উনিশশো পচিশ সালের ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক কয়েকটি দিন!

প্রকাশিত: ১২:৪১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪

উনিশশো পচিশ সালের ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক কয়েকটি দিন!

দিবালোক সিংহ |

১।
সময়টা উনিশশো পচিশ সাল। ফেব্রুয়ারি মাসের কোন একদিন। জারিয়া (আরবি শব্দ অর্থ হল আলো বা সৌন্দর্য ) বা ঝারিয়া ঝাঞ্জাইলের মধ‍্যবয়সী স্টেশন মাষ্টার তারিণী মোহন ভট্টাচার্য বসে আছেন তার অফিস ঘরে। রৌদ্র উজ্জ্বল ঝলমলে সকাল। তিনি কাছাকাছি সময়ে বদলি হয়ে যাবেন ময়মনসিংহ জাংশন স্টেশনে। কোম্পানি তাকে পদোন্নতি দিয়ে বদলি করেছে, তিনি খোশ মেজাজে আছেন। ময়মনসিংহ- ভৈরববাজার রেল কোম্পানি এ লাইনে রেল চলাচল শুরু করেছে ১৯১৮ সালে। কংশ নদীর তীরে ঝারিয়া ছোট প্রান্তস্থিত স্টেশন। এর গুরুত্ব কম। দিনে তিনবার ট্রেন আসে। এখানকার জমিদাররা প্রতাপশালী। তারা বৃটিশের কাছ থেকে মহারাজা উপাধি পেয়েছেন। অবশ‍্য গারো পাহাড়ের কর্তৃত্ত্ব বৃটিশ রাজের কাছে ছেড়ে দিতে হয়েছে। রাজ বাড়ি সুসঙ্গ দূর্গাপুরে! এখান থেকে দশ বারো কিলোমিটার। যেতে হলে নৌকা, পায়ে হাটা বা গরুর গাড়িই ভরসা। এলাকায় প্রধানত হাজং, গারো আদিবাসীদের বসবাস। আদিবাসী কৃষক হাজং প্রজারা বঞ্চিত ও দরিদ্র । মহারাজারা টঙ্ক প্রথায় দুই লক্ষ মন বছরে খাজনা আদায় করেন। এসব নিয়ে কৃষকদের মনে রয়েছে অসন্তোষ।

