আপন আলোয় মুহাম্মদ ইউনুস

প্রকাশিত: ৩:০৭ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১১, ২০২১

আপন আলোয় মুহাম্মদ ইউনুস

সুরাইয়া বেগম* || ঢাকা, ১১ মার্চ ২০২১ : ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক – ব্যক্তি এবং সংগঠনের সাথে আমার প্রথম পরিচয় সেই ১৯৮২ সালে। আমি তখনও সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্রের একজন হইনি, একটা প্রজেক্টে কাজ করার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করে বের হবার পর আমার জীবনে সেটাই প্রথম গবেষণা। গ্রামীণ ব্যাংক তখন ‘গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প’ – এই নামে বর্তমান। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র দায়িত্ব পেয়েছিল ‘গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প’ – এর কাজের মূল্যায়ন করার। আমাদের ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হয়েছিল টাঙ্গাইল জেলার নারান্দিয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে। তখন জোবরা গ্রামের পর টাঙ্গাইল জেলাই গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের দ্বিতীয় পরীক্ষামূলক ক্ষেত্র।

সে সময়ের তরুন আমি প্রথম বাংলাদেশের গ্রামকে দেখি নিবীড়তায়। তখনকার গ্রাম তো আর এখনকার মত ছিলনা, এত সুযোগ সুবিধাও ছিল না। গ্রামে বাথরুম ছিল না , থাকার মত ভাল জায়গাও ছিল না। মেঘনা গুহঠাকুরতা আর আমি ফিল্ড ওয়ার্কে গ্রামীণ ব্যাংকের এক কর্মীর বাসায় ছিলাম। এক কক্ষের ঘর, পাটকাঠির বেড়া দেওয়া ; একটা চৌকি পাতা ঘরে আর একপাশে রান্নার সরঞ্জাম। গবেষণার জন্য অনেক জায়গায় থাকতে হয়েছে কিস্তু সব স্মৃতি মনে না থাকলেও টাঙ্গাইলের এই ফিল্ড ওয়ার্কের স্মৃতি এখনও স্পষ্ট। প্রথম বলেই হয়ত!

তেমনি স্পষ্ট প্রফেসর ইউনুসের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনটা। এখনও স্পষ্ট দেখি যে, শ্যামলীর অফিসে জাহাঙ্গীর স্যার, মেঘনা এবং আমি বসে অপেক্ষা করছি ড. ইউনুসের কক্ষে। তিনি ঘর থেকে এলেন, ব্যক্তি মানুষটা আমার দৃষ্টিতে ছিল লক্ষণীয়। তখন সদ্য গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে পড়াশুনা করছি। দুটো মূল্যায়ন রিপোর্ট – গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প সম্পর্কে কৃষি ব্যাংক এবং বি আই বি এম এর রিপোর্ট পড়েছিলাম। একটাতে ছিল গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষমতায়নের বিভিন্ন দিক আর কৃষি ব্যাংকের রিপোর্টে ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের অপারেশনাল দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা। একইসাথে ফিল্ডওয়ার্ক শেষ করে এসেছি, অদম্য কৌতুহল ব্যক্তি মানুষটিকে দেখার। প্রফেসর ইউনুস তখন পরিকল্পনাবদ্ধ কিভাবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পকে একটি পরিপূর্ণ ব্যাংকে রূপদান করা যায় তা নিয়ে। দীর্ঘ আলোচনায় সেটা নিয়েই কথা হল। গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের ভবিষ্যৎ যাত্রা নিয়ে। সেই যে যাত্রা শুরু, তা চলমান। পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন মাইলস্টোন পেরিযে বর্তমানে যেখানে অবস্থান সেটা সত্যিই ঐতিহাসিক। নোবেল বিজয়। যেদিন ইউনুসের নোবেল বিজয়ের খবর পাই সেদিন কেন যেন তাঁর এই বিজয়ের গৌরবের স্বাদটা আমার মনেও লেগেছিল। হয়ত জীবনের সেই প্রথম কাজের সম্পৃক্ততার কারণেই। খুব মনে পড়েছিল ১৯৮২ সালকে, টাঙ্গাইলকে আর সেই সব মুড়িভাজা, ধানভানা মহিলাদেরকে। সেইসব বিপদজনক একটা বাঁশ দিয়ে তৈরী সাঁকো পার হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম, কথা বলেছিলাম। দেখেছিলাম কি অদম্য উৎসাহ নিয়ে মুড়ি ভাজছেন। আরও দেখেছিলাম ব্যাংকের কর্মীদেরকে, প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষের মনের মধ্যে স্থিতিলাভের আশায় রাত দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

