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে ওই জামাতীদের রাজনীতিকে এই ভূমিতে পোক্ত করলো, আফসোসের বিষয় সেই এরশাদের জাতীয় পার্টিই আজ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির মিত্রশক্তি! রাজনীতির পরিহাস বুঝি এমনই হয়! মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সরকার টানা ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও রীমু, জামিল, তোবারক, শাহাদাৎ, মুনির, তপন, জুয়েলসহ এ রকম আরো বহু সহযোদ্ধার হত্যার কোনো বিচার হলো না!

শহিদ রীমু’র মা জেলেনা চৌধুরী তখন বিএনপি’র অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। কিন্তু যে জামাত-শিবিরের হাতে তাঁর প্রিয় সন্তান রীমু খুন হলেন, সেই খুনীচক্রের সাথেই যখন পরবর্তীতে খালেদা জিয়া সরাসরি জোট করলেন, তাদের এমপি-মন্ত্রী করলেন, তখন সরাসরি খালেদার হাতেই তিনি দল থেকে পদত্যাগপত্র তুলে দিয়ে নিজেকে ওই রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে নিলেন। বাস্তব অবস্থার নামে রাজনীতিতে শত্রুর সাথে আপোস যখন নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়, তখন শহিদ রীমু’র মায়ের বারবার কান্না নবায়ন করা ছাড়া আর কীই বা করার থাকে?

শহিদ রীমু’র লড়াইয়ের যারা উত্তরসূরী, সেদিন রীমু হত্যাকাণ্ডে পর যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের অঙ্গিকার করেছিলেন, তাদের হাতে আজ সেই সুযোগ উপস্থিত। জামাত-শিবিরসহ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে, রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ন্যায্যতা ও সমতাভিত্তিক মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্যোগ কি তারা গ্রহণ করবেন? নাকি রীমু’র মায়ের কান্না কেবল তাঁর একারই গোপন কষ্ট হয়ে থেকে যাবে? শহিদ রীমু’র ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এটাই গুরুতর প্রশ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সামনে।