২। ময়মনসিংহ থেকে ট্রেন আসার সময় হয়ে এসেছে। ট্রেন আসার সময় ঘনিয়ে আসায় যাত্রী আর কুলিদের কোলাহল ও ব‍্যস্ততা বেড়ে গেছে। তারিণী বাবু খবর নিলেন সকালের ট্রেন একটু দেরি করে পৌছাবে! এই একটা সমস‍্যা ট্রেনের সিডিউল ঠিক মতো রাখা সম্ভব হয় না। তার পুজো করার সময় এগিয়ে আসছে, তিনি ধার্মিক ব্রাহ্মণ, স্নান করে পুজো দিয়ে আহ্নিকে বসতে হবে। তাকে একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে। তিনি যেন কারো অপেক্ষায় আছেন! মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে তার আস্থা কম। অনেকের অজানা কিন্তু তিনি গোপন সন্ত্রাসবাদী অণুশীলন দলের অন‍্যতম নেতা। তার ভাবনা আন্দোলনের পাশাপাশি বৃটিশ উচ্ছেদে সশস্ত্র পন্থার আশ্রয় নিতে হবে। সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না! দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করা তার ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। স্থানীয় যুবকদের উৎসাহিত করে একটি শরীরচর্চা ক্লাব পরিচালনা করছেন। এই শরীর চর্চা কেন্দ্রের আড়ালে অণুশীলন দলে কর্মী সংগ্রহ চলছে। তিনি গোপন খবর পেয়েছেন, আজ কোলকাতা থেকে একজন বড় মাপের বিপ্লবী আসছেন। স্টেশনে বৃটিশ পুলিশ মোতায়েন আছে। তারা যদি সন্দেহ করে তাহলে সমস‍্যা হবে। তাই তার অস্থিরতা! দুর থেকে কয়েকবার বাশি বাজিয়ে ট্রেন চলে এল! ভারি কোট, টাই, মাথায় বৃটিশ হ‍্যাট, মোটা ফ্রেমের চশমা পরা এক গাট্টা,গোট্টা চেহারার মাঝারি গড়নের শ‍্যামলা রঙের ভদ্রলোক ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন মাষ্টার বাবুর অফিসে ঢুকলেন। ঝারিয়া পৌছাতে তাকে বহু ঝক্বি ঝামেলা সামলাতে হয়েছে। শেয়ালদা থেকে Eastern Bengal Rail এ পৌছেছেন গোয়ালন্দ তারপর স্টিমার এ পদ্মা পাড়ি দিয়ে নারায়ণগঞ্জ, তারপর ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে পৌছেছেন ঝারিয়া। তাকে যেতে হবে সুসঙ্গ দূর্গাপুর। তিনি আসছেন লেনিনের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কো থেকে। তৃতীয় আন্তর্জাতিকে তিন বছর কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার! রাশিয়া যাবার আগে শ্রমিক আন্দোলন (এআইটিইউসি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২০) ও কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা ও গড়ে তোলার কাজে তিনি ছিলেন অন‍্যতম পথিকৃত। ১৯২৯ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন‍্যতম প্রতিষ্ঠাতা সর্ব কমরেড শওকত উসমানি, এস এ ডাঙ্গে, মুজাফফর আহমেদ, বৃটিশ কমিউনিস্ট ফিলিপ স্প্রাট, বেঞ্জামিন ব্রাডলি ও অন‍্যান‍্য ৩১ জন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সাথে তার বিরুদ্ধেও মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা (মূল অভিযোগ এরা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ভারতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের শাখা গঠন করতে যাচ্ছেন, যাতে বৃটিশ রাজের স্বার্থ লঙ্ঘিত হবে ও এই রাজকে সম্পূর্ণ অচল বা সশস্ত্র পন্থায় উৎখাতের পরিকল্পনা চলছে) দায়ের করা হয়েছিল। তাতে তার পরবর্তীতে পাচ বছর (১৯২৯-১৯৩৩) সাজা খাটতে হয়। এখানে স্টেশন মাষ্টার অনুশীলন দলের গোপন সদস‍্য! তার কাছে আগে খবর পেয়েছেন মনীন্দ্র কুমার সিংহের। স্টেশনে আর একবার ঠিকানা ও কোথায় যেতে হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হলেন ! জেনে নিলেন লেখাপড়া করেছে কোলকাতায়। অনুশীলন দলের তরুণ সদস‍্য। তেজি, উজ্জ্বল টকটকে ফর্সা চেহারা, মাঝারি গড়ন। নিয়মিত ভারত্তোলন ও কুস্তি চর্চা করে! সন্ত্রাসী পন্থায় বৃটিশ রাজ উচ্ছেদে বদ্ধপরিকর। অবশেষে তারিণী মোহন বাবুর সহযোগিতায় গরুর গাড়িতে সুসঙ্গ দূর্গাপুরের দিকে রওয়ানা হলেন মস্কো ফেরত প্রখ‍্যাত বিপ্লবী কমরেড গোপেন চক্রবর্তী। আর তার সাথে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে জড়িত অনুশীলন দলের সক্রিয় কর্মী যুবক মনীন্দ্র সিংহের দেখা হল পাহাড়ের কাছে চন্ডিগড় ইউনিয়নের নাগেরগাতি গ্রামে। এই গ্রামে তার মামার বাড়ি। সাথে মামাতো ভাইও আছে। তারা সবাই মিলে তখন ব‍্যস্ত হাজং গ্রামগুলোতে নিরাপদ পানির ব‍্যবস্থা কিভাবে করা যায় তা নিয়ে! পরিকল্পনা চলছে এদেরকে নিরক্ষতা থেকে কিভাবে মুক্ত করা যায়। চলছে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ। বেশ সাজসাজ রব। তাছাড়া দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই এগিয়ে নিতে যুবকদের শরীরচর্চা ও অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণের পাশাপাশি, এখানকার মানুষকে বিশেষত আদিবাসীদের পশ্চাৎপদতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে কিভাবে বের করা যায় তার বিভিন্ন পরিকল্পনা।

