বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ

প্রকাশিত: ১০:১৮ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৯, ২০২০

বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক || ঢাকা, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ : মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক অাধুনিক ও সমৃদ্ধির অভিযাত্রায় বাংলাদেশ এখন যে ধরণের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি।

ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিক্স এন্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে এই পূর্বাভাস দিয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল ২০২১’ নামের এই রিপোর্টটি শুক্রবার প্রকাশ করা হয়। এতে মূলত সামনের বছর এবং আগামী ১৫ বছরে বিশ্বের কোন দেশের অর্থনীতি কী হারে বাড়বে, তারই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। সিইবিআর প্রতিবছর এই রিপোর্ট প্রকাশ করে।
এই রিপোর্ট অনুযায়ী আর মাত্র ৭ বছর পর পরেই চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০৩০ সালে ভারত হবে তৃতীয়। আর ২০৩৫ সাল নাগাদ ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বহু ধাপ উপরে উঠে পৌঁছে যাবে ২৫ নম্বরে।
২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
সিইবিআর বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক ওলট-পালট ঘটে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকার বেশিরভাগ বড় অর্থনীতির দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর বিপরীতে চীন খুব কৌশলে করোনাভাইরাস দ্রুত এবং কঠোরভাবে মোকাবেলার কারণে সামনের বছরগুলোতে পৌঁছে যাবে বেশ সুবিধেজনক অবস্থানে।
করোনাভাইরাস মহামারি সত্ত্বেও সামনের বছরগুলিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জোরালো প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে।
চীন যে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে, সেটাকে সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু সিইবিআর বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর হয়েছে। আগে যা ধারণা করা হয়েছিল, তার থেকে ৫ বছর আগেই ২০২৮ সালে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।
মন্দা এড়াতে সাফল্য
চীনের মতোই একইভাবে বাংলাদেশও যেহেতু করোনাভাইরাসের মধ্যেও কিছুটা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে, তাই সামনের বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধারাবাহিক এবং জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশা করছে সিইবিআর।
সিইবিআর তাদের রিপোর্টে বলছে, কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর আগের বছরগুলোতে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল বেশ ভালো। এবং এটা ঘটেছে দেশটিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও। গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ছে গড়ে ১ শতাংশ হারে।
বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় কোভিড-১৯ যেভাবে ছড়িয়েছে, সে তুলনায় বাংলাদেশে সংক্রমণ অনেক সীমিত রাখা গেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মারা গেছে ৭ হাজার ৫২ জন। প্রতি এক লাখে মাত্র ৪ জন। যদিও এই মহামারির কারণে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ছিল সীমিত, তা সত্ত্বেও অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে এটি। কারণ মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে চাহিদা গিয়েছিল কমে আর আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
জিডিপির হিসেবে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান –
(তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল ২০২১, সিইবিআর)
তবে অন্য অনেক দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলেও বাংলাদেশ তা এড়াতে পেরেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
সিইবিআর এর পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, ২০২১ সাল হতে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটবে গড়ে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। তবে এর পরের দশ বছরে এই হার কিছুটা কমে গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে।
সিইবিআর বলছে, ২০২০ হতে ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি আছে ৪১ নম্বরে। কিন্তু ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে ২৫তম অর্থনৈতিক শক্তি।
২০২০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৩৯ ডলার। এই হিসেবটা পিপিপি বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটিকে হিসেবে নিয়ে করা। বাংলাদেশকে এখন একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ বলে গণ্য করা হয়।
সামনের দশকে বিশ্ব অর্থনীতিতে আরেক চমকপ্রদ সাফল্যের উদাহারণ হবে ভিয়েতনাম

বাংলাদেশের নাটকীয় উত্থান
সিইবিআর এর সূচক অনুযায়ী বিশ্ব অর্থনীতিতে এখনো এক নম্বর শক্তি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে চীন এবং জাপান। প্রথম দশটি দেশের তালিকায় এরপর ক্রমান্বয়ে আছে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ভারত, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা এবং কোরিয়া।
২০৩৫ সাল নাগাদ এই প্রথম দশটি দেশের তালিকা থেকে ঝরে যাবে ইতালি, কানাডা এবং কোরিয়া। তাদের স্থলে প্রথম দশটি দেশের তালিকায় ঢুকবে ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল এবং রাশিয়া।
২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রথম ২৫টি দেশের তালিকায় যুক্ত হবে তিনটি নতুন দেশ: ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এবং বাংলাদেশ।
এর মধ্যে ভিয়েতনামের অবস্থান হবে ১৯, ফিলিপাইনের ২২ এবং বাংলাদেশের ২৫।
২০৩৫ সালে বিশ্বের ২৫টি বৃহৎ অর্থনীতির দেশ: (তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল ২০২১, সিইবিআর)
২৫টি বৃহৎ অর্থনীতির দেশের সূচক
এর মধ্যে বাংলাদেশের উত্থানকেই সবচেয়ে নাটকীয় বলতে হবে। বর্তমান র‍্যাংকিং ৪১ থেকে বহু দেশকে টপকে বাংলাদেশ পৌঁছাবে ২৫ নম্বরে।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ৪১। ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ৩৪। এর পাঁচ বছর পর ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে ২৮তম বৃহৎ অর্থনীতি। ২০৩৫ সালে ঢুকবে প্রথম ২৫টি দেশের তালিকায়।
যেসব অর্থনীতিকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে যাবে তার মধ্যে আছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, নরওয়ে, আর্জেন্টিনা, ইসরায়েল, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, নাইজেরিয়া, বেলজিয়াম, সুইডেন, ইরান এবং তাইওয়ান। বর্তমান বিশ্ব সূচকে এই দেশগুলো বাংলাদেশের উপরে, কারণ তাদের অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে বড়।
তবে মনে রাখতে হবে, এই সূচক তৈরি করা হয় কেবলমাত্র কোন দেশের অর্থনীতির জিডিপির আকার দিয়ে। মানুষের মাথাপিছু আয় বা জীবনমান এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। আর বাংলাদেশ যেহেতু খুবই জনবহুল একটি দেশ এবং ২০৩৫ সাল নাগাদ জনসংখ্যা আরও বাড়বে, তাই পেছন ফেলে যাওয়া দেশগুলোর তুলনায় অনেক দিক থেকেই বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানে তখনো অনেক পার্থক্য থাকবে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ ও অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, অারপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ অামিরুজ্জামান বলেন, “বড় অর্থনীতির দেশ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা বাংলাদেশের আছে। আগামী ১৫ বছর ৭ শতাংশ বা এর বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনও সম্ভব। কিন্তু এগুলো শুধু সংখ্যাগত তথ্য–উপাত্ত। কীভাবে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে হবে, সেটা বিবেচনায় আনতে হবে। এ জন্য শিল্পায়ন, কৃষির অাধুনিকায়ন ও ভূমি সংস্কার অার্থসামাজিক ব্যবস্থার অামূল পরিবর্তনের ও পরিকল্পিত অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। তাঁর মতে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে যোগাযোগব্যবস্থা, জ্বালানিসহ অবকাঠামো দ্রুত করতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক অাধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে এগোতে হবে। এসব না হলে যেসব সংখ্যার কথা বলা হচ্ছে, তা শুধু সংখ্যাই থাকবে।”

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