খুঁজে বের করলাম ১৯৮৩ সালের আমাদের সেই রিপোর্ট। যেখানে এসব দিকগুলো প্রাধান্য পেয়েছিল যে, সংগঠন পরিচালনায় সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বিদ্যমান, প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ব্যাংকিং সহায়তার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থাপনা এবং টেকনিক্যাল দক্ষতা দরকার তা সংগঠন আয়ত্ব করতে পেরেছে। সে সময়ে গ্রামীণ ব্যাংকের অপারেশনাল লেভেল ও ছিল খুবই সরল। সেখানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিল না বললেই চলে। আর গ্রামীণ ব্যাংকের তখনকার ডিজাইনের মধ্যে এটাও ছিলনা যে, পুরো সমাজব্যবস্থা বা ব্যাংকিং ব্যবস্থার পূনর্গঠন। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম যে, অংশগ্রহণমূলক আন্দোলনে গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকা, সহায়তা করা ছাড়াও দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের সামাজিক পরিচয় অনুধাবন করতে পারে কি না, তাদের নিজস্ব সমস্যা, পারিবারিক গতিশীলতা এবং অংশগ্রহণমূলক পুঁজির গঠন এবং সম্ভাবনা কী রকম।১

মুহাম্মদ ইউনুস ও গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেল বিজয় আবারও উৎসাহিত করেছে আমাদেরকে, দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ লেখাটা মূলতঃ লিখেছি “গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন”২ – মুহাম্মদ ইউনুসের আত্মজীবনীমূলক বইয়ের আলোকে এবং আমার অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে। বইটা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাথমিক অবস্থা, পথ পরিক্রমা আর বর্তমানকে তুলে ধরেছে সেই সাথে কিছু প্রশ্নকেও সামনে নিয়ে এসেছে। বইটিতে ইউনুসের আত্মপলোব্ধি এবং কিছু কিছু দিক উপস্থাপিত হয়েছে যা সত্যিই অনবদ্য। অবশ্য কিছু প্রশ্নবোধক বক্তব্যও আছে। বইটি আমাদেরকে জানতে সহায়তা করে সত্তর দশকের শেষভাগ আর আশির দশকের প্রথম ভাগের সময়টাকে। সে সময়ের বাংলাদেশের গ্রাম, অর্থনীতি, সমাজ, নারীর অবস্থান – এ সবই। এছাড়াও বৈশ্বিক পরিসরে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রসারতার একটা ধারাবাহিক ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া যায়।

গ্রামীণ ব্যাংক তার প্রাথমিক পর্যায়ে সদস্যদের মধ্যে বিশেষ করে নারী সদস্যদের মধ্যে আত্ম-অনুসন্ধানের দ্বার উন্মোচন করেছিল। একজন গৃহী নারী সংসারের ঘানিতে যুক্ত হয়ে ক্রমাগত ঘুরে যাচ্ছিল একঘেয়েমিতে, সেই নারী প্রথম নিজেকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল যে, তারও কিছু করণীয় আছে। সেও উপার্জন করতে পারে, এই বোধের জাগরণ একটা বিস্ফোরণ সৃষ্টি করেছিল সে সময়ে। যা আমরা দেখেছিলাম নারান্দিয়ার মুড়ি ভাজা, ধান ভানা মহিলাদের মধ্যে। একই সাথে গ্রামীণ ব্যাংকের যেসব নারী সদস্য ব্যাংকার হিসেবে যোগদান করেছিলেন তাদেরকেও সমাজের বিভিন্ন প্রথার বাইরে গিয়ে এই কাজ করতে হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের সাইকেল, মোটর সাইকেল চালনা নতুন হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছিল, নারীর গতিশীলতায় পরিবর্তন এনেছিল।

