সিলেট ২৫শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:৪০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২১, ২০২২
নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ২১ জানুয়ারি ২০২২ : বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। অথচ সময় যত যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূরাজনৈতিক নানা সমস্যা বাড়ছে। অন্যদিকে তিস্তার দুই পারের মানুষেরা শুষ্ক মৌসুমে পানিসংকটে পড়ছে আর বর্ষায় প্রবল বন্যায় ভাসছে। ফলে এই নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হতে হবে। এটি হতে যত দেরি হবে, পরিস্থিতি তত জটিল হবে, ভূরাজনীতির হিসাব তত বড় হবে।
আজ শুক্রবার (২১ জানুয়ারি ২০২২) একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত সপ্তম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বক্তারা এসব কথা বলেন। তিন দিনব্যাপী এবারের সম্মেলনের মূল বিষয় ‘তিস্তা নদী অববাহিকা: চ্যালেঞ্জ উত্তরণের উপায়’। এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নদী বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।
আলোচনায় সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘যেহেতু তিস্তা নিয়ে ভূরাজনীতি এবং এই অববাহিকার দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ঢুকে পড়েছে, সেহেতু আমাদের অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। আমাদের পানি আইন অনুযায়ী স্থানীয়দের সঙ্গে কথা না বলে নদী নিয়ে কোনো পরিকল্পনা এবং প্রকল্প করা যাবে না।’
বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের (বিসিএএস) নির্বাহী পরিচালক আতিক রহমান বলেন, তিস্তা নদীর ওপরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। অন্যদিকে এর ওপরে একের পর এক অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। ফলে এই প্রভাব মিলিয়ে নদীটির প্রতিবেশব্যবস্থার অবনতি হচ্ছে। যে কারণে তিস্তার সামগ্রিক অবস্থার উন্নতির জন্য এসব দিক বিবেচনা করে এগোতে হবে বলে তিনি মত দেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘তিস্তার উজানে ভারত ও ব্রহ্মপুত্রে চীন অনেক বড় অবকাঠামো তৈরি করছে। তিস্তাতে পাওয়ার চায়না নামে একটি কোম্পানি প্রকল্প করতে যাচ্ছে। এই একই কোম্পানি বরিশালে কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। এটি বাণিজ্যিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এর নির্মাণকাজ চলা অবস্থায় নদী দখলের ঘটনা ঘটেছে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, বরগুনার তালতলী বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তিস্তা প্রকল্প একই সূত্রে গাঁথা; যা বঙ্গোপসাগরের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সুযোগ তৈরি করবে। যা বঙ্গোপসাগরের ওপর চীনের ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অংশ। তিস্তার সমস্যা নিয়ে আমাদের বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, চীন ও নেপালকে নিয়ে একসঙ্গে আলোচনা করতে হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমাদের উচ্চ আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু নদী নিয়ে কোনো সমঝোতা ও আলোচনা করতে গেলে সেখানে রাজনীতি মুখ্য হয়ে ওঠে। যেমন একসময় ভারতে ফারাক্কা বাঁধ উন্নয়নের জন্য নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এখন সেখানকার বিপুলসংখ্যক মানুষ এই বাঁধের বিপক্ষে রয়েছে। আমাদের একটি যৌথ নদী কমিশন আছে, যাদের তিস্তা নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। ওই কমিশনের বেশির ভাগ সদস্য সাবেক আমলা ও প্রকৌশলী। আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ড আছে, যাদের প্রধান কাজ স্থাপনা নির্মাণ করে নদী ধ্বংস করা।’
রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘তিস্তার ওপরে গজলডোবাসহ নানা স্থানে ভারত যেসব অবকাঠামো নির্মাণ করেছে, এর পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা বা অন্যান্য তথ্য বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করেনি। নদীটিকে কখনোই প্রতিবেশগত সত্তা হিসেবে দেখা হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রেও আমরা একই অবস্থা দেখেছি। তার মানে প্রতিবেশীর সঙ্গে তথ্য বিনিময় করার মতো মানসিক অবস্থা পর্যন্ত তৈরি হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ায় পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে অবিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে। ফেনী নদীর পানি চুক্তি নিয়ে বুয়েটের এক শিক্ষার্থী দ্বিমত পোষণ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে সরকারি দলের লোকদের হাতে খুন হন। তার মানে পানি চুক্তি এবং ব্যবস্থাপনা যে কতটা ভূরাজনৈতিক বিষয়, তা প্রমাণ করে।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘তিস্তাপারের মানুষের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। আমরা ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন করেছি তিস্তাকে কেন্দ্র করে, সেখানে কয়েক লাখ মানুষ অংশ নিয়েছেন। এই নদী নিয়ে মহাপরিকল্পনা হচ্ছে, কিন্তু আমরা কিছু জানি না। তিস্তার সঙ্গে ২৫টি নদীর সম্পর্ক আছে। তিস্তার পানি কমে যাওয়ায় এর সব কটি শাখা নদীর পানি কমে আসছে। ভাঙন বাড়ছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে। এরপর তিস্তাপারের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একই সূত্রে বাঁধা এবং অবস্থানে আছে কি না, আমার সন্দেহ আছে।’
তুহিন ওয়াদুদ আরও বলেন, তিস্তার বয়স ২৩৪ বছর। কিন্তু এই নদী নিয়ে এখন পর্যন্ত যৌথ কোনো সমীক্ষা হয়নি। তিস্তা ১০ হাজার কিউসেক পানি ধারণ করতে পারে। কিন্তু সেখানে ওই পরিমাণে পানি শুষ্ক মৌসুমে আসে না। তিস্তায় এখন ধুলার স্তর তৈরি হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন করতে হবে। এই পানি আটকে রাখলে, তা সম্ভব নয়। এই পানি ভারত আটকে না রাখলে, তা বঙ্গোপসাগরে চলে যেত। বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশনে স্বাক্ষর করে তিস্তার মতো যৌথ নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জয়ন্ত বসু বলেন, ‘তিস্তা নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আছে। ফলে তিস্তা চুক্তি হতে পারছে না। আর এই নদী নিয়ে পরিকল্পনা করতে হলে আমাদের শুধু সেচ বা বিদ্যুতের কথা চিন্তা করলে হবে না। নদীর প্রাণপ্রকৃতির কথা চিন্তা করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাজনীতির হিসাব বাদ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন, পানি ও বায়ুদূষণ নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে।’
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক সঞ্চালকের বক্তব্যে বলেন, সমঝোতার প্রধান শর্ত হচ্ছে, আপনি কি সংঘাত, না সমঝোতা করবেন। তিস্তা নদী নিয়ে সমঝোতার বিকল্প নেই। ভারতের সঙ্গে যেকোনো সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে। রাষ্ট্র থেকে বিষয়গুলোকে জনগণের স্তরেও নামিয়ে আনতে হবে। যৌথ নদী কমিশন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড যে পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। এখনকার নতুন সমস্যার সমাধানের জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না। তাই আমাদের এ জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।’
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D