সিলেট ১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৩০ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৪, ২০২৩
তার বাণীগুলো তখনো নতুন ছিল, এখনো চিরনতুন-এবং অদ্ভুত। সমসাময়িককালে দেখেছেন দুর্বল, মেরুদন্ডহীন ও ক্ষমতাহীন শাসকদের কবলে পড়ে খন্ড-বিখন্ড ইতালি, বিদেশী শক্তির হাতে পর্যদুস্ত। চার্চ ও পোপদের দৌরাত্ব্য। তাদের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপের কবলে সার্ভভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছিল না সামন্ত রাজ্যগুলো। অন্যদিকে, তারাও পারছিল না ইতালিকে এক করে জনগণকে নিরাপত্তা ও উন্নততর জীবনের সুযোগ করে দিতে। এসব দেখেশুনে, প্রচলিত ধর্মীয় ভালোমন্দ, সমাজ, নীতিনৈতিকতার বাইরে গিয়ে অভিজ্ঞ রাজকর্মচারী ও কূটনীতিবিদ ম্যাকিয়াভেলি তৈরি করার চেষ্টা করলেন একজন শক্তিশালী শাসকের মডেল। ইতিহাস ও সমসাময়িককালের সফল ও ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়কদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে তৈরিকৃত শাসকের এ চরিত্র ধর্ম, সমাজ, নীতিশাস্ত্র অনুমোদন না দিলেও একটি রাষ্ট্র শক্তহাতে পরিচালনার জন্য তৎকালীন সময়ের জন্য মহামন্ত্র, বর্তমানের জন্যেও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।
ম্যাকিয়ভেলি নানা ধরণের রাষ্ট্রকাঠামোর বর্ণনা দিয়েছেন। একটি রাজ্যের ক্ষমতা দখলের ও শাসন করার উপায় বলেছেন, শাসকের চরিত্র কেমন হওয়া উচিৎ তা উল্লেখ করেছেন। তবে এ আলোচনায় শুধুমাত্র বর্তমান সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহের উপর বিশেষ জোর দেয়া হবে।
শাসকের মুনিঋষির মত সাধু হওয়ার প্রয়োজন নেই, তার সফলতার ও কাজের একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ। বাস্তবতা বিবর্জিত আদর্শ ও ন্যায়পরায়নতা ধ্বংস ডেকে আনে। শাসক বদগুণাবলি থেকে দূরে থাকবে, যাতে তার বদনাম না হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যে কোন অসৎকাজ শাসকের জন্য ন্যায়সঙ্গত। ভালো কাজ করে অনেকেই ক্ষমতা হারিয়েছে, আবার নানা ধরণের অনৈতিকতায় জড়িয়ে লম্বা সময় শাসন করেছে। তাই শাসক নিজে ভালো হওয়ার চেয়ে জনগণ ও অন্যের নিকট ভাল, ন্যায়পরায়ণ, সৎ, মানবিক হিসেবে জাহির করা বেশি কার্যকরী।
শাসক হিসেবে সবকিছু অকাতরে বিলিয়ে দেয়া অপ্রয়োজনীয়। অতিরিক্ত বদান্যতা জনগণের ট্যাক্সের বোঝা বাড়িয়ে দেয়, সুনামের জন্য যতটা চ্যারিটি প্রয়োজন ততটা করা যেতে পারে। বদান্যতা অল্প লোককে খুশি করে। এর চেয়ে কৃপণ শাসক অধিকতর গ্রহণযোগ্য। অযথা করুণা বা মহানুভবতা অপ্রয়োজনীয়, এগুলো অরাজকতা বাড়িয়ে দেয়।
মানুষ শঠ, প্রতারক, সুযোগসন্ধানী, মিথ্যেবাদী, অকৃতজ্ঞ ও স্বার্থান্বেষী। মহানুভবতাকে দুর্বলতা ভেবে চাহিদা বাড়িয়ে দেবে, আবার সুযোগ পেলে বিপদে ফেলে দেবে অথবা বিপদে ফেলে পালিয়ে যাবে। কিন্তু, যাকে ভয় পায় তাকে কখনো ক্ষতির চিন্তা করতে পারে না। মানুষ সামান্য স্বার্থে প্রিয়জনের বন্ধন ছেড়ে যায়, আবার শাস্তির ভয়ে শত্রুর পদলেহন করে ও বন্ধন শক্ত করে।
শাসক ভীতিকর হলেই ঘৃণ্য হবেন- এমন কোন বিষয় নেই। তবে সকল পর্যায়ে, শাসকদের নাগরিকের সম্পত্তি বেদখল ও তাদের মেয়েমানুষের প্রতি কুনজর দেয়া বা এগুলোর উপর জোর খাঠানো উচিৎ নয়। এগুলো শাসকের প্রতি নাগরিকের ঘৃণা জাগিয়ে তোলে এবং ষড়যন্ত্রকারীদের শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ দেয়। সুতরাং, শাসককে ভালোবাসুক আর না বাসুক, ভয় তৈরি করে রাখতে হবে।
