সিলেট ৯ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:১৬ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২৪, ২০২২
অনুপ কুমার খাস্তগীর | ঢাকা, ২৪ মার্চ ২০২২ : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ট্যাংক-কামান ও মেশিনগানসহ অত্যাধুনিক সব অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা। আক্রমণের শুরুতেই তারা বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডি ৩২ নং সড়কের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। সাড়ে নয় মাস পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন একাধিকবার।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পরের সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু বিদেশী সাংবাদিকদের এক সাক্ষাৎকার দেন। তাদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রখ্যাত সাংবাদিক সিডনি এইচ শ্যানবার্গ। বঙ্গবন্ধুর এই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তার একটি বিশেষ প্রতিবেদন ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়। এই সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু নিজেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা, স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া এবং পাকিস্তান কারাগার থেকে তাঁর মুক্তি লাভের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। শ্যানবার্গের তথ্যের ভিত্তিতে এই বিশেষ প্রতিবেদন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাত। চোখের জলে ভাসতে থাকা স্ত্রী ও সন্তানদের ললাটে একে একে চুম্বন করলেন তিনি। তারপর নিলেন বিদায়। ধরে নেয়া হয়েছিল এটাই তাঁর শেষ বিদায়। স্ত্রী, পুত্র-কন্যারাও আশা করেন নি তিনি তাদের মাঝে মাঝে আর কোন দিন ফিরে আসবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা বন্দুকের বাট দিয়ে পেছনে গুতোতে গুতোতে বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে জিপের আছে নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে উঠেন, তিনি তাঁর পাইপ এবং তামাক ফেলে এসেছেন। সেগুলো আনতে আবার উপরে যেতে হবে। সৈন্যরা চারিদিক ঘিরে পাহারা দিয়ে তাঁকে আবার উপরে নিয়ে যায়। বেগম মুজিব তাঁর হাতে পাইপ ও তামাকের পাউচটি তুলে দেন। বাঙালির স্বায়ত্বশাসন আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবকে নিক্ষেপ করে কারাগারে।
পাকিস্তানের কারাগারে সাড়ে নয় মাস বন্দী জীবন কাঠিয়ে ১৯৭২ সালে ১১ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর একদল বিদেশী সাংবাদিককে বঙ্গবন্ধু নিজেই ২৫ মার্চ কালো রাতে তাঁর গ্র্রেপ্তার, কারাজীবন এবং মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসার ঘটনাবলীর বর্ণনা দেন।
শ্যানবার্গের ভাষায়- ‘মুক্তি লাভের কারণে অনেকটা নিরুদ্বেগ দেখালেও অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার রেশ তখনো তাঁর মন থেকে কাটে নি। কিন্তু, ভাগ্যের সুপ্রসন্নতায় বিশ^ মানচিত্রে উদ্ভাবিত নতুন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে আটককারী ইয়াহিয়া খানের ইতোপূর্বে ছেড়ে যাওয়া ঢাকার সরকারি বাসভবনের পালঙ্কে হেলান দিয়ে কয়েকটি মার্কিন পত্রিকার সাংবাদিকের সামনে বঙ্গবন্ধু যখন অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলছিলেন ইয়াহিয়া তখন পশ্চিম পাকিস্তানে গৃহবন্দী।’