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনও নতুন কিছু সূচনা করতে গেলে অনেক ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় নারীদেরকে। তার মধ্যে কতকগুলো সাধারণ বিষয় হচ্ছে ধর্মান্তরিত করা, পর্দা প্রথার বিলোপ, ইসলামী অনুশাসন বিপন্ন হওয়া, স্বামী/ পিতার প্রতি বাধ্যতার বোধ কমে যাওয়া, ঘরের বাইরে বার হওয়া ইত্যাদি। এসবকে জয় করার জন্য স্থায়ীভাবে গ্রামে থেকেই কাজটা করে যেতে হয় আর সেই সঙ্গে পরিস্থিতির উপযোগী কৌশলী হতে হয়। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে গ্রামীণ নারীরা বিভিন্ন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সে প্রতিরোধ ছিল সামাজিক, মানসিক, পারিবারিক, ধর্মীয়। এটা একটা ইতিবাচক দিক আমাদের সামনে তুলে ধরে যে, সমাজের মধ্যে সবসময়ই একদল জনগোষ্ঠী থাকে যারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে, এগিয়ে আসে, এরাই অগ্রণী সমাজের। এই অগ্রণীরাই সমাজ পরিবর্তনের দিশারী। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপকতা লাভের সফলতা সেই ইঙ্গিত দেয় আমাদেরকে।

প্রথম দিকে গ্রামাঞ্চলের নারীদের ঋণ নেওয়া এবং শোধ দেবার ক্ষমতা অর্জন তাদের আত্মবিশ্বাসের ভিতকে শক্ত করে। ব্যক্তি নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে থাকে। ঋণ নিয়ে কি কাজে তা বিনিয়োগ করা হবে এতে গ্রামীণ ব্যাংকের খবরদারী না থাকা এবং গ্রাহকদের নিজেদের পছন্দ তাদেরকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এনে দেয়।

অধ্যাপক ইউনুসের দর্শনের মধ্যে যে সমষ্টির বোধ জাগিয়ে তোলার ব্যাপার আছে তা গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকান্ডের মধ্যে একদম প্রথম দিকে গ্রুপ গঠনের বিষয়টি ছিল না সেটি পরে পরিস্থিতির কারণে যুক্ত হয় কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দাবীতে। আর এটাও লক্ষণীয় যে, দল গঠন করবে সদস্যরা নিজেরাই। উপর থেকে নির্দেশানুযায়ী নয়, নিজেদের স্বাধীনতার মাধ্যমে দল গঠিত হবে। এই যে সকল সদস্যের অংশগ্রহণের বোধ এটি উল্লেখযোগ্য। যে সমষ্টিবোধ কোন সংগঠনের টিকে থাকার ক্ষেত্রে যে একটি অন্যতম বিষয় সে বিষযে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথম থেকেই সম্পৃক্ততা ছিল। ৩

যে সময়ে ইউনুস তাঁর প্রজেক্ট নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন সেটা ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ। একটা বিষয় স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন, সে সময়ের সমাজব্যবস্থা, দেশের প্রতি মমত্ব, বাম আদর্শবোধ তখন মানুষের মধ্যে একটা চেতনা সৃষ্টি করেছিল। অংশগ্রহণের বোধ তখন ইউনুসের মত অনেকের মনেই কাজ করছিল। যে বোধ সৃষ্টি হয়েছিল জাতীয়তাবোধ থেকে। সেই বোধের তাড়নাতেই বাংলাদেশে সত্তরের দশকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জন্ম হয় । সেই বোধেই প্রফেসর ইউনুস গ্রামীণ দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত নারীদের প্রতি তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত করেছিলেন। অন্বেষণ করেছিলেন তাদের দারিদ্র্যের অন্তর্নিহিত কারণের দিকে। আর খুঁজে পেয়েছিলেন ক্ষুদ্র ঋণের প্রয়োজনীয়তা, সৃষ্টি করেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প।

ইউনুস দারিদ্র্যের সংজ্ঞায়ন করেছেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এবং তাঁর বক্তব্য হচ্ছে দেশে দেশে দারিদ্র্যের পৃথক সংজ্ঞা হওয়া উচিৎ। দারিদ্র্যের বিশ্বজনীন সংজ্ঞার বদলে পৃথক পৃথকভাবে প্রতিটি জাতির দারিদ্র্যের মাপকাঠি নির্ণয় করা জরুরী। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের কাছে সংজ্ঞা স্পষ্ট না হলে উদ্দেশ্য ব্যহত হবে। দরিদ্র জনগণের নাম করে যে প্রচেষ্টা শুরু হবে শেষ পর্যন্ত তার সুফল ভোগ করবে দরিদ্র নয় এমন মানুষেরা। ৪

