কোন পথে যাবে এই দেশ!!

প্রকাশিত: ৪:৩৮ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১

কোন পথে যাবে এই দেশ!!

|| আব্দুল গাফফার চৌধুরী || (লন্ডন যুক্তরাজ্য), ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে এবং কিছু পরে মুক্তিযুদ্ধের অপর নায়কদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান জয় বাংলাসহ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তার সব চিহ্ন দ্রুত মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বাঙালি জাতীয়তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় বাংলাদেশী জাতীয়তাকে। অর্থাৎ নাগরিক পরিচয়কে করা হয় জাতীয় পরিচয়। এ বাংলাদেশী জাতীয়তা হল সাম্প্রদায়িক জাতীয়তারই বাতাবরণ। তারপর দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুছে দিয়ে একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করার মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

তারপর থেকে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী (সাম্প্রদায়িক) এবং অসাম্প্রদায়িকতার দাবিদার রাজনীতির মধ্যে যে ক্রমবর্ধমান সংঘাত ও সংঘর্ষ, যা আমাদের জাতীয় জীবনকে বিভীষিকাময় করে তুলেছে, তাকে আমরা যতই দুই পরিবার ও দু’টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই বলে চালাই না কেন, আসলে এ দ্বন্দ্বের উদ্ভব বাংলাদেশের মুসলমানের ক্রাইসিস অব আইডেন্টিটি বা আত্মপরিচয়ের বিবাদ থেকে।
আওয়ামী লীগ নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তার অনুসারী বলে দাবি করলেও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব তাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। সংক্রমিত না হলে তারা বহুদিন পর সংসদে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ পেয়ে সংবিধানে হারানো ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান ফিরিয়ে আনত এবং ধর্মীয় সূরা ইত্যাদি বর্জন করত। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যা পেরেছিল, এ যুগে তারা তা পারেনি। তবু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের নামে তারা অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তার প্রতি এক ধরনের আনুগত্য টিকিয়ে রেখেছে এবং তার ফলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে তার সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। এটা পরিবারতন্ত্র বা দলতন্ত্রের ক্ষমতার লড়াই বলে পণ্ডিতরা আখ্যায়িত করতে চাইলেও আসলে এই লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দুই পরিচয়ের দ্বন্দ্ব।

বাংলাদেশে বিএনপি নামে অসাম্প্রদায়িক দল। কিন্তু তার শেকড় প্রোথিত অতীতের মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফলে পাকিস্তানে ধর্মান্ধতা রাজনীতিকে গ্রাস করেছে। তারই অনুসরণ ঘটেছে বাংলাদেশেও। সহজেই বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে আত্মীয়তা সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা বাঙালি পরিচয়ের ও জাতীয়তার সব চিহ্নকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে মুছে ফেলতে চায়। আফগানিস্তানে তালেবান শাসনামলে যা হয়েছিল, বৌদ্ধযুগের হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতি ধর্মের দোহাই পেড়ে ধ্বংস করা শুরু হয়েছিল, বাংলাদেশেও তাই ঘটত যদি জামায়াতের অভ্যুত্থান বা ক্ষমতা দখল সফল হতো।
বাংলাদেশে ভুঁইফোড় হেফাজতিরা যে তের দফা দাবি তুলেছিল, তা তালেবানদের মধ্যযুগীয় দাবি। এ দাবি সমর্থন করা কোনো আধুনিক ও গণতান্ত্রিক দল বা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। বিএনপি এ দাবি আদায়ের জঙ্গি আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিল। আওয়ামী লীগও মৌলবাদী জঙ্গিদের অভ্যুত্থানের ভয়ে এ দাবিগুলোর সরাসরি বিরোধিতা করতে পারেনি। দাবি মানা এবং না মানার মাঝামাঝি অবস্থান নিতে হয়েছিল।

