সিলেট ১২ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:২১ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০
রাজনীতি ও প্রশিক্ষণ বিভাগ, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ : “জগৎ পরিবর্তনশীল”। সুদূর অতীত থেকেই বস্তুজগতের সমস্ত বস্তু ক্রমাগত একরূপ থেকে অন্যরূপে পরিবর্তিত হচ্ছে। তা প্রকৃতি, সমাজজীবন, চেতনা, নৈতিকতা সমস্ত খুঁটিনাটি জিনিসের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের এই প্রতিপাদ্য অনুসারে সমাজে নারীর অবস্থানও কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সমাজের অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একরূপ থেকে অন্যরূপে পরিবর্তিত হয়েছে। আমরা জানি, সমাজের কোনো বিশিষ্ট অবস্থায় সমাজের উপাদান গুলির রূপ নির্ধারিত হয় সেই সমাজ ব্যবস্থার উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বারা। এও একটি লক্ষ্য করার মত বিষয় যে, নির্দিষ্ট সমাজ ব্যবস্থায়, উৎপাদিকা শক্তি যে শ্রেণী বা সামাজিক গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তারাই সেই সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালকের ভূমিকা পালন করে। সমাজে নারীর অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রেও এই কথাটি প্রাথমিকভাবে সত্য। উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে এবং উৎপাদিকা শক্তির কেন্দ্রীভবনের ভিত্তিতে সমাজে নারীর অবস্থান ঠিক কীরকমভাবে পরিবর্তিত হল তা একটু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পুঁজিবাদী সমাজেও এক ধরনের নারী মুক্তির কথা প্রায়ই বুর্জোয়া নারীবাদীরা আউড়ে থাকেন। কিন্তু তারা নারীমুক্তির বিষয়টিকে উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে দেখেন না। তারা নারীমুক্তিকে দেখতে চান উৎপাদন সম্পর্কের বিষয় থেকে বিছিন্ন একটি আলাদা বস্তু হিসেবে। সমাজের নারীর অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়টিকে নিয়ে মার্কসীয় দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্ববীক্ষার আলোয় আলোচনা করলেই বোঝা যাবে এই ধরনের বকবকানি আসলে সম্পূর্ণ বাস্তব বহির্ভূত, শিশুসুলভ। একই সঙ্গে এই বিকাশের ধারা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলেই বুঝতে পারা যাবে নারীর অবস্থার পরিবর্তন ও লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার সঠিক এবং একমাত্র রাস্তাটি কি।
আলোচনাটিকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করে নিতে পারি-
১. প্রাকপুঁজিবাদী ও পুঁজিবাদী স্তরে সমাজে নারীর অবস্থান
২. নারীমুক্তি ও তার সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার দিশা।
প্রথম ধাপটিকে সঠিকভাবে সূত্রায়ণ করতে পারলে অর্থাৎ প্রাকপুঁজিবাদী ও পুঁজিবাদী সমাজে নারীর সঠিক অবস্থান ও তার পিছনের অর্থনৈতিক কারণ গুলিকে খুঁজে বের করে এই গতির স্বরূপ বুঝতে পারলেই নারীমুক্তির সঠিক দিশা পাওয়া যাবে। অন্য কোনো অবাস্তব পথ অবলম্বন করে নয়।
প্রাকপুঁজিবাদী ব্যবস্থা গুলোকে পর্যবেক্ষণ করলে নারীর অবস্থার পরিবর্তনের একটি খুব স্পষ্ট চালচিত্র পাওয়া যাবে।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য থেকে এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আদিম সাম্যবাদী সমাজ ও সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। কেন এমন ছিল? ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে সেই যুগের অর্থনৈতিক কাঠামো মিলিয়ে হিসেব করলেই এর সহজ উত্তর পাওয়া যাবে। স্তালিন তাঁর ‘Anarchism or Socialism’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিষয়টির সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
“History teaches us, that the class or social group which plays the principal role in social production and performs the main functions in production must in the course of time inevitably take control of that production. There was a time, under the matriarchate, when women were regarded as controllers of production. Why was this? Because under the kind of production then prevailing, primitive agriculture, women played the principal role in the production, they performed the main function while the men roamed the forests in quest of game.”
