পীরগাছার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৭, ২০২০

পীরগাছার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

নজরুল ইসলাম হক্কানী || রংপুর, ২৭ নভেম্বর ২০২০ : পীরগাছা ভাসমান নাম।পীরগাছা নামে কোন এলাকা বা মৌজা নেই।অসংখ্য সুফি -সাধক,পীর -ফকির এবং চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারি সন্ন্যাসীদের আস্হানা বা তীর্থক্ষেত্র ছিল পীরগাছার নানা জঙলাপুর্ণ স্হানে ।সাতদরগা, বড়দরগা, মাদারশাহ ফকিরের দরগা,দেওয়ান সালেহ আহম্মদ সাহেবের দরগা,ফকিরটারি, চণ্ডীপুর, কালিগঞ্জ, কামদেব, গাজির দরগা , পাঠক শেকড় ,ভোলানাথ, হারোডাঙা , কাউনিয়ার তপসিডাঙা বিল,হারাগাছের ধুমনদী, ধুমের গড়,মন্হনার বিল,ভূতছরা এগুলোই ছিল সুফিসাধক ও চৈতন্য অনুসারিদের ধর্ম প্রচার কেন্দ্র।মধ্যযুগে সম্রাট আকবরের “দীনেশ ই এলাহী’র মাধ্যমে সুফি – বৈষ্ণবদের মধ্যে সর্বধর্ম সমন্বয়ের মানব ধর্মের বিকাশ ঘটে।এ ধারা পীরগাছা-কাউনিয়াসহ তৎকালিন ফতেপুর চাকলার সবখানেই ছড়িয়ে পড়ে ।অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই সময়কালে মোঘল আমলের স্বাধীনচেতা মানবপ্রেমিক জমিদার রাজা শিবচন্দ্র রায় ও পীরগাছা মন্হনার জমিদার জয় দূর্গা দেবী (দেবী চৌধুরাণি )এতদান্চলে পীর-ফকির -সন্ন্যাসীদের ধর্মচর্চায় নিস্কর জমি দান করেন ।দান সূত্রে প্রাপ্ত নিস্কর বা লাখেরাজ জমিতে গড়ে ওঠে ধর্ম প্রচারের আস্হানা, দরগা বা তীর্থক্ষেত্র ।পীরগাছার সু-সন্তান প্রয়াত আব্দুল গফুর সরকার দেবী চৌধুরাণি কে ?শীর্ষক এক প্রবন্ধে দেবী চৌধুরাণি কর্তৃক পীর-ফকির কে দেয় পাট্রা বা সনদের নকল তাঁর লেখায় সংযুক্ত করেছেন ।এ সময়, “সমাজে চলছিল হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথার নিপীড়ন ।ব্রাম্মনরা বলতো,দেবতার মূখ থেকে ব্রাহ্মণের জন্ম,বাহু থেকে ক্ষত্রিয়ের, পেট থেকে বৈশ্য এবং পা থেকে শুদ্রের জন্ম।”শুদ্ররাই ছিলেন সমাজের সংখ্যা গরিষ্ঠ ।কিন্তু হিন্দু সমাজের জাতপাতের বিবেচনায় শুদ্ররা ছিলেন অছুত শ্রেণী ।বর্ণবৈষম্যের পীড়ন থেকে মুক্তির বার্তা ঘোষণা করে পীরগাছার বিভিন্ন দরগায় অবস্থানরত ইসলামের সুফিসাধক পীর-ফকিরের দল।তাঁরা বলেন,”কানান্না সো উম্মাতান ওয়াদেতান-অর্থ, আল্লাহ্তালার চোখে সবাই সমান।ইসলামের ওই সাম্যের বাণীর আহ্বানে নিম্নবর্ণের হিন্দু সমাজের শূদ্ররা দলে দলে পীরগাছার পীর-ফকিরদের আস্হানায় এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

বর্ণবৈষম্যের যাতাকল থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে মুক্তি দেয়ার জন্য চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্মের সৃষ্টি ।সুফিবাদের সাম্য ও মানবিকতা চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্মকে প্রভাবিত করেছিল ।পীরগাছার চণ্ডীপুর ও ফকিরটারি গ্রামে দুই ধর্মের লোক এক সঙ্গে বসবাস করছেন অসাম্প্রদায়িক ,মানবিক চেতনার উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য নিয়ে ।কালিগঞ্জ, গাজির দরগা,কামদেব, সাতদরগা -হারোডাঙা -ভোলানাথ,শ্রীকান্ত, মধুরাম,নরসিংহ,সোনারায়এসব জনপদ ছিল পীরগাছার অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের স্মারক , আমাদের সংস্কৃতির অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি ।ইসলামের সুফি মতবাদের ধারায় উজ্জীবিত হয়ে চন্ডীদাস উচ্চারণ করেছিলেন:”শুনহ মানুষ ভাই,সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”পবিত্র কোরানেও বলা হয়েছে, “সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ ।” সুফিবাদের সাম্য ও মানবিকতার ধারায় আবির্ভাব ঘটে লালনের ।লালন বলেন,”এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে / যবে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খৃষ্টান জাতিভেদ নাহি রবে।’হিন্দু ধর্মের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে কবি নজরুল ইসলাম ভগবানের বুকে লাথি মেরে মানবতার জয়গান গেয়েছেন —–“গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে নহে কিছু বড়, নাহি কিছু মহিয়ান।’

তৎকালিন যুগে সুফি ও চৈতন্যমতবাদে উজ্জীবিত পীরগাছার পীর-ফকির, সন্ন্যাসীরাই ছিলেন ধর্ম প্রচারক,সমাজ সংস্কারক এবং বুদ্ধিজীবী ।এতদান্চলে পীর-ফকির, সন্ন্যাসী ও গাউসদের অবস্থানের কারণে এই এলাকার নাম- পীর ও গাউস থেকে পীরগাছা ।এই পীর- ফকির -সন্ন্যাসীরাই দেবী চৌধুরাণি , শিবচন্দ্র রায়, ফকির মজনুশাহ,ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে “ফকির সন্ন্যাস বিদ্রোহ ও রংপুরের ঐতিহাসিক প্রজাবিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ।ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল হিন্দু -মুসলিম প্রজাদের মিলিত অভিযান ।বিদ্রোহের নেতা ছিলেন নুরলদীন ,ভবানী পাঠক,ফকির মুসাশাহ,দরজী নারায়ণ, কেনা সরকার, দেবী চৌধুরাণি এবং শিবচন্দ্র রায় ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