সমাজের নতুন প্রবণতা ঢাবিয়ান, বুয়েটিয়ান, ৮০ আন, ৮৫আন প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন, কিছু কথা

প্রকাশিত: ১:৪৯ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৫, ২০২৩

সমাজের নতুন প্রবণতা ঢাবিয়ান, বুয়েটিয়ান, ৮০ আন, ৮৫আন প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন, কিছু কথা

ডঃ মঞ্জুরে খোদা টরিক |

ইদানিং একটা বিষয় লক্ষ্য করছি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা নিজেদের ঢাবিয়ান, বুয়েটিয়ান, রাবিয়ান ইত্যাদি নামে/ভাবে পরিচয় দিচ্ছেন, উৎসব-অনুষ্ঠান করছেন। তারমধ্যে বুয়েটিয়ান শব্দটা ঠিক হলেও অন্যগুলো ঠিক নয়, শ্রুতিমধুরও নয়। ভাষা তাত্ত্বিক মাসুদ রানা’র মতে ঢাবিয়ান, রাবিয়ান না হয়ে সেটা হতে পারে ঢাবীয় বা ঢাবিক, রাবীয় বা রাবিক। যেমন বঙ্গীয়, রংপুরী, ঢাকাই ইত্যাদি।

আরেকটি নতুন প্রবণতা লক্ষ্য করছি, এসএসসি পাশের বছরকে ঘিরে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা নিজেদের আমরা ৮০ আন, আমরা ৮৫ আন, আমরা ৯০ আন, ইত্যাদি ভাবে পরিচয় দিচ্ছেন। বাংলা সংখ্যার সাথে ’আন’ যুক্ত করে, (এশিয়ান, আমেরিকান) যে বা যারা যে বছরে এসএসসি পাশ করেছেন তারা নিজেদের ব্যাচের পরিচয়কে সেভাবে তুলে ধরছেন। শুধু তাই নয়, উল্লেখিত শিরোনাম ব্যবহার করে তারা জেলা, বিভাগ, জাতীয় পর্যায়ে নানা অনুষ্ঠান-উৎসব করছেন।

যারা এভাবে নিজেদের পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন সেটা করতেই পারেন। সেটা তাদের স্বাধীনতা ও নিজেস্ব ব্যাপার। কিন্তু বাংলার সাথে এভাবে ইংরেজি মিশিয়ে এই বিশেষ শব্দ তৈরী করা কতটা শোভন বলতে পারেন? এটা কি বাংলা ভাষার সংকট ও সীমাবদ্ধতা না আমাদের সংস্কৃতির সংকট ও চিন্তার দৈনতা?

সভ্য সমাজে শিক্ষা একটি অনিবার্য বিষয়। অনেকটা জন্ম-মৃত্যুর মতই। সুতরাং স্কুল-কলেজ যতদিন আছে শিক্ষার্থীরা পাশ করবে, ডিগ্রী অর্জন করবে। এটা একটা ধারাবাহিকতা। কে কোন সালে পাশ করেছে তা গুরুত্বপূর্ণ হলেও ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সে-তারা সমাজে কি ভূমিকা রাখছে সেটা। পাশের বছরকে এভাবে মহিমানিত্বত করার কিছু নেই।

সেই পাশের বছরকে ঘিরে জেলা, বিভাগ, জাতীয় পর্যায়ে সংগঠন তৈরী করা কতটা যৌক্তিক? তাতে কিছু আবেগ ছাড়া অন্য কিছু দেখি না। দেশে বছর ভিত্তিক এমন সংগঠন হতে থাকলে কত হাজার-লাখ সংগঠন হবে ভাবতে পারেন? দেশে হাইস্কুলের সংখ্যা ২০ হাজারের উপরে। এবং প্রতিবছর শিক্ষার্থীরা এখান থেকে এসএসসি পাশ করছে।

ব্যাচ ভিত্তিক সংগঠনগুলোর মধ্যে এক ধরণের প্রতিযোগিতা তৈরী করছে। কারা কাদের চেয়ে শ্রেষ্ট ও বিশেষ কিছু, এই প্রবণতা কোন সুস্থতার লক্ষন নয়। এভাবে সংগঠন বাড়তে থাকলে সরকার হয়তো কোন এক সময় এখান থেকে আয়-ইনকামের চিন্তা করবে। যত আয়োজন-অনুষ্ঠান ততো কর-ভ্যাট!