৩। এখন দেখা যাক অনুশীলন দল কি, কেন ও কিভাবে সংগঠিত হয়েছিল!? ভারতে বৃটিশ বিরোধী জাতিয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাধার পটভূমিতে, যতদুর জানা যায় অনুশীলন দল ১৯০২ সালে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়! যে কারনগুলোতে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম শুরু হয়েছিল তার ভেতর অন‍্যতম হল লর্ড কার্জনের সময়ে চালু করা শিক্ষা সংস্কার ও বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫। পরে আন্দোলনের চাপে ১৯১১তে স্থগিত হয়। পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি প্রদেশ যার রাজধানী হবে ঢাকা। আর পশ্চিমবঙ্গ, বিহার উড়িষ‍্যা নিয়ে অপর প্রদেশ। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন “আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালবাসি…..”) আদেশ। যুবকদের চিন্তা-চেতনাকে কার্যকর করার জন্য প্রকৃত বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই মানসিক যোগাভ্যাস ও শরীরচর্চার জন্য গ্রাম ও শহর এলাকায় অনুশীলন সমিতি নামে অসংখ্য যুব সংগঠন গঠিত হয়েছিল। অনুশীলন সমিতি কোনো সময় হতে বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু করেছিল তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, এখন স্বীকৃত যে, ১৯০৫ সাল থেকে অনুশীলন দল বিপ্লবী কার্যক্রম শুরু করে। অনুশীলন দলের উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান। অনুশীলন দল যুবকদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক উন্নয়ন- এ তিন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে হিন্দু ধর্মের শাক্ত মতবাদের (এ বিশ্বাস অনুযায়ী মাতৃ শক্তি বা দেবী হলেন পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর) ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দের লিখিত বইগুলোর পাঠককে এই দলে অগ্রাধিকার দেয়া হতো। অনুশীলন সমিতিতে কেউ যখন সম্পৃক্ত হতো, তখন শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য গীতা ব্যবহার করা হতো। সম্ভবত এ কারণেই কোনো মুসলমান অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিতে পারত না।

অনুশীলন দল বৃটিশ রাজ উচ্ছেদের লক্ষে তরুণদের ভেতর রাজনৈতিক সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তোলা, এ লক্ষকে সামনে রেখে বোমা তৈরি, অস্ত্র প্রশিক্ষণ, সমর্থক জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ, তহবিল সংগ্রহে রাজনৈতিক ডাকাতি, ব্রিটিশ রাজকর্মচারী এবং তাদের বিচারে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে চিহ্নিত ভারতীয়দের শাস্তি ও সিদ্ধান্ত হলে হত‍্যা করায় উদ‍্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতো। অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন অংশে অনুশীলন দলের শাখা গড়ে উঠেছিল। বিহারের মুজাফ্ফরপুরের জেলা জজ ডগলাস কিংসফোর্ডকে হত‍্যা চেষ্টার মামলায় গ্রেফতার হন রংপুরের বাসিন্দা অগ্নিযুগের তরুণ বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী (জন্ম ১৮৮৮ আত্মহত্যা ১৯০৮) ও তার সহযোগী অপর খ‍্যাতনামা তরুণ কনিষ্ঠ বিপ্লবী খুদিরাম বসু। অগ্নিযুগের বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী পুলিশের হাতে ধরা পরার সময় আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন এবং নিজেই নিজের রিভলবার দিয়ে মাথায় দুবার গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তাঁর সহযোগী ক্ষুদিরাম বসু ধরা পড়েন ও বিচারে তাঁর ফাঁসি হয় (১৯০৮)। ঢাকা অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর উভয় দলের সদস্য সূর্যসেন ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন-এর অভিযান পরিচালনা করেন। এরা পরবর্তীতে জনগণের মনে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন‍্যতম দেশপ্রেমিক নায়কের স্থান অধিকার করেন যা এখন পযর্ন্ত বজায় আছে। অনুশীলন ময়মনসিংহ শাখার সভাপতি ছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক‍্যনাথ চক্রবর্তী। ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ১৮৮৯ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলায় জন্মগ্রহন করেন। তিনি ১৯০৬ সালে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন। জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে শরীর চর্চা কেন্দ্র গঠন করে নিজ জেলায় বিপ্লবী ঘাঁটি তৈরি করতে থাকেন। ১৯০৯ সালে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় পুলিশ তাকে খুজতে শুরু করলে আত্মগোপন করেন। পরে তিনি সুভাষ বোসের সাথে কংগ্রেসে যোগ দেন। বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে কুখ্যাত আন্দামান জেলে দশ বছর সহ মোট তিরিশ বছরের বেশি তাকে কারা অন্তরালে থাকতে হয়। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৭০ সালে ভারতের সংসদ অধিবেশনে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব‍্য রাখেন। ১৯৭০ সালের ঐ সময় অসুস্থ হয়ে একাশি বছর বয়সে ভারতের দিল্লিতে তিনি মৃত‍্যুবরন করেন।

