মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু : মেনন

প্রকাশিত: ৫:১১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২০, ২০২১

মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু : মেনন

বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ২০ নভেম্বর ২০২১ : “মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাসানীর কাছে তাই বাঙালির ঋণ কিছু কম নয়। কিন্তু ঋণ স্বীকার করা তো দূরের কথা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে তাঁকে স্মরণটুকু পর্যন্ত করা হয়নি। জাতীয় পর্যায়ের ন্যূনতম কোন অনুষ্ঠানে নয় বরং তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর শ্রদ্ধানুষ্ঠান রাজনৈতিক মারামারিতে রূপ নিয়েছে। দলীয় অহমিকা ও অন্ধত্ব ছাড়া ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ সেখানে কাজ করেনি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের অগ্রবর্তীস্থান যখন এখন ইতিহাস স্বীকার করছে। এমনকি ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উৎসবে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি প্রেসিডেন্ট কমিউনিস্টদের সেই ভূমিকার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন, তেমনি স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে স্বাধীনতা সংগ্রামে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বদানকারী ভূমিকাকেও স্বীকার করা হবে। সেদিন আমরা থাকব না, কিন্তু নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের ইতিহাসকে সঠিক জায়গায় স্থাপন করবেন।”

শনিবার (২০ নভেম্বর ২০২১) বিকেল ৩টায় স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর কর্মসূচিতে মওলানা ভাসানীর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মরণে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি জননেতা কমরেড রাশেদ খান মেনন এমপি এসব কথা বলেন।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মিলনায়তনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি আয়োজিত ঐ আলোচনা সভায় ‘মওলানা ভাসানী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. মেসবাহ কামাল।
কমরেড মেনন বলেন, যখন কেউ ভাবতেই পারেনি তখন ১৯৪৮-এ পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের সুনির্দিষ্ট রূপ তুলে ধরেছিলেন। সেটাই অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে সোহরওয়াদী যখন সংখ্যাসাম্য নীতি মেনে নিয়েছিলেন, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত্বশাসনকে পায়ে দলে ছিলেন, মওলানা পাকিস্তানী ষড়যন্ত্রকারী শাসকগোষ্ঠীকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন না পেলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানাতে দ্বিধা করবেন না বলে হুঁশিয়ারী দিয়েছিলেন। এজন্য তাকে দল ছাড়তে হয়েছিল, তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সেক্রেটারি মুজিবের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ হয়েছিল। আবার সেই মুজিব যখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা রূপরেখা তুলে ধরায় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দী’ তখন তিনিই আটষট্টির ডিসেম্বরে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অর্গল খুলে দিয়েছিলেন। ষোলই ফেব্রুয়ারি, পল্টনে আয়ুবকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করেছিলেন যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া না হয় তা’হলে বাস্তিল দুর্গের মত ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে মুজিবকে মুক্ত করে আনবেন। সেনা কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লেও মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার স্বপ্নকে ছাড়েন নাই।