ছাত্রজীবনে একটা স্লোগান দিয়েছি, ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি। সকল সংগঠনের মূলনীতিতে এই ঐক্য কথাটা বিদ্যমান। এই ঐক্যের মানে কি? তার চর্চা কিভাবে হয়? এর মাধ্যমে আমরা কি সেই কাজটা করছি?

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক ’অ্যালামনাই’ নামের একটা স্বীকৃত ধারণা সারা বিশ্বে চালু আছে। সেখানে সকল শিক্ষার্থী যুক্ত হতে পারে। সেটা থাকলে-হলে বছর ভিত্তিক এমন সংগঠনের দরকার হয় না।

আমরা যে সময় এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি তখন পাশের হার ছিল সীমিত এখনকার মত প্রায় শতভাগ পাশের হার ছিল না। রেফার্ড-ডেফার্ডও ছিল না। প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী সেখানেই ঝড়ে যেতো। আর প্রথমশ্রেণী থেকে এসএসসি অবধি আসতে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে যেতো। তারমানে মাত্র ১০ ভাগ শিক্ষার্থীকে আমরা সহপাঠি হিসেবে পেতাম।

অর্থাৎ আমরা যারা এক সাথে লেখাপড়া শুরু করেছিলাম তারা সবাই এসএসসি পর্যন্ত আসতে পারেনি। আজ আমরা যে কোন ভাবে সমাজের একটা জায়গায় পৌছে গিয়েছি, সে জন্য গর্ব করতে পারি কিন্তু সেই ঝরে পড়া সহপাঠিদের জন্য কি নিজেদের এতটুকু অস্বস্তি, খারাপলাগা কাজ করে?

কি অপরাধে তারা এখানে আসতে পারলো না? তারা গরীব বলে? টাকা নেই বলে? সেটা কি তাদের অপরাধ? সে দায় তো এ সমাজের, এ ব্যবস্থার। সেই ঝরেপরা সহপাঠিদের মধ্যেও অনেকের প্রতিভা ও মেধা ছিল। ওরা হারিয়ে যেয়ে আমাদের প্রতিযোগীতাকে সহজ করে দিয়েছে। না হলে কে জানে আমরা কে কোথায় থাকতাম?

মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের সাথে যারা ৪/৬/৮ ক্লাস পড়েছে তাদের জন্য কি এ সব অনুষ্ঠান বেদনার বা মন খারাপের কারণ হয়? নিষ্ঠুর সামাজিক বৈষম্যের স্বীকার হওয়া, ভুলে যাওয়া ক্ষতকে জাগিয়ে তোলে? তাদের কেউ হয়তো আজ কোন দোকানের কর্মচারী, রিক্সা চালক, কৃষিশ্রমিক, হকার, দিনমজুর, ক্ষুদে ব্যবসায়ী ইত্যাদি। কোন কাজই ছোট-অবজ্ঞার নয়। কিন্তু আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সে অবস্থা তৈরী হয়নি। আমরা তাদের কিছু সাহায্য করতে পারি কিন্তু তা কি তাঁদের জন্য মর্যাদার-সম্মানের?

তারপর টানা ১০ বছর কোন শিক্ষার্থী একসাথে এক স্কুলে পড়ার পর এসএসসিতে অকৃতকার্য হয়ে আর শিক্ষায় ফিরে না এলে তারজন্য কি বিষয়টি আরো মন খারাপের নয়? আর আমার মত যারা ফেল করে পরের বছর পাশ করেছিল তারা কোন গ্রুপে যাবে? আমার ব্যাচ কোনটি?

আজকাল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউটের উদ্যোগেই দশক/যুগ, রজত, সূবর্ণ জয়ন্তির অনুষ্ঠান করা হয়। সেটা কি আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়? কেন সারা বছর বা ঈদ-পুজা-পার্বনে তা করতে হবে? এবং কোন এক ব্যাচ সেটা করলে অন্যরাও সেটা করে। বিষয়টা সংক্রামক পর্যায়ে চলে গেছে। এ জন্য পোস্টার, ব্যানার, দামী খাবার, পোষাক, কনসার্ট, হাতি-ঘোড়া-পালকি প্রদর্শণ আমার কাছে অপচয় ছাড়া কিছু নয়।