বাংলাদেশের মুসলমানের এ আত্মপরিচয়ের সংঘাতই এখন ভয়াবহ রাজনৈতিক সংঘাতের রূপ নিয়েছে। এ সংঘাতে আওয়ামী লীগের দুর্বলতা দেশটির সেক্যুলার শিবিরের দুর্বলতার পরিচয় বহন করে। অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসী ভূমিকা মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর শক্তির পরিচয় প্রদর্শন করে। দেশটির সব পেশার মানুষও এখন দুই শিবিরে বিভক্ত। এক শিবিরের লোকদের পিঠে ‘জাতীয়তাবাদী’ তকমা লাগানো। অন্য শিবিরের তকমা ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিবির’। অর্থাৎ একটি নন সেক্যুলারিস্ট এবং অন্যটি সেক্যুলারিস্টদের দল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেক্যুলারিস্টদের দল ভারি ছিল। এখন পুরোপুরি না হলেও দলে ভারি নন সেক্যুলারিস্ট শিবির।
দুই শিবিরের শক্তির এই তারতম্য দেখা গেছে ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে এবং উপজেলা পরিষদের নির্বাচনেও। প্রচারণা এবং সন্ত্রাসে নন সেক্যুলারিস্ট জোট এতটাই শক্তি প্রদর্শন করছিল যে, সেক্যুলারিস্ট জোটকে কিছুটা বিতর্কিত পথেই সাধারণ নির্বাচনটি মেরে ক্ষমতায় থাকতে হয়েছে। এ বিতর্কিত পথটিকে দেশবাসীর বড় অংশ মেনে নিয়েছে। তা না হলে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থাই শুধু উচ্ছেদ হতো না, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বিপন্ন হতো।

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জঙ্গি মৌলবাদের সঙ্গে আঁতাত শক্তি বৃদ্ধির এবং এলিট শ্রেণীতেও প্রভাব বিস্তারের মূল কারণ, পোস্ট সোভিয়েত বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ও রাজনীতির বিপর্যয় এবং মধ্যবাম রাজনৈতিক দলগুলোরও পরিস্থিতির চাপে ডান আপসবাদী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়া। আওয়ামী লীগের রাজনীতির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
সামরিক শাসনামলে পাকিস্তান ও সৌদি আরব থেকে আমদানি করা ধর্মীয় কালচারের দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতিও প্রভাবিত হতে থাকে। সেক্যুলার কালচারের রাজনীতির বদলে আওয়ামী লীগও এই ধর্মীয় কালচারের কাছে সম্পূর্ণভাবে না হলেও আংশিকভাবে আত্মসমর্পণ করে।
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দুর্বলতায় বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের শিবিরও দুর্বল ও নানাভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের পক্ষেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বা সেক্যুলারিজমের মূলমন্ত্রগুলো জাতীয় জীবনে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠাদান সম্ভব হয়নি। বরং এই মূলমন্ত্রগুলো থেকে তারা নিজেরাই ক্রমশ পশ্চাৎপসারণ করেছেন। ফলে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অক্ষশক্তি প্রায় বিনাযুদ্ধেই বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

বাঙালি মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অর্থাৎ তার অসাম্প্রদায়িক ও স্বাভাবিক জাতি পরিচয়ে ফিরে আসার পথে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর সামরিক ও স্বৈরাচারী সরকারগুলোর দ্বারা অনুসৃত শিক্ষানীতিও। এই শিক্ষানীতিতে আধুনিক স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি ও আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানোর পরিবর্তে মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়ানো এবং আর্থিক অনুদান বৃদ্ধি করা হয়। তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া আমরা এখন দেখছি সারা দেশজুড়ে। কওমি, খারেজি ইত্যাদি নানা ধরনের হাজার হাজার মাদ্রাসা এখন বাংলাদেশে। অনেক মাদ্রাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিদেশের উদ্দেশ্যমূলক অর্থ সাহায্য দ্বারাও চালিত হয়।