মেনন বলেন, সত্তরের জলোচ্ছাসে দক্ষিণবঙ্গ যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত তখন সেখান থেকে ফিরে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানী শাসকদের উল্লেখ করে আঙুল তুলে বলেছিলেন। ‘ওরা কেউ আসে নাই’। আর ১৯৭১-এর জানুয়ারিতে আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার।’
মেনন বলেন, একাত্তরের গণহত্যার পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তার সন্তোষের বাড়ী পুড়িয়ে দিয়েছে তখন তিনি একাই বেড়িয়ে পরেছেন, সিরাজগঞ্জ থেকে দুই সঙ্গী নিয়ে ভারতে গেছেন আশ্রয়ের জন্য নয়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিতে। সেই সময় তার একান্ত সচিব সাইফুল ইসলামের ভাষ্যমতে মওলানা ভাসানীকে চীন নিরাপত্তা দিতে চেয়ে তাদের সাথে যেতে বলেছিল তিনি যাননি। বরঞ্চ চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর কাছে পাঠানো একাধিক টেলিগ্রামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের সমর্থন চেয়েছেন। চীনের ভূমিকায় তার হতাশাব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার মুক্তিযুদ্ধে অপর কোন দলের অংশগ্রহণ অস্বীকার করে চললেও তাদের শেষ পর্যন্ত যেতে হয়েছে মওলানা ভাসানীর কাছেই। জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে তাকে চেয়ারম্যান করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের ভূমিকায় বিশেষ করে অন্য কোন দলকে স্বীকার না করা, নিজেদের অন্তর্কলহে লিপ্ত থাকার ঘটনাবলীতে মওলানা ভাসানী বিরক্ত হলেও, তার মতদ্বৈততা থাকলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের ঐক্য রক্ষায় নিরলস ছিলেন। পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনে খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপোষহীন। ঐ সময় আমাদের কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে আমাদের প্রতি শেষ কথা ছিল ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে।’
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ভারতে মওলানা ভাসানীর অবস্থান সম্পর্কে মেনন বলেন, ভারত সরকার তাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে মেহমানদারী করলেও তার চলাফেরা ছিল নিয়ন্ত্রিত। তার সঙ্গী একান্ত সচিব সাইফুল ইসলামে বইয়ের লেখা অনুসারে তিনি উত্তর ভারতে ছিলেন মুক্ত, পূর্ব ভারতে নিয়ন্ত্রিত। মওলানা ভাসানী দেশে ফিরেও তার মৃত্যু পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ভারতে তার অবস্থান সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি। বরঞ্চ যতই মতদ্বৈততা থাক তার কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হোক সে ব্যাপারে তিনি সবসময় সাবধান থেকেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ঐক্যকেই প্রধান হিসেবে দেখেছেন। তার ঐ সময়কার ভূমিকার নির্যাস আমরা সবাই ভিন্ন দলের হয়েও যিনি তার একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন সেই সাইফুল ইসলামের ‘স্বাধীনতা ভাসানী ভারত বইতে।’
মেনন আরও বলেন, ভারত যখন মুুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঠায় তখন বিজয়ের পরপরই ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতে বাংলাদেশ থেকে যত দ্রুত ভারতীয় সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিতে, যেমন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন থেকে দেশে ফিরতে দিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে প্রথম সাক্ষাতেই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিষয়টি উত্থাপন করেন।
মেনন বলেন, মস্কো-পিকিংবিরোধ, দুই দেশের পার্টির প্রতি অন্ধ আনুগত্য মওলানা ভাসানীকে বামপন্থা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তিনি ইসলামেই মজলুমের মুক্তিও তার আদর্শ বাস্তবায়নের পথ খুঁজেছেন। হুকুমতে রব্বানিয়া, খোদাই খিদমতগারের কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের জাতিসত্তার প্রাণভোমরা অসাম্প্রদায়িকতা থেকে এতটুকু টলেননি। মৃত্যুর কিছু আগে পিজি হাসপাতালের রোগশয্যা থেকে জিয়াউর রহমানের দোসর উপসামরিক আইন প্রশাসক এয়ার মার্শাল তোয়াবের পৃষ্ঠপোষকতায় সিরাতুন্নবী সম্মেলনের নামে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী জামাতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে পুনসংগঠিত করার হীন প্রচেষ্টাকে এক বিবৃতির হুমকিতেই বন্ধ করতে বাধ্য করেছিলেন। আজ যখন সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতা গণতন্ত্র ও প্রগতির প্রধান বিপদ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে, তখন এক মওলানা ভাসানীই পারতেন দেশ ও সমাজকে সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে রক্ষা করতে।
মেনন বলেন, আওয়ামী লীগ মওলানা ভাসানীকে অস্বীকার করে মস্কোপন্থীরা এখনও তাকে ‘আয়ুবের দালাল’ হিসেবে প্রচার করে, আর পিকিংপন্থীরা তাকে জুড়ে দেয় সাম্প্রদায়িক বিএনপির সাথে, কিন্তু মওলানা ভাসানী ভাস্বর হয়ে আছেন, থাকবেন ‘সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মজলুম’ মানুষের কণ্ঠস্বর আপোসহীন হিসেবে।
মেসবাহ কামাল বলেন, পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম প্রবক্তা ছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। আর তাকে বাস্তব রূপদান করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাসানী আর মুজিব ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক। একে অন্যকে প্রভাবিত করেছেন এভাবেই বাংলাদেশে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদ এসেছে, গণতন্ত্রের পাশাপাশি সমাজতন্ত্র এসেছে।
সভা সঞ্চালনা করেন ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড মাহমুদুল হাসান মানিক।