আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ!

প্রকাশিত: ২:৫৯ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২, ২০২৩

আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ!

সাহিত্যিক |

রবীন্দ্র-নজরুল : গুরু-শিষ্যে সম্পর্কের সঘন রসায়ন …

“রসের রসিক না হলে” সব সম্পর্কের রসায়নের গন্থি উন্মোচন সম্ভব হয়না। তৎকালে ইংরেজ শাসক জাতিগত বিদ্বেষ উসকে দিয়েছিল সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেই সময় ইংরেজ সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতায় হাবুডুবু খাওয়া একটি চক্র তাঁদের দুজনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির সর্বাত্মক অপচেষ্টা করেছিল। এ ধারাবাহিকতা আজও পরিলক্ষিত হয়। যদিও তা সাফল্য লাভ করে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের ছিল গভীর সখ্যতা। নির্মল গুরু-শিষ্য সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল ইসলামের আন্তরিক সম্পর্ক অটুট থাকুক এটা মৌলবাদী মুসলমানরা যেমন চাননি, তেমনি চাননি মৌলবাদী হিন্দুরাও। দু’জনের সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টির জন্য দু’পক্ষ থেকেই নানা ধরনের সমালোচনা, আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র অবিরামভাবে চলে আসছিল। সাহিত্যের মর্মমূলে প্রবেশ করার যোগ্যতা বা অধিকার যারা রাখেন না, তারা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বিচার করেছেন ধর্ম দিয়ে। তারা বুঝতে পারেননি মানবিকতার সাধনাই করে গেছেন চিরকাল রবীন্দ্র-নজরুল।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে। দুজনের বয়সের ব্যবধান ৩৮ বছরের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয় ১৯১১-তে আর তিনি নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে। অর্থাৎ গীতাঞ্জলি যখন প্রকাশিত হয় তখন কাজী নজরুলের বয়স ১২ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স প্রায় ১৪ বছর।

নজরুল যেমন রবীন্দ্রনাথকে কবিগুরু বলে সম্মান করতেন রবীন্দ্রনাথও তেমনি নজরুলের কবি প্রতিভাকে স্বীকৃতি জানাতে পিছুপা হননি। নজরুলের ‘ধূমকেত’ পত্রিকাকে আশীর্বাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/দুর্দিনের এই দুর্গশিরে, উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন/অলক্ষণের তিলক রেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা/জাগিয়ে দে রে চমক মেরে, আছে যারা অর্ধচেতন।’ নজরুল ইসলাম এটিকে কবিগুরুর আশির্বাদ হিসেবেই মনে করতেন। সে কারণে ধূমকেতু পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আশীর্বাণীটি নিয়োমিত প্রকাশিত হতো। নজরুল ইসলাম সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকার প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশীর্বচন লেখেন : ‘ধর, হাল বলরাম, আন তব মরু-ভাঙা হল,/বল দাও, ফল দাও, স্তব্ধ হোক ব্যর্থ কোলাহল।’

কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্টদেবতাকে পূজা করে। ছেলেবেলা থেকে তার ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ, ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল সন্ধ্যা বন্দনা করেছি। এ নিয়ে কত লোক ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছে।’ কথাশিল্পী মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায় একদিন নজরুলের এই ভক্তি-শ্রদ্ধার কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বললেন নজরুলের উপস্থিতিতেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেসে বলেছিলেন, যাক আমার আর ভয় নেই তাহলে। নজরুল সঙ্কোচে দূরে গিয়ে বসলেও রবীন্দ্রনাথ সস্নেহে তাকে কাছে ডেকে বসিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বোলপুরে শান্তিনিকেতনে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সৈনিক নজরুল শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষা দেবেন। কিন্তু অস্থির প্রকৃতির বিদ্রোহী নজরুল কোথায়ও এভাবে নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকতে চাননি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দার্জিলিংয়ে দেখা হয়। এ সময় নজরুল প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো ইতালি গেছেন সেখানে কবি দ্যনুনজিও’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না? রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন, “দেখা হবে কি করে তিনি যে তোমার চেয়েও পাগল।”