ইউনুস তাঁর কাজে এগিয়েছিলেন নিয়মনিষ্ঠতায়। পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে, সমস্যাকে চ্যালেঞ্জ করে তা উত্তরণের অভিপ্রায়ে। ধাপে ধাপে এগোনোর ফলে গ্রামীণ ব্যাংক স্থায়িত্ব পেয়েছে। এটাও লক্ষণীয় যে, প্রকল্পের শুরুতে তিনি গ্রামীণ নারীদের উপর তাঁর চিন্তা ভাবনাকে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেন নি। গ্রামীণ ব্যাংক গড়ে উঠেছে আত্মনির্ভরশীলতা গড়ে তোলার একটি সংস্থা হিসেবে। মানুষের অন্তর্নিহিত অনন্যসাধারণ ক্ষমতা সম্বন্ধে তাদের সচেতন করে গ্রামীণ ব্যাংক তাদের নিজেদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ করে, যারা এ কাজে উৎসাহী নয় গ্রামীণ ব্যাংক কখনও তাদের উপর চাপ দেয় না। তাঁদেরকে সুযোগ দিয়েছেন তাদের মত করে সংগঠিত হবার। যদিও তাঁর নিজস্ব একটা পথ ছিল এবং সে পথেই তিনি ধাবিত করেছেন জনগোষ্ঠীকে, তবে জবরদস্তি ছিল না। একটা স্পেস তিনি দিয়েছিলেন জনগোষ্ঠীকে তাদের মত করে সংগঠিত হতে।

যে বিষয়গুলিতে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ইউনুসের ভাবনায় নতুনত্ব নিয়ে এসেছে তা হচ্ছে গ্রামীণ সাধারণ মানুষকে সম্মান করা। প্রতিটি মানুষের মধ্যে যে সৃজনশীলতা আছে তাকে স্বীকৃতি দেয়া। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই যে সম্ভাবনা আছে তাকে গ্রহণ করা। মানুষের মধ্যেকার আত্মসম্মানবোধকে জাগ্রত করার চেষ্টা করা এবং সম্মান করা। যে বোধ থেকেই তিনি ভেবেছেন যে, জনগোষ্ঠী কেন ব্যাংকের কাছে যাবে এবং গিয়ে হেনস্তা হবে বরং ব্যাংকই জনগণের কাছে যাবে এবং সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে। একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে অংশগ্রহণকে জাগ্রত করা। এই বোধ জানানো যে, উন্নয়নের জন্যে সামগ্রিক অংশগ্রহণ জরুরী।

গ্রামীণ ব্যাংক তার সদস্যদের সঙ্গে যে গ্রন্থিতে আবদ্ধ তা হচ্ছে বিশ্বাসের, অন্তরের। আর এর জন্য দরকার হয়েছিল মানুষের মনের ভিতরে প্রবেশ করার। মানুষের মনের ভিতরে প্রবেশ করতে পারলে তার স্থায়িত্ব যে সূদুরপ্রসারী তার প্রমান আজকের গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেল প্রাপ্তি। কোন আইনী , দলিলের সম্পর্ক নয়, মনের সম্পর্কের মাধ্যমেই আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি করা এবং কাজ চালিয়ে যাওয়া। আইনী সম্পর্ক যে মজবুত নাও হতে পারে তার প্রমাণ আজকের বড় বড় ঋণখেলাপীরা। তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছেনা বাংলাদেশের কোন সরকার।

