সিলেট ২২শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৩
সাহিত্য বিষয়ক প্রতিনিধি | ঢাকা, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : রসায়নবিদ, রসসাহিত্যিক, রাজশেখর বসুর দাদা শশিশেখর, দাঁত না থাকলেও প্রতিদিন সেদ্ধ মাংস খেতেন, মৃত্যুর পূর্বদিনেও কোনও ব্যতিক্রম হয় নি৷ দিনে অনেক কাপ চা খেতেন। আর রাতে বার চারেক উঠে স্টোভ জ্বালিয়ে নিজের চা নিজে তৈরি করে নিতেন৷ তাঁর পরের ভাই রাজশেখর যখন দ্বারভাঙায় এলেন ছ’বছরের বড় শশিশেখর তখন বাবার বাক্স থেকে “বেগাম” সিগারেট চুরি করে খায়। ভাই একটু বড় হতেই সে বলে, “ওরে ফটিক, একটা সিগারেট টান দিকি, এতে ভারি মজা!” রাজশেখরের অবশ্য বিশ্রী লেগেছিল একটু টেনেই সে ফেলে দেয়।
শশিশেখর, রাজশেখর, কৃষ্ণশেখর, গিরীন্দ্রশেখর। চার ভাইয়ের বাবা চন্দ্রশেখর যশোহর জেলার ডাক বিভাগের কর্মচারী ছিলেন। তিনি নিজে সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্রের বিশেষ অনুরাগী, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের “তত্ত্ববোধিনী সভার” সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।
রাজশেখর প্রকৃতিগতভাবে সৎ ও ভদ্র মানুষ একথা বললে কম বলা হয়। অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষের নেতৃত্বে মানিকতলা বোমা মামলার ঘটনায় বোমার ফর্মুলা এবং যাবতীয় মালমশলা সরবরাহ করতেন রাজশেখর! ধরা পড়লে সোজা সেলুলার জেল, তবু নির্ভয় কাজ করে গিয়েছেন। এবং নীরবে। ১৮৯৭ সালে কলকাতায় পড়তে এলেন, ভর্তি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞান শাখায়। ওই বছরই তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর সহধর্মিণী মৃণালিনী ছিলেন শ্যামাচরণ দে’র পৌত্রী।
বিজ্ঞানে এম.এ.পাশ করে দুই বছর পরে আইন অধ্যয়ন শেষ করে বি.এল.পরীক্ষা পাশ করে নিলেন। অন্য কেউ হলে আইনজীবী হয়ে পসার জমানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু রাজশেখর তিনদিনের মধ্যে আদালতে পসার জমানোর উদ্যম জলাঞ্জলি দিয়ে বসলেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসে রাসায়নিক পদে বহাল হলেন।
তারপর থেকে সুদীর্ঘ সময় স্বদেশী প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে কাজ করছেন। সাহিত্য চর্চা করেছেন। ৪২ বছর বয়সে প্রথম লেখা ছাপছেন, আর তাতেই হইহই ফেলে দিচ্ছেন বাঙালি পাঠকসমাজে,পরশুরাম ছদ্মনামে লিখে পাঠকের সাহিত্য রস তৃপ্তি করেছেন। সব মিলিয়ে বলা যায় বসু ভাইদের মা মৃনালিণী সত্যি রত্নগর্ভা।
রবীন্দ্রনাথের “বিচিত্রা” সুকুমার রায়ের “মানডে ক্লাব”এর মত রাজশেখর বসুর “উৎকেন্দ্র সমিতি”। রাজশেখর এখানে প্রাণ খুলে কথা বলার সুযোগ পেতেন, আবার লেখার প্রচুর রসদ সংগ্রহ করতেন।পরশুরামের গল্পেও এর উল্লেখ পাওয়া যায় “বিরিঞ্চিবাবা”গল্পের চৌদ্দ নম্বর হাবশীবাগান লেনের আড্ডা। পার্শীবাগানে বিরাট আড্ডা চলত সব রকমের মানুষ সেখানে আড্ডা দিতে আসতেন। প্রতিদিন সেখানে মজলিস বসত, রবিবার দিনটা খুব জমজমাট।বসু ভাইদের বৈঠকখানা গমগম করত। সেই আড্ডার নামকরণ হয়েছিল “উপকেন্দ্র সমিতি”। প্রথমে অবশ্য একটা ইংরেজি নাম ছিল পরে বাংলা নাম দিয়েছিলেন রাজশেখর। পার্শীবাগানের আড্ডার মধ্যমণি হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সবথেকে বাক-সংযত মাঝে মাঝে হাসির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আবার নিস্তব্ধ হয়ে যেতেন। তিনি হাসাতেন তবে হাসতেন কদাচিৎ।
সৈয়দ মুজতবা আলী রাজশেখরকে লেখা এক চিঠিতে মন্তব্য করেছিলেন— “আপনার সমস্ত পাণ্ডুলিপি যদি হারিয়ে যায় আমাকে বলবেন, আমি স্মৃতি থেকে সমস্ত লিখে দোব।” তাঁর গল্পের কেমন আকর্ষণ, এ থেকেই স্পষ্ট। পরশুরামের হাসির গল্পে সামাজিক মন থেকে ব্যক্তিমন সবই ধরা পড়ত ভাষার জাদুতে।
বড়দা শশিশেখর বড় মজার সব গল্প করতে পারতেন। কার্যত বৃদ্ধ বয়সে তিনি বাংলা লেখা শুরু করেন। আর এক ভাই কৃষ্ণশেখর পল্লী উন্নয়নের কথা হলে মশগুল হয়ে পড়তেন। গিরীন্দ্রশেখর ভাইদের মধ্যে ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। শশিশেখর বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেছিলেন ৭৮ বছর বয়সে সেই লেখার স্টাইল চিত্তাকর্ষক, সহজ সরল অনাড়ম্বর৷ ৮১ বছরের জীবনে দীর্ঘ ৬৫বছর লিখেছেন প্রধানত ইংরেজি ভাষায়৷ অসাধারণ স্মৃতিশক্তির গুণী মানুষটা জয়দেব, চণ্ডীদাস, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, বায়রন, শেক্সপিয়র অনর্গল আউড়ে যেতে পারতেন।
জীবনে অনেক শোক, তাপ দুঃখ পেলেও ভেঙে পড়েন নি, হা হুতাশ করেন নি৷ নিজে কানে কম শুনতেন, তবু নিজে কালাদের নিয়ে রসিকতা করেছেন৷ এক কালা গ্রামে বেগুন খেত পাহারা দিত৷ আর এক ভদ্রলোক গ্রামে অনেকদিন পরে ফিরে কালাকে দেখে বেশ জোরে জোরে সবার কথা জিজ্ঞেস করে শেষে বললেন ‘তোমার ছেলেপুলে কটি’? কালা উত্তর দিল ‘কি আর বলব দাদা, এই মাঝেমাঝে ২/১টি হয়, আগুনে পুড়িয়ে খাই’৷ শশিশেখরের মৃত্যুর পরে সরস কাহিনীর সংকলনগ্রন্থ ‘যা দেখেছি যা শুনেছি’ পাঠকের কাছে যতেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল৷
গ্রন্থঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার,সাতপুরুষের রম্যজগৎ,শতদল গোস্বামী,বাংলার মনীষা (প্রথম খণ্ড) সম্পাদনা সুধীরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়,মানিক মুখোপাধ্যায়,জীবিতেশ চক্রবর্তী, নিবন্ধ রাজশেখর বসু, প্রমথনাথ বিশী, আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন, আবাহন দত্ত
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D