৪। এখন দেখা যাক কমরেড গোপেন চক্রবর্তী যে তৃতীয় আন্তর্জাতিকে কাজ করেছিলেন তা কিভাবে শুরু হয়েছিল!? আর প্রথম, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকই বা কি ছিল!? ১৮৬৪ সালে আন্তর্জাতিক কর্মজীবী পুরুষদের সংগঠন (international working men association ) গঠিত হয়। এটাই ছিল সর্বহারার প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন। এর নেতৃত্বে ছিলেন কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, মিখাইল বাকুনিন, গারিবাল্ডি প্রমুখ। বিশ্বব‍্যাপি এর সদস‍্য সংখ্যা ছিল আশি লক্ষের মত। প্রথমবারের মত এ সংগঠন ঘোষনা দেয় পুজিঁবাদী ব‍্যবস্থা উচেছদ করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মানের।শ্রেণি সংগ্রাম তীব্র করার ভেতর দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করা। এই সংগঠনে সমাজতান্ত্রিক বিভিন্ন ধারার প্রতিনিধিত্ব ছিল। প্রথমে শুধু পুরুষ শ্রমিকরাই এ সংগঠনের সদস‍্য হতে পারতেন। পরবর্তীতে ১৮৬৭ থেকে নারীদের সদস‍্যপদ চালু হয়। ১৮৭১ সালে প‍্যারি কমিউন গঠিত হয়। কিন্তু দুমাস পরে প‍্যারি কমিউন বুর্জোয়াদের আক্রমনের মুখে পরাজিত হয়। এই পটভূমিতে ইউরোপজুড়ে শুরু হয় প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শ্রেণির মেহনতি শ্রেণির আন্দোলন দমনের ঝড়। এরকম পরিস্থিতিতে এক পর্যায়ে মতভিন্নতার কারনে ১৮৭৬ সালে সংগঠনটি ভেঙ্গে যায়। ১৮৮৯ সালে ফরাসি দেশে বাস্তিল দূর্গের পতনের শতবার্ষিকী উদযাপনকে ঘিরে বেলজিয়ামে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্দোলন আন্তজার্তিক মে দিবস, নারী দিবস ও আট ঘন্টা কর্মদিনের দাবি প্রথমবারের মত তুলে ধরেছিল। এসব দাবি আদায়ে আন্দোলন জোরদার করার পদক্ষেপ গ্রহন করেছিল। এসব সত্ত্বেও দ্বিতীয় আন্তজার্তিকে দুটো প্রধান ভিন্নমত প্রচলিত ছিল। একটি মার্কসবাদী ও অন‍্যটি পসিবিলিস্ট (possibilist) বা সংস্কারবাদী ধারা। পুজিঁবাদী ব‍্যবস্থার উথানের সময় দ্বিতীয় আন্তজার্তিক প্রতিষ্ঠিত হয় তাই পুজিবাদীদের এ ধরনের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি মঞ্চ বা platform যাতে শুরুতেই বিকশিত না হতে পারে সে ধরনের চাপ অব‍্যাহত ছিল। যার ফলে এই ধারার প্রধান নেতৃত্ব সংশোধনবাদী ও সংস্কারপন্থী ধারায় প্রভাবিত হতে থাকে। শ্রমিক শ্রেণির প্রতিদিনের নিয়মিত আন্দোলন ও সংসদীয় রাজনৈতিক ধারায় সমঝোতা করার পদক্ষেপের ভেতর তারা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েন। তাদের জন‍্য শ্রেণি সংগ্রাম ও আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতি অনুসরণ করে প্রলেতারীয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব‍্যবস্থা প্রতিষ্ঠা একটি দূরবর্তী লক্ষ‍্য হিসেবেই থেকে যায়। সমাজতন্ত্রী নেতা পল লাফার্জ ( তিনি কিউবায় জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা ছিলেন ফরাসি দেশের নাগরিক। তিনি পরবর্তীতে ফরাসি দেশেই জীবন যাপন করেন। অর্থনীতিবিদ। ১৮৮২ সালে ফরাসি শ্রমিক দলের অন‍্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মার্কসের জামাতা, কার্লমার্কসের দ্বিতীয় কন‍্যা লাউরার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।) যে কোন বুর্জোয়া যুদ্ধের বিপক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহন করেন। কিন্তু প্রথম বিশ্ব মহাযুদ্ধ শুরু হলে প্রথম আন্তর্জাতিকের নেতৃবৃন্দ শ্রমিক মেহনতি শ্রেণির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে যার যার দেশের আগ্রাসী বুর্জোয়া নেতৃত্ত্বকে সমর্থন করেন এবং এই পরিস্থিতিতে ১৯১৬ সালে সংস্থাটি ভেঙ্গে যায়।