ক্ষুদ্র ঋণের অনেক সফলতার গাঁথা রয়েছে। কিন্তু ইদানীং গ্রামাঞ্চলে নারীদের সাথে কথা বলে জেনেছি যে, ঋণ নেবার প্রতি তাদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা কাজ করছে। কেন অনীহা এ প্রসঙ্গে তারা কতকগুলো বিষয়কে তুলে ধরেন যেগুলো ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে নতুন করে ভাবনার জন্ম দেয়। তারা যে কারণগুলো বলেন সেগুলো হচ্ছে, ১. যত টাকা ঋণ দেওয়া হয়, তার থেকে অনেক বেশি টাকা ফেরৎ দিতে হয় অর্থাৎ সুদের হার বেশি; ২. ঋণ নেবার পরবর্তী সপ্তাহেই কিস্তি দিতে হয় ফলে ঋণকে বিনিয়োগ করে উপার্জন করার আগেই কিস্তি দিতে হলে তাদের জন্যে তা যথাযথ সুফল বয়ে আনতে সমস্যা হয়; ৩. এই ঋণ ব্যবস্থা তাদেরকে এমনভাবে জড়িত করেছে যে, এর ফলে তাদেরকে সারা জীবনই ঋণী হয়ে থাকতে হয়, যা তাদের অভিপ্রেত নয়; ৪. কিস্তির টাকা পরিশোধের জন্য যে চাপ সৃষ্টি করা হয় তা তাদের জন্যে মানসিক নির্যাতনমূলক। যদিও এসব বক্তব্য সমগ্র বেসরকারি সংস্থার ক্ষুদ্র ঋণ সম্পর্কে উচ্চারিত হয়ে থাকে, এককভাবে গ্রামীণের উপর বর্তায় না। আরও একটা কথা বলা হয়ে থাকে যে, ক্ষুদ্র ঋণ কি আসলে তাদের গরিবী হটাতে পেরেছে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর তাদেরকেই খুঁজে বার করতে হবে যারা এ নিয়ে কাজ করছেন।

আমাদের গবেষণা এলাকা নারান্দিয়া ইউনিয়নের বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ অভিযোগ করেছিলেন যে, গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের প্রবর্তনের ফলে এলাকায় মজুরীর বিনিময়ে শ্রমিক পাওয়া সমস্যাজনক হয়ে উঠেছে। এটা একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিত দান করেছিল যে, এর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী হয়তবা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে, দারিদ্র প্রকট হয়ে উঠতে পারবে না গ্রামীণ এলাকায়। বর্তমান বাংলাদেশের গ্রামীণ চিত্র কি একে সমর্থন করছে?

যে প্রশ্নটা আমাদেরকে বারে বারেই তাড়িত করে তা হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক দীর্ঘ ১৯৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অনেক দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানে এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে কি কোন গভীর প্রভাব রাখতে পেরেছে? গ্রামীণের সদস্যরা কি দেশের বৃহত্তর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে পারছে? আমাদের দেশের অর্থনৈতিক দূর্বলতা দূর করাতে গুরুত্বপুর্ণ অবদান রাখতে পারছে? সম্মিলিতের প্রচেষ্টায় বড় কিছু করা সম্ভব এই নজির স্থাপন করতে পারছে? যদি একটা শক্তিশালী অর্থনীতি আমাদের দেশে বিরাজ করত তাহলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী খুব সহজেই দারিদ্রসীমা অতিক্রম করতে পারত। যেটা মালয়েশিয়াতে ‘আমানা ইখতিয়ার’ প্রকল্পের মাধ্যমে সেখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী করতে সক্ষম হয়েছে।৫

গ্রামীণ ব্যাংকের এক পর্যায়ে ছিল শুধুই সাফল্যের গাঁথা। ব্যক্তি তার দারিদ্র্যকে কাটিয়ে উঠছে, হাত পা মেলে চারপাশে তাকাবার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু এটাই কি সার্বিক উন্নতি? উন্নতি তো ক্রম-উচ্চমান, উপরের দিকে ক্রমাগতই এগিয়ে যাওয়া, স্থবিরতা নয়। অর্থনীতিবিদ ইউনুস কি তাঁর ৬৭ লাখ জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে উর্ধ্বমুখী করার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ রাখতে পেরেছেন? দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নতি হলে বাজারকে কেন নিয়ন্ত্রিত হতে হয় সিন্ডিকেটের আধিপত্যে? সাধারণ মানুষ কেন হতাশায় বিক্ষুব্ধ হন?

ইউনুস রাজনীতিকে দূরে রেখে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন, কিন্তু দারিদ্র্য নিজেই একটি শক্তিশালী রাজনীতি। এই রাজনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে, তাকে পরাজিত করতে হলে রাজনীতি দিয়েই তা করতে হবে। সে রাজনীতি বৃহত্তর রাজনীতি থেকে বিযুক্ত নয়। যদি দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ করতেই হয়, দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতেই হয় তাহলে এখন সময় এসেছে দারিদ্র্যকে বৃহত্তর রাজনীতির পরিসরে পরিমাপ করার। সেক্ষেত্রে প্রফেসর ইউনুসের কাজ করার ক্ষেত্র অনেকগুণে বেড়ে গেল। আমরা আমাদের সহৃদয় সহায়তার মনোভঙ্গী নিয়েই অপেক্ষা করছি প্রফেসর ইউনুসের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের।

প্রশ্ন মনে আসে যে, দারিদ্র্য নিরসন যদি শান্তি আনয়নের সূত্রপাত করে তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি হবার পরও পাশাপাশি দেশে জঙ্গীবাদ, অশান্তি বৃদ্ধি পেল কেন?

