সিলেট ২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১:৩৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২, ২০২১
০২ এপ্রিল ২০২১ : আমার মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের লেখা “উদয়ের পথে” এক অংশ (প্রথম আলো থেকে- প্রথম প্রকাশ ১৯৭২ বাংলার বাণী) পর্ব ৩
পাকিস্তানি সেনারা আমাদের বাড়িতে প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টাকাল লঙ্কাকাণ্ড করে যখন চলে যায়, তখন আমরা যেন পাথরের মতো হয়ে গেছি। কেউ একটুও নড়ছি না। কারও মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। খুব সাবধানে চারদিকে চোখ বুলিয়ে আগে দেখলাম কেউ কোথাও আছে কি না। ওপর তলায় আমি ও আতিয়া আর পাশের ঘরে হাবিব সাহেবরা দরজা বন্ধ করে রয়েছেন। নিচে শুধু আমার আব্বা একা। এমন অবস্থায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল এক ভয়ংকর উত্তেজনায়। তখন আমাদের করণীয় তো কিছু ছিল না।
অন্যদিকে একই সময় অর্থাৎ নিদারুণ সেই মুহূর্তে সূক্ষ্ম এক বেদনার অনুভূতির জ্বালা অনুভব করছিলাম প্রাণের এক অবচেতন কোণে। আমি এক কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম আমার অজান্তেই, কী আশ্চর্য মানুষের মন। মনে হচ্ছিল, তাজউদ্দীন আমাকে কিছুই বলে গেল না। কোনো পথের ইঙ্গিতও সে জানাল না। সেই রাত সাড়ে দশটার দিকে তিনি আবদুস সামাদ আজাদ ও মোহাইমেন [এম এ মোহাইমেন, পাইওনিয়ার প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ সদস্য] সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় এলেন। আমি লক্ষ করলাম, গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন তাজউদ্দীনের মুখমণ্ডল। তিনি আসার পর আরও কয়েকজন এলেন। নূরজাহান মুরশিদও এলেন। এরপর সবাই চলেও গেলেন। তখন তাজউদ্দীনের সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। সবাই চলে যাওয়ার পর দেখলাম তিনি বাসার সামনের খোলা জায়গায় পায়চারি করছেন। মনে হচ্ছিল তিনি কোথাও যাবেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেন আমাদের বাসায় এলেন। তাঁরা আসার পর তাজউদ্দীন প্রায় ঝড়ের বেগে তাঁদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার মুহূর্তে তিনি ছুটে এসে আমার কাছ থেকে থলে ব্যাগটা নিয়ে গূঢ়তত্ত্ব কথা বলে চলে গেলেন। সে সময় মনে হলো তাঁর কথার একটা শব্দ ভেসে এল শুধু, ‘আমি চলে যাচ্ছি, আমি চলে যাচ্ছি।’ কোনো কথাই শেষ মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে বলা হয়নি। ভাবছিলাম, তিনি কি আমাকে এভাবে বিপদের মুখে ফেলেই চলে গেলেন! কী করে সম্ভব হতে পারল। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই এর উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধিকারের প্রশ্ন এমন জ্বলন্ত বাস্তব সত্যের আভায় ভাস্বর হয়ে উঠেছিল সেই মুহূর্তের সিদ্ধান্তে, যার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর চার সন্তান ও স্ত্রী।
২৫ মার্চের নিদারুণ অস্বস্তিকর সে রাত হারিয়ে গেল দানবদের এক মহাতাণ্ডবের মধ্য দিয়ে। মর্টারের গোলা ও মেশিনগানের গুলির শব্দে তখনো চারদিক প্রকম্পিত। সারা রাত রাস্তায় ট্রাক ও জিপে করে মিলিটারিরা সরব ছোটাছুটি আর অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কারফিউ ঘোষণা করেছে। রাত প্রভাত হলো, ভয়ার্ত নিঃস্ব একটি সকাল। অনুভূতিহীন প্রাণে বেঁচে আছি বুঝতে পারছি। কিন্তু কী হয়ে গেল, আর কী হতে যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি দারুণ বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম কীভাবে বাড়ি ছেড়ে পালাব। দেখলাম মিলিটারির আনাগোনা অব্যাহত আছে। সেটি দেখে মনে হলো নিজ বাসায় থাকা এক মুহূর্তও নিরাপদ নয়। তখনো রাতের মতোই থেমে থেমে গোলাগুলি আর মর্টারের শব্দ আকাশ–বাতাস কাঁপিয়ে তুলছিল। আমাদের বাসার দক্ষিণের একতলা বাড়িতে এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক সপরিবার ভাড়া থাকতেন। অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতেই অনেকের মতো তাঁরা দেশের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন বয়স্ক এক নারীকে। তিনি সেই বাড়ি দেখাশোনার পাশাপাশি সেখানে এক পাল হাঁস-মুরগি পালতেন।