নজরুল নিজেই লিখেছেন, ‘তখন আমার মনে হতো আমার পূজা সার্থক হলো, আমি বর পেলাম।’ ‘অনেক দিন তাঁর কাছে না গেলে নিজে ডেকে পাঠিয়েছেন। কতদিন তাঁর তপোবনে (শান্তিনিকেতন) গিয়ে থাকবার কথা বলেছেন। হতভাগা আমি তাঁর পায়ের তলায় বসে মন্ত্র গ্রহণের অবসর করে উঠতে পারলাম না। বনের মোষ তাড়িয়েই দিন গেল।’ নজরুল তাঁর শেষ অভিভাষণে উল্লেখ করেছেন, “কবিগুরু তাকে প্রায় বলতেন – এই উন্মাদ তুই প্রস্তুত হ’। তোর জীবনে বিরাট ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছে শেলীর মত, কিটসের মত। তুই নিজেকে প্রস্তুত কর।” (শেষ অভিভাষন)

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখা ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেন। নজরুল তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কারারুদ্ধ। কবি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে জেলখানায় বইখানি পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি উৎসর্গপত্রে নজরুলকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করে লেখেন, জাতির জীবনের বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি কবি নজরুলকে উৎসর্গ করছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছাকাছি যেসব কবি-সাহিত্যিক থাকতেন তাদের অনেকেই তখন অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তাঁর প্রতি। জবাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়সহ উপস্থিতজনদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করছে। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করেনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছে মাত্র। …কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এও তোমাদের আবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি। আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও এই সুর বাজত।” দুখানা ‘বসন্ত’ দিয়ে একখানায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম দস্তখত করে দিয়ে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে বললেন, ‘তাকে (নজরুলকে) বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা যোগাবার কবিও তো চাই।’

নজরুল ইসলামও ১৯২৮ সালে নজরুল তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন ‘সঞ্চিতা’ রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। বিভিন্ন রচনায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নানাবিধ উল্লেখ থাকলেও সম্পূর্ণ তাঁকে নিয়ে লেখা কবিতাগুলো হলো ‘নতুন চাঁদ’ গ্রন্থের ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’ ও ‘কিশোর রবি’ এবং ‘শেষ সওগাত’ গ্রন্থের ‘রবিজন্মতিথি’।

এ থেকে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে কবি স্বীকৃতি দিতে কত আন্তরিক ও উদার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তাঁর বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ডাকতেন ‘উদ্দাম’, “ক্ষ্যাপা” বলে। নজরুল অনেকবার ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কবিতা, গান ইত্যাদি শুনিয়েছেন। পেয়েছেন প্রচুর উৎসাহ। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন না যে, নজরুল তাঁর কবি প্রতিভাকে যথার্থ সৃষ্টি কাজে না লাগিয়ে অন্য বিষয়ে নষ্ট করেন। এজন্য নজরুলকে তিনি একদিন (সঙ্গে ছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর) তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচতে নিষেধ করেছিলেন। এই কথায় নজরুল ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁর ক্ষোভের প্রকাশ লক্ষণীয় কৈফিয়ত কবিতায়। নজরুল পরে বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর তত্ত্বের কথা। অনেক সময় নিন্দুকের দলের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা বিরক্ত হয়েছেন (সাহিত্য ধ্বস)। নজরুলও অভিমান করেছেন। তার প্রমাণ মেলে “বড়র পিরিতি বালির বাঁধ”–এ।