২৫ মার্চ কালরাতের ঘটনা দিয়েই বঙ্গবন্ধু শুরু করেন। সেই পাইপ এবং তামাকের পাউসটি ছিল তাঁর সামনে একটি কফি টেবিলের ওপরে। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, কেন সেদিন রাতে তিনি নিজের বাড়িতে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, তিনি জানতে পেরেছিলেন সেদিন ঘর থেকে বের হলে গাড়ীতে গ্রেনেড মেরে তাঁকে হত্যা করা হবে এবং সেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে এই হত্যার দায় উগ্রপন্থী বাঙালিদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হবে। এটি ছিল পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নীলনকশা। এই ঘটনাকে জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়ার অজুহাত হিসেবেও দাঁড় করানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। এই ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর বঙ্গবন্ধু নিজের বাড়িতে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন, যাতে পাকিস্তানীরা চাইলে তাঁকে নিজের বাড়িতেই খুন করে।
জনগণের আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পাকিস্তানী বাহিনীর হামলা অত্যাসন্ন-এই ধরণের খবর ২৫ মার্চ সর্বত্র চাউর হচ্ছিল। তাই, বঙ্গবন্ধু তাঁর বড় ছেলে কামাল এবং দুই মেয়েকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। তিনি স্ত্রী ও ছোট ছেলে রাসেলকে নিয়ে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ীতেই অবস্থান করছিলেন। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে একা রেখে অন্য কোথাও যেতে রাজি হননি বেগম মুজিব। মেজ ছেলে জামাল নিজের ঘরেই ঘুমিয়ে ছিল।
রাত ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধু খবর পান পাকিস্তানী বাহিনী সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে। কিছু সময় পরে পাকিস্তানী সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও করে এবং কাছেই একটি মর্টার শেল ফাটায়। এই আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু গোপনে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। রাত প্রায় ১০.৩০ মিনিটের দিকে তিনি চট্টগ্রামে এক গোপন স্থানে ফোন করে তাঁর সর্বশেষ বার্তাটি প্রেরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর এই বার্তাটি রেকর্ড করা হয় এবং পরে গোপন ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়।
এই বার্তায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেন, জনগণকে সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার ডাক দেন। পরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং আধাসামরিক বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান রাইফেলসের কাছেও বঙ্গবন্ধু এই বার্তা পাঠান।
রাত ১১টার দিকে সারা ঢাকা শহরে পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মির আক্রমণ শুরু হয় এবং তা দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্য রাতের দিকে সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ী লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্ত্রী এবং দুই সন্তান জামাল ও রাসেলকে ঠেলে ড্রেসিং রুমের সিঁড়িতে নিয়ে যান এবং গুলি থেকে রক্ষা পাবার জন্য মেঝেতে মাথা নিচু করে থাকেন।
পাকিস্তানী সৈন্যরা দ্রুত গেইট ভেঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে ঢুকে পড়ে এবং বাড়ীর একজন প্রহরীকে হত্যা করে। তারপর তাঁরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে। বঙ্গবন্ধু জানান, তিনি নিজেই সৈন্যদের দরজা খুলে দেন এবং সৈন্যদেরকে গুলি বন্ধ করতে বলেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা কেন গুলি করছো। যদি তোমরা গুলি করতে চাও, আমাকে করো। আমি তো এখানে আছি। তোমরা কেন আমার জনগণকে এবং শিশুদের ওপর গুলি করছো? একথা দু’বার বলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর চিৎকারের পর এক মেজর গুলি বর্ষণকারীকে থামিয়ে দেন। মেজর বঙ্গবন্ধুকে জানান, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রস্তুত হওয়ার জন্য তার কাছে কিছুক্ষণ সময় চান। তারপর সকলের কাছ থেকে বিদায় নেন।
‘বঙ্গবন্ধু একে একে সকলকে চুমু খান এবং বলেন, তারা আমাকে হত্যা করতে পারে। আর কোন দিন তোমাদের সাথে আমার দেখা নাও হতে পারে। কিন্তু আমার জনগণ একদিন স্বাধীন হবে। আমার আত্মা সেটি দেখবে এবং খুশি হবে।’
৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে জাতীয় সংসদ ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে একটি চেয়ারে বসতে দেয়া হয়। এরপর তাঁকে চা খেতে বলা হলে বঙ্গবন্ধুর মনে হয়েছে তার সাথে ঠাট্টা করা হচ্ছে। তার কণ্ঠ থেকে তামাশার সুরে বেরিয়ে আসে- ‘চমৎকার, আমার জীবনে চা খাওয়ার এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ সময়।’
একটু পরে বঙ্গবন্ধুকে একটি স্কুলের অন্ধকার ও নোংরা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। ছয় দিন তাঁকে এই কক্ষে রাখা হয়। তবে, মধ্য রাত থেকে ভোর ৬ টা পর্যন্ত তাঁকে চীফ মার্শাল ল এডমিনেস্ট্রেটর এবং ’৭১-এ বাঙালীদের ওপর পরিচালিত নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মূল হোতা লে. জে. টিক্কা খানের বাসভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখা হতো।
পয়লা এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে আকাশ পথে নেয়া হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। সেখানে নেয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে পাঠানো হয় মিয়ানওয়ালি কারাগারে এবং রাখা হয় ফাঁসির কয়েদীদের জন্য নির্ধারিত একটি কনডেম সেলে। পরবর্তী ৯ মাসে বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুকে মিয়ানওয়ালী জেল এবং পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় পাঞ্জাব প্রদেশের লয়ালপুর ও শাহিওয়াল জেলে রাখা হয়।
সামরিক সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করাসহ ১২টি অভিযোগে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিচার শুরু করে। এসব অভিযোগের ছয়টির শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আইনের ছাত্র বঙ্গবন্ধু জানতেন এসব মামলা থেকে খালাস পাবার কোন সম্ভাবনা নাই। তাই, তিনি যতদিন বিলম্ব করা যায় শুধু সেই চেষ্টাই করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়- ‘আমিও তাদের সাথে খেলতে শুরু করি। আমি আসলে সময়ক্ষেপণ করতে চেয়েছিলাম।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর পক্ষে পাকিস্তানের সবচেয়ে নামকরা আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে তাঁর আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার দাবি জানান। ব্রোহি’ শুধু একজন ভাল আইনজীবীই ছিলেন না, তিনি সকলের কাছে গ্রহনযোগ্যও ছিলেন। সরকার শেষ পর্যন্ত ব্রোহিকেই বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেয়।
নিয়োগ পাবার পর ব্রোহি কোর্টে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থকেন। কয়েকমাস পর লয়ালপুরে সামরিক আদালতে বিচার কাজ শুরু হয়। পরিস্থিতি বুঝে বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দেন তিনি তাঁর পক্ষে কোন আইনজীবী নিয়োগ দেবেন না। তাই, ব্রোহিকে বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান তখন এক মার্শল ল আইন জারি করেন এবং এই আইনে বলা হয়, শেখ মুজিব রাজি থাকুন বা নাই থাকুন তাঁর পক্ষে একজন আইনজীবী আদালতে থাকবে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার নামে পাকিস্তান সরকার মূলত: দেখাতে চেয়েছিল তারা আমার একতরফা বিচার করছে না। আমাকে ডিফেন্ড করার জন্য সকল সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এই বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাকিস্তানিরা মূলতঃ আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর একটি সার্টিফিকেট তৈরি করতে চেয়েছিল।’
ডিসেম্বরের ৪ তারিখ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বিচার কাজ শেষ হয়। দিনটি ছিল ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন। পূর্ব পাকিস্তান পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যূদয় এবং পাকিস্তানের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সমাপ্তি হয়।
