১৯৭২ সালের দালাল আইন

প্রকাশিত: ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৩০, ২০২২

১৯৭২ সালের দালাল আইন

অাইন বিষয়ক | ঢাকা, ৩০ এপ্রিল ২০২২ : দালাল আইন, ১৯৭২ (কোলাবোরেটর্স ট্রাইব্যুনাল অর্ডার ১৯৭২) রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এবং শান্তি কমিটির সদস্যসহ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ও পাকিস্তান ভাবাপন্ন পূর্ব পাকিস্তানিদের ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি জারিকৃত বাংলাদেশ কোলাবোরেটর্স ট্রাইব্যুনাল অর্ডার ১৯৭২-এর মাধ্যমে দালাল বা কোলাবোরেটর ঘোষণা করা হয়।
এ অধ্যাদেশে বিবৃত সংজ্ঞানুসারে কোলাবোরেটর অর্থ সেইসব ব্যক্তি যারা
(১) পাকিস্তানি বাহিনীকে বাংলাদেশে বেআইনি দখল টিকিয়ে রাখার কাজে সাহায্য, সহযোগিতা বা সমর্থন দান করেন;
(২) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকবাহিনীকে বস্তুগত সহযোগিতা প্রদান বা কোনো বক্তব্য চুক্তি ও কার্যাবলীর মাধ্যমে তাদের সাহায্য করেন;
(৩) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন বা যুদ্ধের প্রয়াস চালান;
(৪) পাকবাহিনীর অনুকূলে কোনো বিবৃতি প্রদান বা প্রচারণায় অংশ নেন, পাকবাহিনীর কোনো প্রতিনিধিদল বা কমিটির সদস্য হন এবং ১৯৭১ সালে আয়োজিত উপনির্বাচনে অংশ নেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব রাজাকার, আলবদর, আলশামস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করেছে তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি এই আইনটি প্রণয়ন করা হয় এবং ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই আইনের আওতায় ২,৮৮৪টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় সাজা দেওয়া হয় ৭৫২ জনকে। এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী ছিল।

পরবর্তীতে দালাল আইনের অধীনে ৩৭ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিভিন্ন আদালতে তাদের বিচার আরম্ভ হয়। এর পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে কর্মরতদের কেউ দালালি এবং যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না তা যাচাই করার জন্য ১৯৭২ সালের ১৩ জুন একটি আদেশ জারি করে, যা তখন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

♦ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা :
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক ৩৭ হাজারের অধিক ব্যক্তির ভেতর থেকে প্রায় ২৬ হাজার ছাড়া পায়।
♦ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ৫ নং ধারায় বলা হয়, ‘যারা বর্ণিত আদেশের নিচের বর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব ক’টি অভিযোগ থাকবে –
♦ ধারাগুলো হলো: ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো অথবা চালানোর চেষ্টা), ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র), ১২৮ ক (রাষ্ট্রদ্রোহিতা), ৩০২ (হত্যা), ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা), ৩৬৩ (অপহরণ),৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ) ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ),৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা), ৩৭৬ (ধর্ষণ), ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি), ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তি-কালে আঘাত), ৩৯৫ (ডাকাতি), ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি),৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি), ৪৩৫ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন), ৪৩৬ (বাড়িঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার), ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে কোন জলযানের ক্ষতিসাধন) অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান।
♦এসব অপরাধী কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নন।’
*******************************
🌑 দালাল আইন বাতিল :
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি এ সকল অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম চলতে ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৭৫ এর ৩১ ডিসেম্বর জেনারেল জিয়া সামরিক অধ্যাদেশ জারী করে দালাল আইন বাতিল করেন। থেমে যায় যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম।
শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের জারী করা আইনগুলো একের পর এক অধ্যাদেশ জারী মধ্য দিয়ে রহিত করা হয়। ১৯৭৬ সালে ‘Second proclamation order no. 2 of 1976’ জারী করে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি তুলে দেয়া হয়। ১৯৭৬ এর ১৮ জানুয়ারি নাগরিকত্ব ফিরে পাবার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আবেদন করতে বলা হয় সবচেয়ে আলোচিত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে। এছাড়াও ‘proclamation order no. 1 of 1977’ দ্বারা সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ তুলে দেয়া হয়। মার্শাল ল’র আওতায় এসব অধ্যাদেশ জারী করে জেনারেল জিয়ার সরকার। এসব অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