অন্ধকার কেটে যাওয়ার পর আমি অতি সন্তর্পণে দোতলার পেছনের গোল বারান্দা দিয়ে সেই দক্ষিণের বাড়িতে যাওয়া যায় কি না দেখছিলাম। তখন সকাল ছয়টা হবে। দক্ষিণের বাড়ির ওই বয়স্ক নারীকে দেখলাম। দৈনন্দিন ধারাবাহিক কাজে ব্যস্ত। একটু চাপা আওয়াজে তাঁকে বললাম, ‘একটা টুল দেয়ালের ওপাশে রাখ, আমি তোমাদের বাসায় আসব বাচ্চা দুটোকে নিয়ে।’ উত্তরের আশায় আর থাকতে হলো না। বয়স্ক নারী বললেন, ‘মাগো মা, বাসায় কেউ নাই, আমিই বাইরে থাকি’, এই বলেই তিনি ভেতরে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলেন। দুশ্চিন্তায় আমার মন ছেয়ে গেল।
কিছুক্ষণের জন্য হয়তো একটু আনমনা ছিলাম। আমাদের উত্তর দিকের বাসায় থাকতেন তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার [বর্তমানে এ নামে কোনো দেশ নেই] এক কূটনীতিক। তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের মার্চের প্রথম সপ্তাহে দেশে পাঠিয়েছিলেন। আমার নজর সে বাড়িতে পড়তেই দেখি সেই যুগোস্লাভিয়ান ভদ্রলোক উঠে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন। রাতে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন সব শেষ। তাই আমাকে দেখামাত্র বেশ উত্তেজিত হলেন তিনি। এরপর অতি সাবধানে ইশারায় জানতে চাইলেন, আমি তাঁর আশ্রয় চাই কি না এবং কোনো প্রকারে সেখানে যেতে পারি কি না। কিন্তু সে বাড়িতে যাওয়ার পথে দক্ষিণের বাড়ির কোনার মতো কোনো আড়াল নেই। গেটের সামনে রাস্তায় মিলিটারি পাহারা রয়েছে তখন। ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য দেয়াল টপকানো একেবারে অসম্ভব। এত বড় ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। ইশারায় সেটা তাঁকে বোঝালাম।
আর তখনই আমার নজরে পড়ল আমাদের বাড়িতে সানশেডে কী যেন লাগানো রয়েছে। দেড় হাত লম্বা ওয়ারলেসের একটা জিনিস। সেটা দেখে আমি চমকে উঠে সচেতন হলাম। আমার মনে হলো এটা পাকিস্তানি আর্মিরাই লাগিয়ে রেখেছে আমাদের গতিবিধি নজরদারি করার জন্য।
এর মধ্যে আমি আমাদের গৃহকর্মী দিদারকে দিয়ে নিচতলার দেয়ালে টাঙানো আমার সব ছবি সরিয়েছি। কে জানে যদি কোনো মিলিটারি চ্যালেঞ্জ করে বসে। এই সময় হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে আমরা আবার কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভাবলাম, এবার বুঝি সব শেষ। বেলের শব্দে আমার আব্বা ঘরের বাইরে গেলেন। দেখলাম কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তাঁকে ছাদ থেকে শোকচিহ্নের কালো পতাকা নামিয়ে ফেলতে এবং পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ওড়াতে বলছেন। আব্বা অতি নম্রভাবে তাদের কথায় রাজি হয়ে তখনই সে কাজগুলো করলেন। এরপর তারা চলে গেল। সকাল তখন আটটা। দিদারকে ট্রে হাতে দোতলায় নাশতা নিয়ে আসতে দেখে উর্দুতেই তাকে বকলাম চাপা গলায়। নিচতলা থেকে আব্বা এসব খাবার পাঠিয়েছেন আমাদের জন্য। আমরা তো তখন ভাড়াটে ভান করে রয়েছি। নিচ থেকে এত আনাগোনা হলে ধরা পড়ে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা।
নাশতা টেবিলের ওপরই থাকল পড়ে। আমি, মিমি, আতিয়া এবং তার গত রাতের মেহমান হাবিব ভাই ও তাঁর স্ত্রী, আমরা টেবিলের চারদিকে বসে আছি স্তব্ধ হয়ে। খাবার পড়ে আছে টেবিলে। কিন্তু কে খায়। গলা দিয়ে নামার পথও যেন বন্ধ। রেডিওটা টেবিলের ওপরেই ছিল। ঢাকা সেন্টার খুলে দেখি বন্ধ। একটু পর এক উর্দুওয়ালার বিকৃতভাবে উচ্চারিত বাংলা দু-একটা খবরেই বুঝলাম, কোনো বাঙালি যায়নি। উর্দুওয়ালা বিকৃত বাংলায় সংবাদ পরিবেশ করছে। হায়, তবে কি সব মেরে শেষ করে ফেলেছে? আতিয়াও উদ্বিগ্ন। গত রাতে তার স্বামী আজিজকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে। আমার দুই ভাগনে ও বারিক মিঞাকে নিয়েছে।
তাঁদের হয়তো রাতেই শেষ করে ফেলেছে। চিন্তায় বাধা পেলাম আতিয়ার প্রশ্নে। সে বলল, ভাবি, আজিজ ফিরে আসবে কখন? ওদের তো কোনো দোষ নেই, কেন ধরে নিয়ে গেল? কারফিউ এখনই উঠে যাবে তো? এতগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে করে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল আতিয়া।
চলবে পর্ব ৪
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D