বিচার কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইয়াহিয়া খান সামরিক আদালতের সকল সদস্যকে রাউয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠান এবং জরুরি ভিত্তিতে মামলার রায়ের খসড়া তৈরি করতে বলেন। কিন্তু, ইয়াহিয়া খান দেখলেন সামরিক কর্তকর্তারা রায় লিখবেন কখন, সবাই যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। যুদ্ধ সংঘাতের মাঝে ইয়াহিয়া এই হাস্যকর রায় আর ঘোষণা করতে পারে নি। ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুকে লয়ালপুর থেকে মিয়ানওয়ালী পাঠিয়ে দেয়া হয়।
মিয়ানওয়ালী হচ্ছে লে. জে. এএকে নিয়াজীর জন্মস্থান। পাকিস্তানের সামরিক সরকার যুদ্ধের মাঝখানে জেনারেল টিক্কা খানকে সরিয়ে নিয়াজীকে পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার হিসেবে পাঠিয়েছিল। ১৫ ডিসেম্বর মিয়ানওয়ালী কারাগারে পাকিস্তানী কয়েদীদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, বাঙালিরা নিয়াজীকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। তাই, পরদিন সকাল ৬ টায় সেলের দরজা খোলার সাথে সাথে তারাও শেখ মুজিবকেও জেলের ভেতর পিটিয়ে মেরে ফেলবে। এই প্রস্তাব কয়েদীরা খুবই উৎসাহের সাথে নিয়েছিল। এই ভয়ানক খবর জানতে পারেন জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট। তিনি ভোর ৪ টায় এসে সেলের দরজা খোলেন। তখন থেকে মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকা শেখ মুজিব এত ভোরে সুপারিনটেন্ডেন্টকে দেখে জানতে চাইলেন তাঁকে কি ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হবে? কারণ, কিছু দিন আগে বঙ্গবন্ধু দেখেছেন জেলের অভ্যন্তরে একটি কবর খোঁড়া হচ্ছে।
শেখ মুজিব জেল কর্মকর্তাকে বললেন, যদি তাঁকে ফাঁসি দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে যেন তাঁকে শেষ নামাজ পড়ার জন্য কয়েক মিনিট সময় দেয়া হয়। শেখ মুজিবের প্রতি বন্ধুবৎসল এই জেল কর্মকর্তা অভয় দিলেন। বললেন, তিনি তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যেতে এসেছেন। জেল কর্মকতা বললেন, ‘সময় নাই, এখনি আমার সাথে যেতে হবে।’
জেল থেকে বেরিয়ে যাবার সময় জেল কর্মকর্তা শেখ মুজিবকে চক্রান্তের কথা জানালেন। বললেন, তিনি মুজিবকে প্রায় এক মাইল দূরে তার নিজের বাড়িতে রেখে আসবেন-যাতে তার দেখা কেউ না পায়। সেখানে তিনি দু’দিন থাকবেন। কারণ, হিসেবে তিনি বললেন, যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। তাই, সামরিক কর্মকর্তারা তাদের করণীয় নিয়ে বিভ্রান্ত। যে কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাই, মুজিবকে বাঁচানোর জন্য এই ব্যবস্থা।
১৮ ডিসেম্বর জেল সুপার মুজিবকে জানালেন বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেছে। তাই, তাঁকে সরে যেতে হবে। জেল সুপার মুজিবকে নিয়ে চলে যান কয়েক মাইল দূরে আরেকটি খালি বাড়ীতে। সৈন্যরা জেল সুপারের কাছে মুজিবের হদিস জানতে না চাওয়া পর্যন্ত ৯ দিন মুজিব এই বাড়ীতে ছিলেন।
পাকিস্তান সেনা কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে জানতে চেয়েছিল মুজিবের অবস্থান সম্পর্কে। কিন্তু, জেল সুপার তাদের জানিয়েছিলেন মুজিব কোথায় আছেন তা তিনি জানেন না। এর মধ্যে ক্ষমতার মসনদে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধে হারার পর সামরিক শাসকদের সরিয়ে প্রেসিডেন্টের পদে আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো।
১৯ ডিসেম্বর থানার ওসি জেল সুপারকে বলেন, সামরিক বাহিনীর পতিত জেনারেলদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের নির্বাচিত জুলফিকার আলী ভুট্টো শাসনভার নেয়ার পর মুজিবকে আর লুকিয়ে রাখার বা ভিত হওয়ার কোন কারণ নাই। ওসি আরো জানান, ভুট্টো সাহেব মুজিবকে দেখতে চেয়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন।