নজরুল ইসলাম যৌবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। এ ছাড়া গীতাঞ্জলির সবগুলো কবিতা ও গান তাঁর মুখস্থ ছিল। এ কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবহিত হওয়ার পর খুবই খুশি হয়ে বলেছিলেন, আমারই তো মুখস্থ নেই। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে কী স্নেহ করতেন তার আরেকটি উদাহরণ – রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘গোরা’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে নজরুল ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এতে বাধ সাধলে রবীন্দ্রনাথ তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালনার স্বীকৃতি প্রদান করেন। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, বিদ্রোহী, ভাঙ্গার গান পড়ে রবীন্দ্রনাথ অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন নজরুল ইসলামকে। কবি নজরুল ইসলাম সৈনিক হিসেবে চাকুরি করে ২১ বছর বয়সে কলকাতায় ফিরে আসেন ১৯২০-এর মার্চ মাসে। কলকাতার ৩২, কলেজ স্ট্রিটে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অফিসে ওঠেন নজরুল। তখন তাঁর বাক্স-পেটরার মধ্যে ছিল কবিতার খাতা, গল্পের খাতা, পুঁথি-পুস্তক, মাসিক পত্রিকা এবং রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি। কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘নজরুল ইসলাম বহু রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। তিনি কি করে যে রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলো মুখস্ত করেছিলেন তা ভেবে অবাক হই।’

হুগলী জেলে কারারুদ্ধ নজরুল জেল কর্মকর্তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনশন শুরু করেন। একটানা ৩৯ দিন চলে অনশন। সমগ্র দেশবাসী উদ্বিগ্ন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরু হয় মিটিং-মিছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে ১৯২৩ সালের ২১ মে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে বিশাল জনসভা হয়। উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করার জন্য টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রামটি করা হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায়। তিনি লিখেছিলেন, Give up hunger strike, our literature claims you. অবশ্য জেল কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়। কারণ, নজরুল তখন ছিলেন হুগলি জেলে। নজরুল তাঁর বন্ধু কুমিল্লার বীরেন্দ্রকুমারের মা বিরজা সুন্দরী দেবীর হাতে লেবুর সরবত পান করে অনশন ভঙ্গ করেন।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সরাসরি দেখা হয়েছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে। তখন নজরুলের বয়স ২২ বছর। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন। বোলপুর স্টেশনে কাজী নজরুল ইসলাম এবং ড. শহীদুল্লাহকে অভ্যর্থনা জানান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত সচিব কবি সুধাকান্ত রায় চৌধুরী। নজরুল সেদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি কবিতার আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলেন। কবিগুরু বললেন, ‘সে কি? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শোনবার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছি, তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও।’ নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন, অগ্নি-বীণা’র ‘আগমনী’ কবিতাটি। এছাড়াও তিনি কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান। নজরুলের অনুরোধে সেদিন রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করে শোনান, ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে, এল ফাগুন দিনের স্রোতে, এসে হেসেই বলে যাই যাই।’ …এরপর বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়।

নোবেলপ্রাপ্তি উত্তর দীর্ঘ বিদেশ সফরের পর কবিগুরু দেশে ফিরলে কলকাতায় সম্বর্ধনানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এদিকে, যুদ্ধ ফেরৎ হাবিলদার কবি নজরুলও কলকাতায়। প্রায় ২ বছর অধিকাল তিনি সওগাতসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ও সাময়িকীতে নিয়োমিত অগ্নিঝরা কবিতা লিখে রীতিমত হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কিছু তথ্য শুনেছেন। দেশে ফিরে কিছু কিছু পড়েছেন। হঠাৎ নজরুল অবাঞ্ছিতের মত ওই অনুষ্ঠানে হাজির। ছুটে যান মঞ্চের আসনে বসা গুরুদেবের নিকট। প্রণাম সেরে নিয়ে নিজের পরিচয় দিতে গেলে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন সজনী কান্ত দাস। তিনি খেঁকিয়ে উঠে নজরুলকে অপমান করে তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথ সজনী কান্ত দাসকে সরে যেতে বলে নজরুলকে পাশে টেনে বসিয়েছিলেন।

