১৫ই আগস্ট ও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ৩:৪৩ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৫, ২০২২

১৫ই আগস্ট ও বাংলাদেশ

লিপিকা ঘোষ |

প্রতি বছর ১৫ই আগস্ট ভারতে এই দিনটি আবেগের সঙ্গে পালিত হয়। জাতীয় পতাকার তিন রঙের সঙ্গে আরো যত রঙই যোগ দিক না কেন এবার স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হওয়ার মুহূর্তে সে আবেগ যে পঁচাত্তর গুণ বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই ।
১৯৪৭ সালে যখন এই দিনটি এসেছিল তখন কেউ স্বাধীন হবার আনন্দে হেসেছিল, কেউ ভিটে হারানোর দুঃখে কেঁদেছে।
আর রাজনীতির চক্রান্তে ধর্মের কাটারিতে এক ভারতকে তিন টুকরো করে দুটি রাষ্ট্রের এক সঙ্গে জন্ম হয়েছিল। তারও চব্বিশ বছরের লড়াইয়ের পর ১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ হয়েছিল। পাশে পেয়েছিল ভারতকে। তবু তাদের সঙ্গে ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতার আনন্দ ভাগ করে নেবার অবকাশ আর নেই। গত সাতচল্লিশ বছর ধরে ১৫ই আগস্ট আমাদের প্রতিবেশী দেশ হৃদয়ের বাতি নিভিয়ে জাতীয় শোক পালন করে চলেছে, চলবে আগামীতেও। এর উত্তর খুঁজতে উল্টে দেখতে হবে সময়ের পাতা…..
পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন ছিল মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার চেয়ে আন্দোলন। বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী সেই আন্দোলন ছিল বাঙ্গালির সাহসের, ঐকবদ্ধতার, ত্যাগের আর গর্বের আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র থাকা অবস্থায় জড়িয়ে ছিলেন সেই আন্দোলনে। শুধু জড়িয়ে পড়েননি, সেই আন্দোলনকে, বাঙ্গালির একতাকে, ত্যাগের সাহসকে, লড়াইয়ের শক্তিকে দীর্ঘায়িত করে মুক্তি আন্দোলনে পরিণত করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ব পাকিস্তানের অভিশপ্ত নাম ঘুচিয়ে বাঙ্গালির বাসস্থানকে বাংলাদেশ নামকরণ করেছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন নতুন প্রাণশক্তিতে উজ্জ্বীবিত এক নতুন জাতির। স্তম্ভিত বিশ্ব বিষ্ময়ে দেখেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বজ্রমুষ্ঠী থেকে বার করে আনা মুজিবুর রহমানের সেই রক্তাক্ত, বিধ্বস্ত অথচ অপ্রতিহত বাংলাকে।
শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ শাসনকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলেন, মুসলিম লিগের সদস্য থাকা কালীন বাগ-বিতণ্ডায় জড়িয়ে ব্রিটিশের কারাগারে বাস করেছিলেন সাতদিন। ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার পর দেশ ভাগ হলে কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। পূর্ব পাকিস্তানে এসে কিছুদিনের মধ্যেই মুসলিম লিগ ছেড়ে আওয়ামি লিগ প্রতিষ্ঠা করেন। দুই দশক ধরে লাগাতার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃ্ত্ব দিতে গিয়ে পঞ্চান্ন বছরের জীবনে প্রায় তেরো বছর জেলেই কাটয়েছেন। ১৯৭১ সালের মার্চে পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক আইন জারি করে, আওয়ামি লিগকে অবৈধ ঘোষণা করে, আওয়ামি লিগের সদস্য সহ মুজিবুরকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে পূর্বপাকিস্তানের বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে গণহত্যা চালাতে থাকে। ২৬শে মার্চ ওয়ারলেসের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তিনি ছিলেন সেই স্বঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি, তিনি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করার জন্য। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিল অসংখ্য সাধারণ নারী ও পুরুষ। তিনি গ্রেফতার হলেও তাঁর নির্দেশ পালন করে পূর্ববঙ্গের বাঙালি। ন’ মাস ধরে অনবরত পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনির তাণ্ডব চলে, চলে হত্যালীলা, চলে নারী ধর্ষণ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় শেষ পর্যন্ত ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতার যুদ্ধে জয়লাভ করে সংগ্রামী বাঙালি। বন্দি শেখ মুজিবুর পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। মুজিবুর রহমানের ভাষায় ‘মানব ইতিহাসের জঘন্যতম ধ্বংসযজ্ঞ’ থেকে উঠে আসা এই রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের কাজে তিনি মনোনিবেশ করেন। সে ছিল আর এক সংগ্রাম। ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ আর দু’ লক্ষ নারীর ইজ্জতের মুল্যে পাওয়া (হয়ত বা তারও বেশি) জয়ের মালায় ছিল কোটি কোটি মানুষের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, বাসস্থান জোগানের দায়ভার। একে একে দুর্ভিক্ষ, কৃষি, শিল্প, পররাষ্ট্রকে সামলে ১৯৭৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য পদ লাভ করেন। চার বছরের কম সময়ে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী সহ শক্ত সেনাবাহিনী। সারাজীবন ব্যাপী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, দেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগনের কাছে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘জাতির জনক’ আখ্যা পেয়েছিলেন। এতদসত্বেও ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট সপরিবার হত্যালীলার শিকার হলেন, নেমে এলো জাতীয় শোক দিবস।
তাঁর সংগ্রামী জীবন ও রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক কাহিনিচিত্র ও তথ্যচিত্র। সম্প্রতি পরিচালক গৌতম ঘোষও তাঁকে নিয়ে ‘কলকাতায় বঙ্গবন্ধু’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরির কাজ শুরু করেছেন। বাংলাদেশের নায়লা পরভিন পিয়ার প্রযোজনায় ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ নামে যে তথ্যচিত্রটি তৈরি হয়েছে সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম থেকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান হওয়া পর্যন্ত দেখান হয়। ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমায় (বর্তমান জেলা) পাটগাদি ইউনিয়নের মধুমতী নদীর কাছে টুঙ্গিপাড়ার জন্মস্থান, জানা যায় শেখ বংশের ইতিহাস, বাবা শেখ লুতফুর রহমান ও সায়েরা খাতুনের কথা, জানা যায় ছোটবেলায় বেরিবেরি, গ্লুকোমা ধরা পড়ার কথা। ফুটবল প্রতিযোগিয়ায় জিতে ট্রফি হাতে ফেরা শেখ মুজিবুরও চোখ অপারেশনের ভয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যেতে গিয়ে কেমন করে ধরা পরে চোখ অপারেশন করতে বাধ্য হন সেকথাও। তাঁর সমসাময়িক ছাত্রনেতা নিহার রঞ্জন চক্রবর্তী, ডাকসুর প্রথম মহিলা ডি পি মহাফুজা খানম, বাংলাদেশের প্রথমপরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরেহেমান সোবাহান এবং ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের সাক্ষাতকার দেখান হয়। জানা যায় তার জন্মদিনকে (১৭ই মার্চ, ১৯২০) কেন শিশুদিবস বলা হয়। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের এই ছবিটিতে ঐতিহাসিক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এর বিশ্লেষণে উঠে আসে তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও বাংলাদেশের ততকালীন পরিস্থিতি, যাকে প্রাণবন্ত করে তোলে শেখ মুজিবুরের কন্ঠস্বর, জাতির উদ্দেশ্যে জ্বালামুখী ভাষণ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