দেশের গোয়েন্দা পুলিশের রিপোর্টেই জানা যায়, বিশাল এক সংখ্যক মাদ্রাসাই হচ্ছে এখন জঙ্গি তৈরি ও ট্রেনিংদানের গোপন ঘাঁটি। এখান থেকেই জামায়াত, হেফাজত, হিজবুত তাহরির ইত্যাদি সন্ত্রাসী সংগঠনের ক্যাডার তৈরি ও রিক্রুট হয়। তাছাড়া জামায়াতের মতো মৌলবাদী সংগঠনগুলোর হাতে রয়েছে পেট্রো ডলারের বিশাল অর্থ ভাণ্ডার এবং ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি ব্যবসায়ের মালিকানা। দেশে বেকার সংখ্যা যত দ্রুত বাড়ছে, ততই মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনগুলোর পক্ষে অর্থ ও নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ক্যাডার তৈরি ও ক্যাডার সংগ্রহ সহজ হচ্ছে। তাছাড়া মসজিদভিত্তিক রাজনৈতিক প্রচারণার ফলে জনমানসে ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাবও বেড়েছে। তার পাশাপাশি এককালের শক্তিশালী সেক্যুলারিস্ট শিবিরের এখন প্রচারণা, অর্থশক্তি কম এবং তাদের প্রভাবও ক্ষীয়মাণ।

সমাজতান্ত্রিক আদর্শ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপর্যয়ের পর বিশ্বব্যাপী জঙ্গি মৌলবাদের অভ্যুত্থান দেখা যায়। এই জঙ্গিদের ইসলামিক টেরোরিস্ট বা জিহাদিস্ট বলা হয়। আসলে ইসলাম ধর্ম এবং তার জিহাদের সঙ্গে এই টেরোরিস্টদের সম্পর্ক খুব কম। এদের জন্ম পলিটিক্যাল ইসলামের শিবিরে। পলিটিক্যাল ইসলামের জন্মদাতা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদ আমেরিকা এখন রয়েছে এর নেতৃত্বে।
কমিউনিজম ও সোস্যালিজমের প্রসার ঠেকানোর জন্য মূলত সৌদি আরবের সহায়তায় এই পলিটিক্যাল ইসলামের জন্মদেয় আমেরিকা। লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় এক সময় এক বিশাল প্রতিবেদন বেরিয়েছিল আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা উচ্ছেদের জন্য তালেবান ও মুজাহেদিন দল সৃষ্টিপূর্বক স্কটল্যান্ডের এক গোপন পার্বত্য এলাকায় তাদের ট্রেনিং দেয়া সম্পর্কে। তাদের শরিয়ার আদর্শ শিক্ষাদানের নামে গণতন্ত্র, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, নারী শিক্ষা, নারী অধিকারের বিরুদ্ধে দৃঢ় মানসিকতা তৈরি করা হয়। এই মানসিকতা তাদের মধ্যে দৃঢ়মূল হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর তাদের আধুনিক অস্ত্র চালনা শিক্ষা দেয়া হয়। এ জঙ্গি ও জিহাদিস্টদেরই আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা উচ্ছেদের জন্য প্রত্যক্ষ মার্কিন সহায়তায় যুদ্ধে নামানো হয় এবং সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর তাদের মার্কিন অনুগত একাংশকে ক্ষমতায় বসানো হয়। শুরু হয় শরিয়া শাসনের নামে আফগানিস্তানে আধুনিক শিক্ষা বর্জন, নারী শিক্ষা বাতিল, শিল্পচর্চা থেকে শুরু করে প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার ধ্বংস সাধন। জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে পাকিস্তানে এ মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছিল।

সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর যখন মধ্যপ্রাচ্যের জিহাদিস্টদের সব অংশই বুঝতে পারে, আমেরিকা আসলে নিজেদের স্বার্থে তাদের ব্যবহার করেছে এবং স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা কোনো শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রের উত্থান আমেরিকার পছন্দসই নয়, তখন এক সময়ের বুশ পরিবারের ব্যবসায়ী বন্ধু ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে জিহাদিস্টদের মধ্য থেকেই আল কায়েদার জন্ম। নিউইয়র্কে নয় এগারোর ঘটনার পর লাদেন আফগানিস্তানে পালিয়ে যান। তখনও কাবুলের তালেবান গভর্মেন্ট আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র। ওয়াশিংটন এ তালেবান সরকারের কাছে লাদেনকে তাদের হাতে অর্পণের দাবি জানায়, তালেবান সরকার রাজি না হওয়ায় শুরু হয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আমেরিকার আফগান যুদ্ধ। এ যুদ্ধ পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়ে।
বছরের পর বছর ধরে আমেরিকা-আফগান যুদ্ধে ব্যাপৃত। কাবুলে তারা একটি তাঁবেদার সরকারও (কারজাই সরকার) প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু যুদ্ধের চূড়ান্ত জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়নি। যুদ্ধ ক্লান্ত আমেরিকা তালেবানদের সঙ্গে আপসে প্রস্তুত। কিন্তু আল কায়েদার সঙ্গে নয়। আমেরিকা এখনও তালেবানদের মিত্র শক্তি হিসেবে ফিরে পেতে আগ্রহী এবং মনে করে সমাজতন্ত্রী দুনিয়ার পতনের পর এশিয়া, আফ্রিকায় যে নতুন গণতন্ত্রী দুনিয়া গড়ে উঠছে, তাতে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী ও সামরিক আধিপত্য বজায় রাখার জন্য তালেবানরা তাদের সহায়ক শক্তি।

এজন্যই বাংলাদেশের জামায়াত যখন দাবি করেছে তারা সন্ত্রাসী দল নয়, আল কায়েদার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই (এই দাবি তারা অতি সম্প্রতিও করেছে) তখনই আমেরিকা বাংলাদেশের জামায়াতকে মডারেট ইসলামী দল বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের তালেবানদের প্রতি আমেরিকার যেমন সহানুভূতিমূলক মনোভাব, তেমন মনোভাব বাংলাদেশের জামায়াত এবং জামায়াত-বিএনপি জোটের প্রতি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে যতই ভালো কাজ করে থাকুক, যতই সন্ত্রাস দমন করে থাকুক; আমেরিকার সদয় দৃষ্টি সব সময় জামায়াত-বিএনপি জোটের দিকে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনেও আমেরিকার এ মনোভাব অত্যন্ত নগ্নভাবে প্রকট হয়েছে।
আমেরিকা কখনও কোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বন্ধু হয়েছে তার কোনো প্রমাণ নেই। সব সময় ডিক্টেটর, স্বৈরাচারী ও সামরিক শাসকদের বড় বন্ধু আমেরিকা। মজার ব্যাপার এই যে, এ বছর বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের একটি টেকনিক্যাল ত্রুটিকে অজুহাত হিসেবে খাঁড়া করে আমেরিকা গণতন্ত্রের নামে মায়াকান্না শুরু করেছে। আসলে বাংলাদেশে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকুক, এটা ওয়াশিংটনের কাম্য নয়। এশিয়ায় তাদের আধিপত্য রক্ষা ও বিস্তারের জন্য দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন সরকার ক্ষমতায় থাকুক তা তাদের ইচ্ছা নয়। ইচ্ছা এমন একটি সরকারকে ক্ষমতায় বসানো, যারা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের অন্ধ অনুসরণ করবে এবং এ ধরনের সরকার সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ মৌলবাদী হলেও তাদের আপত্তি নেই। কেন, মধ্যযুগীয় সৌদি রাজতন্ত্রের সবচেয়ে বড় মিত্র কি আমেরিকা নয়?
বাংলাদেশে ক্রাইসিস অব আইডেন্টিটি দূর করা, হাজার বছরের গতিশীল অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তার বিকাশ এবং তার ভিত্তিতে একটি জাতি-রাষ্ট্র বা নেশন স্টেটের প্রতিষ্ঠাকে বিঘ্নিত করার জন্য যেমন বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজেদের স্বার্থে তৎপর, তেমনি দেশীয় এলিট ক্লাসের অনুচররাও সক্রিয়। এককালে এ এলিট ক্লাসের যেসব শিরোমণি বাম রাজনীতি, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের এখন দেখা যাচ্ছে রাতারাতি দেশের বর্ণিত দুই শিবিরের মধ্যে নিরপেক্ষ থেকে বাস্তবে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শিবিরকে শক্তি জোগাতে।