এরপর ১৯২২-এর ২৫ জুন কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঐ স্মরণসভায় নজরুলকে ডেকে পাশে বসিয়েছিলেন। নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন ‘সত্যকবি’ কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথ এভাবে নজরুলকে স্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ করায় তখনও কবি-সাহিত্যিকরা ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন। প্রকৃত অর্থেই নজরুল ছিলেন উত্তররৈবিক কবি। একথা রবীন্দ্রনাথ মানলেও সজনীকান্ত দাসরা মানতে নারাজ। অথচ রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও মোহিতলাল মজুমদারসহ অনেকেই মেনে নিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, “কৈশরকালে আমিও জেনেছি রবীন্দ্রনাথের সম্মোহন, যা থেকে বেরোবার ইচ্ছাটাকেও অন্যায় মনে হত – যেন রাজদ্রোহের সামিল; আর সত্যেন্দ্রনাথের তন্দ্রা ভরা নেশা, তাঁর বেলোয়াড়ি আওয়াজের যাদু – তাও আমি জেনেছি। আর এ নিয়েই বছরের পর বছর কেটে গেল বাংলা কবিতার। আর অন্য কিছু চাইলো না কেউ, অন্য কিছু সম্ভব বলেও ভাবতে পারলো না – যতদিন না বিদ্রোহী কবিতার নিশেন উড়িয়ে হৈ-হৈ করে নজরুল ইসলাম এসে পৌঁছলেন। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাঙ্গল। (রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক)

১৯২১-এর ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহী কবিতা রচনা করে নজরুল সরাসরি চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। উচ্চকণ্ঠে ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ গাইতে গাইতে নজরুল ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করে ডাকলেন গুরুদেব আমি এসেছি। উচ্চস্বরে আবৃত্তি করতে থাকেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন, গুরুদেব আমি আপনাকে খুন করবো। রবীন্দ্রনাথ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনে কবিতার প্রশংসা করেন এবং নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন ‘সত্যিই তুই আমাকে খুন করেছিস’।

নজরুল ১৯৩৫-এর জুন মাসে ‘নাগরিক’ পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চেয়ে চিঠি পাঠান। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭৫ বছর। বেশ অসুস্থ। এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৬-এর ১ সেপ্টেম্বর লিখেছিলেন, ‘…তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছে আর কিছু না হোক করুণা দাবি করতে পারে। শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি পাশের জিলায় (বীরভুমের বোলপুরে)। কখনো যদি ঐ সীমানা পেরিয়ে আমাদের এদিকে আসতে পারো খুশি হব।’ উক্ত চিঠির জবাবে নজরুল ‘নাগরিক’ পত্রিকায় লেখেন, কবিতা “হে কবি, হে ঋষি অন্তর্যামী আমারে করিও ক্ষমা।/পর্বত-সম শত দোষত্রুটিও চরণে হল জমা।…/তুমি শ্রষ্টার শ্রেষ্ঠ বিস্ময়-/তব গুণে-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়।…/প্রার্থণা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে,/ আসি যেন শুধু গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে।”

রবীন্দ্রনাথের বয়স আশি বছর পূর্তি হয় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। তখন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে লেখেন, ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’। ১৯২০ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পূর্বকাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধার। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল যে গভীরভাবে শোকাভিভূত হয়েছিলেন তার পরিচয় রবীন্দ্রনাথের পরলোকগমনে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত নজরুলের বিভিন্ন কবিতা ও গানে পাওয়া যায়। এই দিন (২২ শ্রাবণ’ ১৩৪৮) কাজী নজরুল ইসলাম আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার করেন। তিনি আবৃত্তি করেন ‘রবিহারা’ কবিতা এবং রচনা করেন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’। এ ছাড়া ‘সালাম অস্তরবি’ এবং ‘মৃত্যুহীন রবীন্দ্র’ নামে দুটি কবিতা রচনা করেন।

রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বাঙালি জাতি ও বাংলার দুই মহান ব্যক্তিত্ব ও বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক জাজ্বল্যমান তারকা। তাঁদের মহত্ব আর ঔদার্য বাঙালির গর্বের বিষয়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর পরেই নজরুল চিরতরে অসুস্থ এবং ক্রমান্বয়ে সম্বিতহারা ও নির্বাক হয়ে যান। বাংলার দুই মহান কবির কণ্ঠ প্রায় একই সময়ে নীরব হয়ে যায়। নজরুলের কবিতার ভাষায় – “নিশ্চল নিঃচুপ। আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।”

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