শত্রুদের প্রতি নির্মমতা ও কঠোরতা প্রদর্শণ শুধু শত্রুদের ধ্বংস করে না, বরং নিজেদের ভেতরকার লোকজনের জন্য এটি একটি সতর্কতা। এরা ভয়ে কুকড়ে থাকে এবং পরবর্তীতে কোন ধরণের ষড়যন্ত্র করতে সাহস করে না। শত্রুকে কখনো দুর্বলভাবে কখনো আঘাত করা উচিৎ না, বরং প্রয়োজন হলে তাকে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। শাসককে জনগণ কি চোখে দেখে এটা খুব গুরুত্বপুর্ণ। ম্যাকিয়াভেলি প্রিন্সকে শৃগালের মত ধুর্ত ও সিংহের মত সাহসী ও ভয়ংকর হতে বলেছেন। প্রয়োজনে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা যাবে। তবে কারণ হিসেবে একটা সাধু –সাধারণ ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে দিতে হবে, যাতে জনগণ শাসককে সরাসরি প্রতারক বলতে না পারে।
রাষ্ট্রনায়কেকে জ্ঞানী হতে হবে। নানা ইতিহাস ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের উত্থান-পতন, জয়-বিজয়ের কারণগুলো জানা দরকার। সে মৃগয়ায় যাবে। এর মাধ্যমে রাজ্যের ভৌগলিক পরিবেশ সম্পর্কে সরাসরি ধারণা লাভ করবে্, যা তাকে পরে যুদ্ধে বিজয় বা রাজ্য শাসন করতে সুবিধা করে দেবে।
ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন পুঁজিবাদের সমর্থক। তার মতে প্রজাদের ব্যবসা বাণিজ্যের ভাল পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। ফলে একদিকে রাজকোষাগার সমৃদ্ধ হবে এবং প্রজারা সুখী ও শাসকের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। প্রজারা খুশি থাকলে ভেতরের ও বাইরের ষড়যন্ত্রকারীরা দুর্বল থাকবে।
মানুষের যে সকল গূণ অন্যদের কাছে পূজনীয় ও বাঞ্ছণীয় তা শাসকের মধ্যে থাকার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে প্রদর্শন ও প্রচার করতে হবে, ভালো গূণের ব্র্যান্ডিং করে ফেলতে হবে। তিনি যখন যেখানে যেমন প্রয়োজন সেইরূপ ধারণ করবেন। সবার কাছে একই সাথে ভীতিকর ও প্রিয় হতে চাইবেন। প্রজারা তাকে জানবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দয়ালু, বিশ্বাসী, ধার্মিক ও অনুকম্পাশীল হিসেবে। তিনি ঘৃণা ও গ্লানির উর্ধ্বে থাকবেন। কাপুরুষতা, অস্থিরচিত্ততা, ভীরুতা, লঘুচিত্ততা ও কমণীয়তা পরিহার করবেন। সাহস ও শক্তির প্রতিচ্ছবি গড়ে তুলবেন এবং তার আদেশানুযায়ী কাজ না করলে কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করবেন। একজন শাসককে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র মোকাবেলার প্রস্তুতি থাকবে, সাথে সাথে বিদেশী মিত্র থাকবে। প্রয়োজনে মিত্রদের অকুন্ঠ সমর্থন দেবে। দেশের অভ্যন্তরে অভিজাত শ্রেণিকে একজন আদর্শ শাসক অযথাই বিরক্ত করেন না, বরং তিনি অভিজাত ও সাধারণ এ দু শ্রেণিকে খুশি রেখে চলেন। নিজের আমলা, সৈন্যদের আর্থিক সমস্যা রাখেন না, বিনিময়ে তাদের সর্বোচ্চ আনুগত্যতা পান।
একজন দূরদর্শী শাসক সকল কঠোরতা বা শাস্তি নিজের কাছে না রেখে কিছু কিছু বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, সরকারী আমলা বা অভিজাততন্ত্রের হাতে দিয়ে দেন। তখন জনগণ সরাসরি তাকে দোষারোপ করতে পারে না। প্রয়োজনে জনগণকে খুশি করার জন্য এদের মধ্য থেকে দু একজনকে বলির পাঠা বানান, আর তিনি থাকেন সকলের আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে।
প্রয়োজনে তিনি তার বিশ্বস্ত অভিজ্ঞ প্রিয়লোকদের নিকট পরামর্শ চাইবেন। তবে সব পরামর্শ আমলে নেবেন না, অযাচিত পরামর্শ অগ্রাহ্য করবেন, সর্বদাই কারো পরামর্শের উপর নির্ভরশীল হবেন না। স্তুতিবাক্য শুনবেন কিন্তু আমলে নেবেন না।
ম্যাকিয়াভেলির চিন্তা পরামর্শের আকার-আয়তন-ব্যাপ্তি অনেক বেশি। তবে তার দর্শনকে এককথায় প্রকাশ করতে গেলে তার একটি বাক্য ব্যবহার করা যেতে পারে- The end justifies the means. এর কাছাকাছি এবং সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক অনুবাদ আমি পেয়েছি , “জয়ীরা ঈশ্বর, পরাজিতরা পাপী”।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D