তারপরো প্রাথমিক পর্যায়ে সংগঠনের রূপটা নিরীহ হলেও পরবর্তিতে যে দলাদলি হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। আমরা জানি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যালামনাইদের একাধিক সংগঠন আছে। সেগুলো নিয়ে অনেক বেদনাদায়ক ঘটনাও আছে তা মোটেই নতুন কিছু নয়।

আমাদের কাজ-বিনোদনের কি এতই অভাব যে, পাশের বছরকে ঘিরেই আমাদের আনন্দ-উৎসব করতে হবে? আমরা এর মাধ্যমে কি বার্তা দিতে চাই, কি বলতে চাই? ব্যতিক্রম বাদে বড় বড় পাশওয়ালারাই আজ সমাজ ও রাষ্ট্রের হর্তাকর্তা তাতে দেশের কি উপকার হচ্ছে? তাদের বিরুদ্ধেই আজ সাধারণ মানুষের দুর্নীতি-লুটপাট-অর্থপাচারসহ দেশবিরোধী শত কাজের অভিযোগ। আপনার যে সহপাঠির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, পারবেন তার দিকে তর্জনী তাক করতে? পারবেন ঘোষণা দিতে আপনাদের ব্যাচ তার/তাদের জন্য লজ্জিত, কলঙ্কিত!

জানি বলবেন, এর সাথে আমাদের সম্পর্ক কি? সংকট এখানেই? তেমনি ’পিতা দিবস’ এলেই সবার ছেলে-মেয়েই বলেন, আমার বাবা শ্রেষ্ট, আমার বাবা সবার সেরা, সৎ-মানবিক, সুন্দর। সেটাই যদি হয় তাহলে দেশে যারা ঘুষ খায়, দুর্নীতি করে, তারা তাহলে কাদের বাবা? বলতে পারেন?

আমি যে বছর পাশ করেছি সেক্ষেত্রে আমার সাথে যারা ৫-১০ বছর পড়েছে তাদের সাথে না হয় আমার অনেক স্মৃতি ও ভাললাগা আছে। কিন্তু যে অন্য স্কুলের, অন্য শহর, থানা-জেলা-বিভাগের কি সম্পর্ক, কি স্মৃতি বলতে পারেন? সে রকম কোন অনুষ্ঠানে অনেক মানুষের ভির ছাড়া আর কি? তারচেয়ে বরং একই স্কুলের আগে-পরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক সাথে কিছু করা অনেক আবেদনের, ভাললাগার নয় কি?

যে ভিখারুন্নেসা, আইডিয়াল, হলিক্রস থেকে পাশ করেছে আর যে ভূঁয়াপুর, টেংলাহাটা থেকে পাশ করেছে তাদের সমাজ-সংস্কৃতি কি এক? একজন হটডগ-বার্গার খেয়ে-নিয়ে স্কুলে গেছে অন্যজন পান্তা-কাঠাল খেয়ে স্কুলে গেছে। কারো স্মৃতি ডাংগুলি খেলা আরেকজনে ব্রিলিয়াড। কিভাবে মিলবে উভয়ের স্মৃতি-অতীত?

আমি বন্ধু-সহপাঠিদের স্মৃতিচারণমুলক মিলন অনুষ্ঠানের বিপক্ষে নই। তবে সেটা হতে পারে শোভন ভাবে শুধু তার স্কুলের সহপাঠিদের সাথেই। যেখানে কোন প্রদর্শণ, প্রতিযোগীতা ও আতিশার্য থাকবে না। থাকবে নির্মল, নিখাদ আনন্দ অন্য কিছু নয়।

পরিশেষ বলতে চাই, ’বছর ও সংখ্যার ভিত্তিতে’ নিজেদের বিভক্ত না করে সমাজের আকাঙ্খা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে স্কুল-কলেজগুলোতে অ্যালামনাই সংগঠিত করা হবে কল্যানকর ও উত্তম। অ্যালামনাই বিশ্বের সর্বত্রই একটি স্বীকৃত বিষয়। তার মাধ্যমেই বিভিন্ন উপলক্ষে সামাজিক উদ্যোগ-আয়োজন করা গেলে তা হবে অধিক গ্রহনযোগ্য, আনন্দময় ও উৎসবমুখর।
————————————————————————-
ডঃ মঞ্জুরে খোদা (টরিক), লেখক, শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