সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়!

প্রকাশিত: ১:৫৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৩

সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়!

শরীফ শমশির |

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির উপরের বাক্যটি বাইবেলের প্রেমের বাণীর মতো সহজ কিন্তু বাস্তবায়ন অনেক কঠিন! মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই দেশটির বর্ণিত নীতিটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রণীত। তিনি এই জাতিরাষ্ট্রের জনক হিসেবে বিবেচিত হন। স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশ্বমানচিত্রে টিকিয়ে রাখার জন্য এবং সর্বাধিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে এই নীতি ছিল বাস্তবানুগ। কারণ, তখন অনেক রাষ্ট্র ছিল বাংলাদেশের বন্ধু আবার অনেকই বন্ধু হয়ে উঠেনি। কারা বন্ধু ছিল আর কারা বন্ধু ছিল না তা আজ না বললেই চলে কারণ এখন দাবার ছক বা গুটি পাল্টে গেছে। যদিও মরা নদীর তলে যেমন পুরনো ধারার চিহ্ন থেকে যায় তেমনি অতীত হয়ত কিছু কিছু রয়ে গেছে।

আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন শক্তি ও পরাশক্তির ঘন ঘন আনাগোনা দেখে মনে হচ্ছে সবার বন্ধু বাংলাদেশ হতে চাইলেও অনেকে বন্ধুর মতো আচরণ নাও করতে পারে। সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী আসবেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টও আসবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রতিনিধিরা ঢাকায় আছেন। ভারত ও চীনের প্রতিনিধিগণ নিয়মিত আসাযাওয়ায় আছেন। সকলেই আমাদের বন্ধু, আমাদের ভালো চান। কিন্তু পররাষ্ট্র নীতি এমন জিনিস আমার দেশের স্বার্থ অন্য দেশের স্বার্থের সাথে নাও মিলতে পারে। তখন হয় আমার দেশ তাদের বন্ধু হয় না বা তারা আমাদের বন্ধু ভাব না। কেউ নিজ নিজ স্বার্থের বাইরে নয়। তাই সকলে আমার দেশের বন্ধু হয় না বা আমারও তাদের বন্ধু থাকি না। কিন্তু রাজনীতি বড় কঠিন! অন্য দেশ আমাদের বন্ধু, আমাদের স্বার্থই তাদের স্বার্থ, এমনটা হয় না। হওয়া উচিত, উইন উইন, তুমিও জিতবে আমিও জিতব। কিন্তু বিপদ আসে যখন কেউ কেউ পরাশক্তিকেও মুক্তির দূত মনে করে! সে আমাকে জেতাবে কিন্তু দেশ কোথায় যাবে তা বিবেচনায় নেন না।
পররাষ্ট্র নীতি আসে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ছাড়াও দেশের অর্থনীতিকে বিবেচনায় নিয়ে। এছাড়া, আমাদের শ্রমশক্তি বিদেশে যাবে তাদের স্বার্থ দেখা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণে বিদ্যা অর্জনে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো।
বাংলাদেশ এখন অনেক বড় অর্থনীতির মালিক। তার আছে সস্তা শ্রমশক্তি। তার আছে খনিজ ও সমুদ্র সম্পদ। তাছাড়া, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আগমন। বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রশ্নেও গুরুত্বপূর্ণ। তাই, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি এখন অনেক জটিলতার মুখোমুখি হয়েছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এমন জায়গায় এখন অনেকেই সরকার বিব্রত হলে খুশী হন এবং সেই শক্তি বা পরাশক্তির তারিফ করে। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা যা অনেক সময় আমাদের পররাষ্ট্র নীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দেশের স্বার্থ হেরে যায়।
আরেকটি বিষয় আমাদের পররাষ্ট্র নীতিকে আঘাত করছে। আমরা অন্যের দোষে স্যাংশনের স্বীকার হচ্ছি। আজ একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশকে চীনমুখী হওয়া থেকে বিরত রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। মার্কীন চীনের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার রশি টানাটানি বাংলাদেশের মাটিতেও চলে এসেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইইউ, জাপান চীন ও ভারতকে দরকার। আমার দরকার সবার বন্ধুত্ব। কিন্তু অন্য প্রান্তের শত্রুতা বাংলাদেশের আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
আমাদের প্রতিবেশী ভারত। প্রতিবেশী নাকী বদলানো যায় না। আর সিংহের ঘুমও নাকি ভাংগাতে নেই। ভারত বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেও নানাভাবে সংযুক্ত। ভারত আমার বন্ধু হলে আমাদের লাভ, ভারতেরও লাভ। কেউ কাউকে ঘাঁটানো উচিত নয়। এখানে বিনিময়ে আমার লাভের চেয়ে ভারতের লাভও কম নয় তাই, বাংলাদেশকে বৈশ্বিকভাবে অন্য বন্ধু বেছে নিতে তাদের বাগড়া দেওয়া উচিত নয়। রাশিয়া আমাদের স্বাধীনতা কালের বন্ধু, তাদের আগমনকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে আমরা স্বাগত জানাই না। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের ইউক্রেন নীতি বাংলাদেশের উপর প্রয়োগ না করা। তার সাথে চীনের বিরোধকে বাংলাদেশে টেনে নিয়ে না আসা। চীন জাপান, এদের সাথে আমাদের উইন উইন থাকার চেষ্টা করব।
কিন্তু দূর্ভাগ্য অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিভাজন যুক্তরাষ্ট্রের অনূকূলে যাচ্ছে। সরকার চাপে থাকছে কিন্তু দূর বিবেচনা করলে দেশই চাপে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা সোনার পাথরবাটী। আমাদের গণতন্ত্রের প্রলোভনে আটকে রেখে মাঝখান দিয়ে আমাদের অনেক সামরিক চুক্তির সোনার শেকলে আটকে ফেলতে পারে!
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আপনি যে পক্ষই হোন না কেন, পররাষ্ট্র নীতিতে দেশের পক্ষেই থাকা দরকার।
চানক্য বা সেন জু এইরকমই বলেন।
সারা পৃথিবীতে দক্ষিণ পন্থা বাড়ছে এবং বাংলাদেশেও তার প্রভাব আছে। কিন্তু আমাদের সামাজিক ধর্মীয় জাতিগত সম্প্রীতি দরকার, জেন্ডার সমতা ও সামাজিক সাম্য দরকার। আমাদের পররাষ্ট্র নীতি যেন এগুলোকে কেন্দ্রে রাখে।
এখন বাংলাদেশের শত্রুতা করার সময় নয়, সব দিক দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময়। নিবিড় ও প্রশিক্ষিত কূটনৈতিক তৎপরতা আমাদের শত্রুদের নিবৃত করতে পারে।
এই মাসের মতো আর কখনও বাংলাদেশ মনে হয়, এতো আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্পটলাইটে আসেনি।
হাজার বছর ধরে বহু জাতি বাংলাদেশে এসেছে, লুটপাট করেছে, কেউ থেকে গেছে, কেউ চলে গেছে, বহু মানুষ নিহত হয়েছে বিদেশির শোষণ শাসনে কিন্তু বাংলাদেশ দিন দিন তার সার্বভৌমত্ব শুধু রক্ষাই করে নি, আজ আত্মপ্রত্যয়ী জাতি হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দরকার আমরা যেন কারো সাথে শত্রুতা না করেই তাদের শত্রুতাকে ঠেকিয়ে দিতে পারি।
আমাদের পররাষ্ট্র নীতির জয় হোক!

#
শরীফ শমশির
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, লেখক

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