সিলেট ১২ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:১৬ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২০
|| সাহিত্য বিষয়ক প্রতিবেদক || ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ : সে এক অদ্ভুত প্রেমের গল্প। এক অনাথ মানুষ ছন্নছাড়াভাবেই কাটিয়ে ফেললেন জীবনটা। আমৃত্যু শুধু খুঁজেছেন ভালোবাসাকেই। তবু সে কুহকিনী রয়ে গেছে অধরা। তিনি আর কেউ নন তিনি হলেন ডক্টর ইউরী জিভাগো, বিশ্বখ্যাত উপন্যাস। “ডক্টর জিভাগো”এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। উত্তাল রাশিয়ার পটভূমিতে রচিত এই অমর প্রেমকথা। বিতর্কিত ও বহু সমালোচিত।
অল্প বয়সে অনাথ নায়ক ডক্টর ইউরীর চোখ দিয়ে লেখক এঁকেছেন যুগসন্ধির রাশিয়ার।বিশাল মহাকাব্যিক ক্যানভাসে। রাশিয়া তখন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে। একদিকে জারতন্ত্র শেষের পথে অন্যদিকে মাথা চাড়া দিয়েছে কমিউনিস্ট ভাবধারার সমাজতন্ত্র। দেশ থমথমে আসন্ন গৃহযুদ্ধের পূর্বাভাসে। ওদিকে পৃথিবী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি।
বিষয় কাল্পনিক হলেও উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র সময়। প্রেমের গল্পের আড়ালে ঐতিহাসিক কাহিনী। রাজতন্ত্রের অবলুপ্তি আর গৃহযুদ্ধের প্রভাবে বিধ্বস্ত সামাজিক জীবন।মানুষের ব্যক্তিগত মতামতের কোনো মূল্য নেই।বিধি নিষেধের বেড়াজালে শিল্প আর সংস্কৃতি। এই পরিবর্তনকে কে বহন করতে হয় নায়ক, জিভাগো ও তাঁর চারিদিকে ঘুরে বেড়ানো সমস্ত মানুষকেও।
উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স ১৯১৭ সালে।গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত রাশিয়া। একদিকে লেনিন আর বোজডানভের নেতৃত্বে লাল ফৌজ অন্যদিকে জারের ইম্পেরিয়াল আর্মি। সে ছিল ঐতিহাসিক ফেব্রুয়ারি বিপ্লব। রাজতন্ত্র থেকে মুক্ত রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠা হলো সমাজতন্ত্রের। কিন্তু এই সময় থেকেই কমিউনিজম এ আচ্ছন্ন রাশিয়ার গতি প্রকৃতি বার বার আহত করে লেখককে। তাঁর লেখায় তাই ফুটে ওঠে আন্দোলনের খারাপ দিকগুলো।
বরিস পাস্তেরনাক মূলত কবি। তাঁর কবিতা পাঠক সমাজে আদরলাভ করলেও সমালোচনা মুক্ত ছিল না। সমালোচকরা তাঁকে ‘সুখের কবি ‘ তকমা দেগে দিয়েছেন। তাঁদের মতে বরিস রোমান্টিক। তাঁর সব সৃষ্টি সুখের সাদা গজমিনারে রচিত। সমাজের ঘাত প্রতিঘাতে সেখানে আলোড়ন জাগেনা। তাই এই অপবাদ দূর করার এটা ছিল মরিয়া প্রচেষ্টা। তাঁর কথায়:-
‘I need to do something dear to me and my very own, riskier than usual . . . I need to break through to the public.’