অর্থাৎ সমাজের সেই বিশিষ্ট পরিস্থিতিতে যেহেতু নারীদের হাতে উৎপাদিকা শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল তাই সেই সমাজে নারী নির্ণায়কের ভুমিকায় ছিল। এরপর শিকার ও আদিম কৃষির স্থান নিল পশুপালন। পশুপালনের যুগে প্রধান উৎপাদিকা শক্তি হয়ে দাঁড়ালো ল্যামো, বল্লম, ঢাল, তীরধনুক প্রভৃতি যা ক্রমশ পুরুষদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় এবং ক্রমবর্ধমানভাবে পুরুষরাই উৎপাদনের নিয়ন্ত্রক হতে শুরু করে। যার ফল পিতৃতন্ত্রের সূচনা।
অর্থাৎ এটা পরিষ্কার হল যে কিভাবে আদিম সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কারণে নারীর অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে। পিতৃতন্ত্রের সূচনার পর থেকে যতই বেশি করে পুরুষদের হাতেই উৎপাদনের নিয়ন্ত্রন কেন্দ্রীভূত হতে থাকল, ঠিক সেই হারেই নারী সামাজিক জীবনে তাঁর গুরুত্ব হারাতে থাকল। শুধু গুরুত্ব হারাল তাই নয়, আরও একটি নতুন বিষয় এক্ষেত্রে দেখা দিল; উৎপাদনের বিকাশের জন্য আবশ্যিকভাবেই প্রয়োজন হয়ে পড়লো পুরুষদের শ্রমক্ষমতার পুনর্গঠন ও নতুন শ্রমদাতা তৈরি। এই সমস্যার প্রভাব সরাসরি পড়লো নারীর উপর। প্রথমত, পূর্বেই যেহেতু নারী উৎপাদন ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ার থেকেই বঞ্চিত হয়ে পড়েছিল তাই এবার তার উপর এসে পড়ল পুরুষদের সেবা করার দায়িত্ব। দ্বিতীয়ত, যেহেতু নারী সন্তান ধারণ করতে সক্ষম, তাই সে হয়ে উঠল নতুন উৎপাদক তৈরির যন্ত্র। সুতরাং বোঝা যায় নারীর উপর চলা শোষণ ও তার বন্দিত্ব নেহাতই কোন ভালো বা খারাপ মানসিকতার ফল নয়, তার কারণ নিহিত আছে সমাজের উৎপাদনের জন্য সংগ্রামের সঙ্গেই। যে সব নীতিমালা এই সমাজের উপর দাড়িয়ে তৈরি করা হয়েছে সেটাও কোনো আকস্মিক স্বপ্নাদেশ বা তেমন অবাস্তব কিছু নয়। তাও তৈরি করা হয়েছে এই বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করতেই।
এবার আসা যাক, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার কথায়। উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদনের যে বিপুল বিকাশ পুঁজিবাদে হয়েছে তা পূর্বতন সমস্ত বিকাশকেই হার মানায়। সেই সমাজের শ্রেণিবিন্যাসেও এসেছে এক বিরাট পরিবর্তন। সমাজ ক্রমশ দুটো পারস্পরিক বিরোধী শিবিরে ভাগ হয়ে পড়েছে। সর্বহারা ও পুঁজিপতি শ্রেণী। পুঁজিপতি শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে উৎপাদনের উপকরণ। অন্যদিকে সর্বহারার জীবন ধারণের একমাত্র উপায় নিজের শ্রমশক্তি পুঁজিপতির কাছে বিক্রয় করা। সর্বহারা শ্রেণী উৎপাদনের উপকরণের মাধ্যমে বাড়িয়ে তুলতে লাগলো উদ্বৃত্ত উৎপাদন। যা হল মালিক পুঁজিপতির মুনাফার উৎস। অর্থাৎ কিনা, পুঁজিবাদী সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়াল- শ্রমশক্তির কেনাবেচা ও উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি। পুঁজিপতিদের একমাত্র উদ্দেশ্য আরও বেশি উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করা। তাই এই কাজে যে সমস্ত সামন্ত্রতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নীতিমালা অন্তরায়, সেগুলোকে ভেঙে দিল পুঁজিবাদ। বেশি উদ্বৃত্তের জন্য চাই বেশি শ্রম। এই ব্যাপারে লিঙ্গভেদ পুঁজিপতির কাছে অর্থহীন। তাই নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ল। বিশেষ করে নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক সস্তা শ্রমের সর্বশ্রেষ্ঠ মজুতবাহিনীতে পরিণত হল। অর্থাৎ সামন্ত্রতন্ত্রের শোষণের জোয়াল থেকে কিছুটা মুক্তি পেল নারী।