এরপর বঙ্গবন্ধুকে মিয়ানওয়ালী থেকে রাউয়ালপিন্ডি আনা হয় এবং প্রেসিডেন্টের গেস্ট হাউসে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। কয়েকদিন পর ভুট্টো গৃহবন্দী শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে আসেন। এই ভুট্টোই পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সয়েমড় যোগসাজশ করে পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু জনগণের নেতা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের ওপর সীমাহীন বর্বরতা ও নিপীড়ন পথনকশা তৈরি করেন।
ভুট্টো মুজিবের সাথে দেখা করতে এলে মুজিব তাকে অভিনন্দন জানান এবং বলেন, তিনি শুনেছেন, ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। ভুট্টো এখন কি করছেন তাও মুজিব জানতে চান। ভুট্টোর জবাব ছিল- ‘আমি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। এ এক অপূর্ব সময়।’
তিনি মুজিবকে এটাও জানান, ইয়াহিয়া খান তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় বলেছেন, তার বিরাট দুঃখ তিনি শেখ মুজিবকে শেষ করে দিয়ে যেতে পারেন নি। যদি পারেন আমার এই ছোট কাজটি যেন আমি শেষ করি। ইয়াহিয়া খান কাগজপত্রে পেছনের তারিখ দিয়েও সই করতে চেয়েছিলেন, যাতে ভুট্টো বলতে পারেন মুজিবের ফাঁসি ইয়াহিয়াই দিয়ে গেছেন। কিন্তু ভুট্টো তা করতে অস্বীকার করেন বলে জানান মুজিবকে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ইয়াহিয়ার অনুরোধ ভুট্টো রক্ষা না করার কারণ প্রধানত: রাজনৈতিক। তার কারণ ভুট্টো ইয়াহিয়া খানকে বলেছেন। ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেন, যদি আমি শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিই, তাহলে বাঙালীরা বাংলাদেশে আত্মসমর্পণকারি ১ লাখ পাকিস্তানী সৈন্যের গলা কাটবে। এই সৈন্যদের অধিকাংশই পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বাসিন্দা। তারা এজন্য ভুট্টোকে দায়ী করবে এবং ভুট্টোর নতুন সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে।
কথার মধ্যেই ভুট্টো বারবার মুিজবকে দুই পাকিস্তানী অঞ্চলের মধ্যে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে আলোচনা শুরু করার জন্য বলেন। এর উত্তরে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেছিলেন, ‘আমি প্রথমেই একটি বিষয় জানতে চাই। তা হচ্ছে আমি কি মুক্ত, নাকি বন্দী। যদি আমি মুক্ত হই, আমাকে যেতে দিন। যদি আমি মুক্ত না হই, তাহলে তো আমি কথা বলতে পারি না।’
তখন ভুট্টো বলেন, আপনি মুক্ত। কিন্তু, আপনাকে যেতে দেয়ার আগে আমার কয়েকদিন সময় প্রয়োজন। মুক্তির প্রতিশ্রুতি শোনার পরও বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর সাথে কোন বিষয়েই বিশেষ আলোচনা করেন নি। ভুট্টো আরেকটি কথা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন। তা হলো-পাকিস্তানের দু’টি অংশ অভিন্ন আইন, ঐতিহ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে এখনো অভিন্ন। তখন বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বিগত সাধারণ নির্বাচনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে জাতীয়ভাবে সংখ্যাগরিষ্টতা পেলেও তাকে সম্মান দেখানো হয়নি। আপনি যদি এখনো পাকিস্তানকে এক রাষ্ট্র মনে করেন তা হলে তো আপনি প্রেসিডেন্ট এবং চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর হতে পারেন না। আমি হতে পারি।’
জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ প্রেসিডেন্ট ভুট্টো তৃতীয় এবং শেষ বারের মত শেখ মুজিরের সঙ্গে দেখা করেন।। তখন মুজিব তাঁকে বলেন, আপনার উচিত আমাকে আজ রাতেই মুক্ত করে দেয়া। এছাড়া, আর কোন পথ খোলা নাই। হয় আমাকে মুক্তি দিন, না হয় মেরে ফেলুন।
ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেন, এত সংক্ষিপ্ত সময়ের নোটিশে মুক্তির আয়োজন করা কঠিন। তবে, তিনি শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে লন্ডন পাঠাতে রাজি হন। পরের দিন বিদায় জানানোর সময়ও ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখার অনুরোধ জানান।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D