বিশেষ প্রতিনিধি | শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার), ৩০ নভেম্বর ২০২৩ : “আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নারীর উপর সহিংসতার আশঙ্কা, প্রতিরোধ করুন, প্রতিবাদ করুন।”- এই শ্লোগান নিয়ে শ্রীমঙ্গলে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অদ্য বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর ২০২৩) সকাল ১১টায় শ্রীমঙ্গল চৌমুহনা চত্বরে অধিকার এখানে, এখনই (RHRN-2) প্রকল্প, মৌলভীবাজার চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফ্রন্ট, তারুণ্যের কণ্ঠস্বর প্ল্যাটফর্ম ও নারীপক্ষ কর্তৃক আয়োজিত এ সমাবেশে বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, ‘৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, সাপ্তাহিক নতুন কথা’র বিশেষ প্রতিনিধি, আরপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান।
মৌলভীবাজার চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফ্রন্টের সভাপতি পরিমল সং বাড়াইকের সভাপতিত্বে এ সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মিতালী দত্ত, নারীপক্ষের কো-অর্ডিনেটর স্বপন সাঁওতাল, কালীঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মিতু রায়, তারুণ্যের কণ্ঠস্বর প্ল্যাটফর্মের সদস্য সীমা মুন্ডা প্রমূখ।
এ সমাবেশের অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, “৭১-এর মহান স্বাধীনতার ৫২ বছরে সকলকে সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। জাতির সূর্য সন্তান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদ ও সকল শহীদ বুদ্ধিজীবী, সম্ভ্রম হারানো ২ লক্ষ মা-বোন, নির্যাতিত পনের লাখেরও বেশি মানুষ, সর্বস্ব হারানো ১ কোটি মানুষসহ গোটা জনগণের লড়াই-সংগ্রাম-ত্যাগ তিতিক্ষা অার অবদানের জন্য তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্ণ হলো এবার। বাঙালি জাতি ও জনগণের বড় ও শ্রেষ্ঠ অর্জন এই স্বাধীনতা। বাংলাদেশের ইতিহাস হলো স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস। এ দেশের মানুষ লড়াই করেছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শ্রেণি শোষণ ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে। দেশীয় সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচার ও লুটেরা শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। জনগণের সংগ্রামের মুখেই একদিন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ চলে গেলেও আমাদের উপর চেপে বসল পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক ধরণের শাসন ও শোষণ।
বাংলাদেশের মানুষ প্রথম থেকেই জাতিগত শাসন-শোষণ-বঞ্চণা-অনুন্নয়ন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছে- যার চূড়ান্ত রূপ লাভ করল ’৭১-এর সুমহান সশস্ত্র স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ভিতর দিয়ে।
আমাদের দেশে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীরা ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই সহিংসতার হার অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। নারী- পুরুষের ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হয়। কিন্তু নারীদের নিরাপত্তার বিষয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এখনো তৎপর নয়। এ বিষয়ে তাদের কোনো পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়, কিন্তু নারী বান্ধব বা নারীর কল্যাণমূলক কোনো ইস্যু গুরুত্ব পায় না। এসময় জাতীয় পরিকল্পনা নীতিতে, সংসদ অধিবেশনে নারীর ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি সহিংসতা বন্ধে জননিরাপত্তমূলক ভূমিকা গ্রহণের জন্য, নারীর প্রতি সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার কার্য পরিচালনা করার জন্য, দ্রুত বিচার করে ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করা, ধর্ষণের ঘটনায় আপোষ না করা ,ধর্ষণের শিকার নারীকে ধর্ষকের সাথে বিয়ে না দেয়া, ধর্ষণের শিকার নারী ও কন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সহিংসতার ঘটনায় ভিকটিমকে দোষারোপ না করার জন্য দাবি জানান।
তিনি বলেন স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসেও নারীর জীবন নিরাপদ নয়। ২০২০ সালের আর ২০২১ সালের মতো এবারও নারীর প্রতি অব্যাহত সহিংসতা, নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছো। নারীর প্রতি সহিংসতার এই ভয়াবহ মাত্রাকে দূর করতে হলে প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে, রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নারী আন্দোলন মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, “সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-লুণ্ঠনমূলক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির কারণে দেশের অর্জন, অগ্রগতি, উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ভূমি সংস্কারসহ কৃষির গণতান্ত্রিক সংস্কার, শিল্পায়ন ও সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়েছে পদে পদে। প্রশাসনে, অর্থনীতিতে ও সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির কারনে বিরাজ করছে অস্থিরতা, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, বিশৃঙ্খলা, অনুন্নয়ন ও শোষণ-লুণ্ঠন। জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও এ কারণে গড়ে উঠতে পারেনি।
আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে প্রতি বছর যে উদ্বৃত্তমূল্য সৃষ্টি করছে, তার বড় অংশ আত্মসাৎ করছে সাম্রাজ্যবাদ। এই উদ্বৃত্তমূল্য দেশের মধ্যে পুঁজি হিসেবে সঞ্চিত হচ্ছে না, দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী মুনাফার উচ্ছিষ্ট ভোগ করে, জনগণকে বেপরোয়া শোষণ-লুণ্ঠন করে দেশীয় আমলা মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া তার ধনভান্ডার বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু তাও কোন উৎপাদনমূলক জাতীয় বিকাশের কাজে ব্যবহৃত হয় নি।
আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন একদিকে শিল্প বিকাশ ও অপরদিকে ভূমি সংস্কার ও কৃষির গণতান্ত্রিক সংস্কার। এ দু’টো ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। আজকের দিনে অবশ্য সাম্রাজ্যবাদ বিপ্লব ঠেকানোর জন্য কৃষিতে বুর্জোয়া ঢং-এ কিছু সংস্কার করতে চায়। কারণ তারা আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে প্রধানতঃ যেটা চায়, তা হল দেশটি যেন বিশ্ব পুঁজিবাদী সম্পর্কের আওতার মধ্যে থাকে। এতেই তাদের লাভ। সেই কারণে আমাদের দেশেও একাধিকবার ভূমি সংস্কার ইত্যাদির কথা বলা হলেও, তাদের তৈরি করা ‘পিআরএসপি’তে ভূমি সংস্কারের বিষয়টি রাখা হয় নি। এ ছাড়া ‘পিআরএসপি’ আর ড. ইউনূস উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচী দিয়ে শোষণ-লুণ্ঠনমূলক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশে জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন হবে না, আদৌ হতে পারে না। আমাদের দেশে পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যেই কোনো ধরণের গণতান্ত্রিক সংস্কার বা কোনো প্রকার বুর্জোয়া সংস্কারও সম্ভব হয় নি। বড় বড় দলগুলোর কেউই স্বাধীন জাতীয়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া সংস্কার করার ন্যূনতম কর্মসূচী এ পর্যন্ত ঘোষণা করে নি। এমনকি উৎপাদন ব্যবস্থায় যে সামন্ত অবশেষ ও প্রাক-পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক রয়েছে, তাদের জিইয়ে রেখে উৎপাদন শক্তিকে আটকে রাখবে বলে মনে হয়। সাম্রাজ্যবাদি সংকীর্ণ কায়েমীস্বার্থ ও শোষণের রাজত্বকে বজায় রাখার স্বার্থে ঔপনিবেশিক আমলের প্রশাসন ব্যবস্থাকে মূলতঃ টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের মৌলিক উন্নতি ঘটে নি। রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় রকমের পরিবর্তন সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতী সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো মৌল পরিবর্তন ঘটে নি। নিষ্ঠুর শোষণ-লুণ্ঠনে সাধারণ খেটে খাওয়া গরীব মানুষের জীবনে আজ নাভিঃশ্বাস উঠেছে। ভূমি সংস্কার ও শিল্প বিকাশ না হওয়ায় বেকারের সংখ্যাও ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিল্প বিকাশের উদ্যোগের অভাব, ভূমি সংস্কার ও কৃষিতে প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টার অনুপস্থিতি এবং সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদী সীমাহীন বেপরোয়া শোষণ-লুণ্ঠনের কারণে প্রকৃত অর্থে সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
শ্রমজীবী মানুষ শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতির যন্ত্রণা থেকে মুক্তির সুতীব্র আকাঙ্খায় ছটফট করছে। মানুষ চায় পরিবর্তন। গোটা সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন। এর নাম বিপ্লব। প্রয়োজন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতির স্বার্থে। প্রয়োজন শতকরা ৯৫ জন মানুষের বেঁচে থাকার স্বার্থে। এই বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদের নয়া ঔপনিবেশিক শোষণের অবসানসহ শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতি-অনিয়মের রাজত্বের মূলোচ্ছেদ করে কৃষি ও অর্থনীতির ক্ষেত্র থেকে সামন্ত অবশেষের উচ্ছেদ ঘটিয়ে এক নতুন প্রগতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে জনগণের এক শিল্প বিকশিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে সম্পূর্ণত জনগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার। বিপ্লব আজ সামাজিকভাবে অবশ্যম্ভাবীরূপে দেখা দিয়েছে। ক্ষুধাপীড়িত, অত্যাচারিত, শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতি জর্জরিত মানুষকে বেঁচে থাকার তাগিদে মুক্তির আকাঙ্খায় নিজ নিজ ভাগ্য পরিবর্তনের প্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাম প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
শোষণমূলক অার্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন দরকার। দরকার জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুশাসন নিশ্চিত করা। আর সেটি করতে হলে আমাদের বৈষম্যহীন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এই চার নীতিতে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।”
Post Views:
১,১৭০