কিন্তু বিষয় হল, ব্যাপারটাকে এই পর্যন্ত ছেড়ে দিলে তা হবে অর্ধেক সত্য। আরও একটা বিষয় না দেখলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ হবে না, এবং পুঁজিবাদী সমাজে লিঙ্গবৈষম্য যত টুকু দূর সেটাকেই চূড়ান্ত বলে মনে হবে। সস্তা শ্রমের জন্য পুঁজিবাদ নারীর উপর শোষণের জোয়ালটাকে একটু হাল্কা করতে পারে, কিন্তু তাকে সরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। যেহেতু শুধু নারীরাই সন্তানধারণ করতে পারে তাই আরও নতুন শ্রমিক উৎপাদনের স্বার্থে (যা কিনা পক্ষান্তরে আরও বেশি মুনাফা তৈরি করার স্বার্থে) তারা নারীকে মুক্তি দিতে নারাজ। তাই পুঁজিবাদী সমাজ নারীর উপর থাকা নানা সামন্ত্রতান্ত্রিক নৈতিকতাকে সম্পূর্ণভাবে দূর করেনি। একই কারণে পুঁজিবাদ পারেনি সমাজ থেকে লিঙ্গবৈষম্যকে দূর করতে যেহেতু তা পুঁজিবাদী স্বার্থেরই পরিপন্থী।
সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সমাজব্যবস্থার বিবর্তনের সাথে নারীমুক্তির প্রশ্ন যে কতটা ওতপ্রতভাবে জড়িত তা খানিকটা আঁচ করা গেল। আমরা দেখতে পেলাম উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ও উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন কিভাবে প্রত্যেক সমাজব্যবস্থাতেই নারীর অবস্থানকে এক রূপ থেকে অন্য রূপে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ সমাজের বাকি সব উপাদানের মতোই নারীর অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে সমাজের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারনেই। এই সারসংক্ষেপ থেকেই কিছুটা হলেও নারীমুক্তি আন্দোলনের সঠিক দিশা নির্ধারণ করা যায়। যেহেতু নারীর অবস্থার পরিবর্তন একমাত্র সম্ভব সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই তাই সমাজ বদলের আন্দোলনই নারীর উপর চলা শোষণ অত্যাচার থেকে তাকে মুক্ত করতে পারে। সমাজ বিপ্লব বাদ দিয়ে পৃথক কোনো নারী মুক্তি বা লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজ গঠন বাস্তবে অসম্ভব। বুর্জোয়া নারীবাদীদের নারীমুক্তির তত্ত্ব নারীদের প্রকৃত অর্থে কোনো মুক্তির দিশা তো দিতেই পারে না বরং সাময়িক আশা জাগিয়ে তাদের আন্দোলনের সঠিক পথ থেকে এক অন্ধগলিতে এনে ছেড়ে দেয়।
অর্থাৎ কোনো অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা নয়, একমাত্র মার্ক্সবাদী তত্ত্বের অনুশীলনের মাধ্যমে নারীর অবস্থার বিশ্লেষণ এবং তার উপর ভিত্তি করে সমাজ বদলের লড়াই নারীকে তার কাঙ্ক্ষিত মুক্তি দিতে পারে এবং লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে পারে। নারীমুক্তি আন্দোলনকে সমাজ বদলের লড়াইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে চলমান বিপ্লবী যুদ্ধকে শক্তিশালী করার মাধ্যমেই প্রকৃত নারীমুক্তি সম্ভব হবে। নারী তার উপর চলা দীর্ঘ শোষণ থেকে মুক্তি পাবে। এক লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠবে।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D