বিশ্ব সমাজতন্ত্রী শিবিরের বিপর্যয়ের পর একক সুপার পাওয়ার হিসেবে সাম্রাজ্যবাদী ও ধনবাদী শিবিরটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিজেরা এবং দাতা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে দু’হাতে অর্থ ছিটিয়ে, সরকারের পাল্টা বিগ এনজিও প্রতিষ্ঠা করে তাদের পৃষ্ঠপোষকতার ছায়ায় একটি নব্য এলিট শ্রেণী তৈরি করেছে, যারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা, পাণ্ডিত্য ও প্রভাবকে এই বিশ্বধনবাদের স্বার্থের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। বাঙালির তথা বাংলাদেশের মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের সমস্যাকে তারা আরও জটিল করে তুলেছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির ধূম্রজাল ছড়াচ্ছে।
আগে বাঙালি জাতীয়তার ওপর ছিল খণ্ড খণ্ড আক্রমণ। কখনও বাংলা ভাষা, কখনও বাংলা হরফ, কখনও রবীন্দ্র সঙ্গীত বা নজরুলগীতি এবং কখনও বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর এ হামলা হয়েছে খণ্ড খণ্ডভাবে। এবং সেখানেও এই হামলার হাতিয়ার ছিল ধর্ম ও ধর্মের খোলসে ঢাকা সংস্কৃতি। বাঙালির লোকরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সবকিছুকেই ইসলাম-বিরোধী ও হিন্দুয়ানি আখ্যা দিয়ে বর্জনের অভিযান চালানো হয়েছিল। বাঙালি সংস্কৃতির নব রেনেসাঁ ও বাঙালি জাতীয়তার নব উত্থান তাকে প্রতিহত করেছে।

এবার যে ধাক্কাটি এসেছে, তা বাঙালির সার্বিক অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার ওপর হামলা। এই হামলা পলিটিক্যাল ইসলামের অন্ধ ও হিংস শিবির থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে। এই দানবের চোখ তার পেছনের দিকে, সামনের দিকে নয়। তার পৃষ্ঠপোষক আরও বড় দানব ডলার সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদ। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশে আওয়ামী লীগের মতো একটি ডান প্রগতিশীল দল এবং তার বাম সহযোগীরা নানা প্রক্রিয়ায় এই ‘মৌলবাদী-সাম্রাজ্যবাদী হামলা’ কিছুকাল হয়তো ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, যেমন রেখেছে ২০১৪ সালের জানুয়ারি নির্বাচনের সময়। কিন্তু কতদিন তা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে তা নিশ্চিত নয়।

আত্মপরিচয়ের দীর্ঘকালীন সংকট মোচন এবং বাঙালি মুসলমানের স্থায়ীভাবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য খণ্ডিত বাংলায় খণ্ডিতভাবে নয়; দুই বাংলায় সম্মিলিত গণআন্দোলন ও গণজাগরণ প্রয়োজন। হিন্দুত্ববাদ ও জিহাদিস্ট দুই মৌলবাদকেই অসাম্প্রদায়িক গণসংস্কৃতির প্রতিরোধে পরাজিত করা দরকার। দুই বাংলা এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভক্ত। এই বিভক্তি বজায় থাক। কিন্তু ইউরোপের কালচারাল নেশনহুডের মতো সর্ব উপমহাদেশীয় বাঙালির এই কালচারাল নেশনহুড গড়ে ওঠা দরকার। এই নেশনহুড গড়ে উঠলে দুই বাংলার মাটিতেই হিংস মৌলবাদের বীজ চারা গজাতে পারবে না। বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাত তার উৎস এই আত্মপরিচয়ের সমস্যার মধ্যে। এই সংকট নিরসনের সমাধানও নিজেদের আত্মপরিচয়ের সঠিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই নিহিত।

তথ্যসুত্র:

(আব্দুল গাফফার চৌধুরীর গবেষণাপত্র।)

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