বর্তমানে গ্রামে গেলে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, জনগোষ্ঠী এখন সহজে ঋণ গ্রহণ করতে চায়না। তারা মনে করে যে, একবার ঋণ নিলে তারা সারাজীবনের জন্যে ঋণী হয়ে যান, এই ঋণ আর শোধ হয় না। ঋণ গ্রহণে এক ধরনের বৈরী মনোভাব দেখা যায়। এটা শুধুমাত্র গ্রামীণের উপরই বর্তায় না কারণ গ্রামাঞ্চলে এখন বিভিন্ন এনজিও ঋণ প্রদান করে থাকে। কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এই বৈরী মানসিকতাকে জানতে হবে এবং বোঝার চেষ্টা করতে হবে, আমলে নিতে হবে নতুবা নীতি নির্ধারণে স্থবিরতা নিয়ে আসবে।

‘গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন’ বইটা পড়তে গিয়ে দেখেছি গ্রামীণ ব্যাংক সময়ের সাথে সাথে ক্ষুদ্র ঋণ ছাড়াও বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। যেমন গৃহনির্মাণ ঋণ, স্বাস্থ্য এবং অবসর, গ্রামীণ চেক, মৎস ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ ফোন, গ্রামীণ ট্রাস্ট ইত্যাদি। কোথাও এ বিষয়টি স্পষ্ট না যে, এসব সিদ্ধান্তের সঙ্গে গ্রামীণের লক্ষ সদস্যের কোন অংশগ্রহণ আছে কি না, কিংবা থাকলে কীভাবে আছে। বইটির প্রথম দিকে গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের সম্পৃক্ততা যত বেশি শেষের দিকে ততটাই কম।

সেই ১৯৮২তে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরাসরি কাজ করেছিলাম। মাঝখানের সময়ে এর অগ্রযাত্রা নিয়ে অনেক লেখালেখি পড়ারও সুযোগ হয়েছে কিন্তু আমি নিজে কিছু লিখিনি। এবার মুহাম্মদ ইউনুস সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অনুভূত হলো গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে আরও জানতে হবে। এই তাগিদ এবং চাহিদা আমার মধ্যে সৃষ্টি হওয়াটা আমার জন্যে একটা বড় লাভ একথা বলা যায়।

সবশেষে বলব, বইটা পড়তে পড়তে আমার কাছে মনে হয়েছে একটা স্পষ্ট দূরদৃষ্টি না থাকলে, আদর্শের প্রতি স্থিত না হলে এবং লেগে না থাকলে যে কাজ করতে চাই তার সফলতা সম্ভব নয়। যে স্পষ্ট প্রতীতি নিয়ে ইউনুস গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে এগিয়েছেন তা তাঁর এক ধরনের অধ্যবসায়। সবচেয়ে বড় হচ্ছে কমিটমেন্ট, অন্যের জন্য ভালবাসার বোধ। যে বোধ কর্মকে এগিয়ে নিয়ে যায় সামনের দিকে।

তথ্যপঞ্জি

১. B.K. Jahangir, Meghna Guhathakurta, Suraiya Begum, Rahnuma Ahmed, Milu Shamsun Naher, An Evaluation of Grameen Bank : A Case Study of Narandia Union, Centre for Social Studies, Dhaka, 1983
২. মুহাম্মদ ইউনুস, গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন, মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ২০০৪
৩. পূর্বোক্ত, পৃ ৯৮-৯৯
৪. পূর্বোক্ত, পৃ
৫. আবুল মাল আবদুল মুহিত, “নোবেল পুরস্কার, অধ্যাপক ইউনুস ও গ্রামীণ ব্যাংক”, আবুল হাসনাত (সম্পাদিত) কালি ও কলম; সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা , তৃতীয় বর্ষ: দশম সংখ্যা, ঢাকা, নভেম্বর ২০০৬, পৃ ১৫

আমার যত লেখালেখি – এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল সমাজ নিরীক্ষণ প্রত্রিকায়, ড. মো: ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর পরই।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