তাঁর লেখনী হয়ে ওঠে ক্ষুরধার। কলমের আঘাতে ফালাফালা করে দেন মানবতা বিরোধী শক্তিকে। ১৯১৭ এর নভেম্বর বিপ্লবের পর বলশেভিকরা প্রেস ও প্রকাশনাকে শাসকের হাতের পুতুলে পরিণত করে। ট্রটস্কি”Literature and Revolutiom” গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লেখ করেন প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচারকে পার্টি কর্মীদের নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার করার কথা। এই কমিউনিস্ট অত্যাচারের বিরুদ্ধে বারবার পাওয়া যায় বরিস পাস্তেরনাক এর প্রতিবাদ। মানবতাকে তিনি সব ‘ism ‘এর উপরে স্থান দিয়েছেন।
উপন্যাসটির সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা। ১৯৩৪ সালের পার্টি কংগ্রেস এর আন্দোলনকে নিঃস্বার্থ সমর্থনের নির্দেশ কে অবহেলা করে লেখা এই বই। ইউরী প্রথমে আন্দোলনের সমর্থক ছিল। পরিবর্তন এর দোলা লেগেছিল তার রক্তেও। পরে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে ব্যাথিত করে। সে হয়ে ওঠে রাষ্ট্র এর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধমুখ।
উপন্যাসটির বিস্তার ১৯১২ থেকে ১৯২৪।কিন্তু লেখা শেষ হতে হতে লেগে যায় ১৯৫০। ততদিনে রাশিয়ায় স্টালিন রাজ। বদলাননি বরিস। জোসেফ স্তালিনের আমলের রাশিয়াতেও বরাবরই নিজের ব্যক্তিগত মত রক্ষার বিষয়ে সচেতন ছিলেন বরিস পাস্তেরনাক। কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্রের আদেশে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত মানুষের পরিবারের পাশে দাঁড়াতেও পিছপা হননি তিনি। ডক্টর জিভাগো’-র কাহিনিতেও তাই নভেম্বর বিপ্লব সম্পর্কে নিজের মতো করেই মূল্যায়ন করেছিলেন তিনি। প্রত্যাশিতভাবেই সেই বই প্রকাশে রাজি হননি কোনও সোভিয়েত প্রকাশক। কিন্তু তা সত্ত্বেও দিনের আলো দেখেছিল ‘জিভাগো’। মস্কোর এক ইতালীয় বই সংগ্রাহকের মাধ্যমে জিভাগো’-র একটি পাণ্ডুলিপি পান মিলানের প্রকাশক জিয়ানজিয়াকোমো ফেট্রিনেল্লি। মস্কো ও ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির চাপ উপেক্ষা করে বইটি প্রকাশ করেন তিনি। ইতালীয় ভাষায় প্রকাশিত হয় ‘জিভাগো’। নেদারল্যান্ডস থেকে রুশ ভাষায় প্রকাশিত হয় বইটি। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় রাশিয়ায় ঢোকার ছাড়পত্র পায়নি।শেষ পর্যন্ত সারা বিশ্বে সমাদৃত হয় বইটি। নোবেল পুরস্কার পান পাস্তেরনাক। ১৯৬৫ সালে ‘জিভাগো’-র উপরে ভিত্তি করে সিনেমা তৈরি করেন হলিউডের পরিচালক ডেভিড লিন।
নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করলেও কমিউনিস্ট রাশিয়ার চাপে তা নিতে অস্বীকার করেন পাস্তেরনাক।সারাজীবন ডক্টর জিভাগোর মতই তাঁকেও সহ্য করতে হয়েছে কমিউনিজম এর একনায়কতান্ত্রিক অত্যাচার। বহুদিন ছিলেন অন্তরীণ। অবশেষে১৯৬০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়ে কোনো বই এত আলোড়ন তুলতে পারেনি। আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলি বইটিকে কমিউনিস্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। বইটি প্রকাশ ও প্রচারে আমেরিকার প্রভাব ছিল সুষ্পষ্ট। রাশিয়ার মানুষের মধ্যে কমিউনিজম নিয়ে যে বিরূপ ধারণা ছিল তা বার বার বইটিতে প্রকাশ পেয়েছে।
বরিসের কৃতিত্ব প্রেম কাহিনীর পটভূমিতে সমগ্র রাশিয়ার বিপ্লবের স্বরূপকে তুলে ধরা। পার্টি অন্ত একনায়কতন্ত্র কিভাবে সাধারণ মানুষের জীবনকে ছিন্নভিন্ন করেছিল তার জীবন্ত দলিল এই মহান সৃষ্টি।
নিজের সৃষ্টিতে মুগ্ধ বরিস তাই বিস্মিত:
“You cannot imagine what I have achieved! I have found and given names to all this sorcery that has been the cause of suffering, bafflement, amazement, and dispute for several decades. ”
কৃতজ্ঞতাঃ
মৃণাল পাল
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D