উপরোক্ত সুবিধাবাদী প্রবণতা বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক বাম সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন আবার শূন‍্য থেকে গড়ে তোলার বিবেচনা থেকে ১৯১৫ সালে সুইজারল্যান্ডের Zimmerwald এ সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের ভেতর অন‍্যতম ছিলেন রাশিয়ার ভ্লাদিমির লেনিন ও লিওন ট্রটস্কি, জার্মানির রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিবেনেখট, স্কটল‍্যান্ডের জন ম‍্যাকলিন, আয়ারল্যান্ডের জন কনোলি আর আমেরিকার জেমস লারকিন ও ইউজিন ডেবস। সমাজতন্ত্রীদের এই ছোট গ্রুপ একটি সংক্ষিপ্ত ইশতেহার প্রকাশ করে। এতে সাম্রাজ‍্যবাদী আগ্রাসী প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধের সর্বাত্মক বিরোধীতা ও জাতীয় প্রতিরক্ষার নামে বুর্জোয়াদের যুদ্ধ সমর্থন সম্পূর্ণ অগ্রহনযোগ‍্য ও বিশ্বাসঘাতকতা বলে তীক্ষ্ণ ও তীব্র মতামত ব‍্যক্ত করা হয়। শ্রমিক ও মেহনতি শ্রেণি গুলোকে বিশ্বব‍্যাপী সংহতি জোরদারের মাধ্যমে শান্তি, মুক্তি ও সমাজতন্ত্রের আন্দোলনকে জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়। পরবর্তীতে ১৯১৬ সালে কিয়েনথালে (Kiental Switzerland) সমাজতন্ত্রীদের সম্মেলনে লেনিন ও বলশেভিকরা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙ্গে দিয়ে সাচ্চা সমাজতন্ত্রীদের সমন্বয়ে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠনের আহ্বান জানান।

উপরোক্ত পটভূমিতে ১৯১৮ র শেষ প্রান্তে এসে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি নতুনভাবে আন্তজার্তিক কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৯ সালের দোসরা থেকে ছয়ই মার্চ এ সম্মেলন মস্কোতে অনুষ্ঠিত হয়। মস্কোর বলশয় থিয়েটার হলে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসের উদ্বোধন ও তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গঠনের ঘোষনা পাঠ করেন লেভ কামেনেভ । চব্বিশটি দেশের একান্নজন প্রতিনিধি এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও হাজারের বেশি রাশিয়ার বিপ্লবীরা সমবেত হয়েছিলেন এ সম্মেলনে। পুরো হল কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল। লেনিন এই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হওয়ার জন‍্য নিম্নলিখিত শর্ত সমুহ জুড়ে দিয়েছিলেন : আগে যারা সাম্রাজ‍্যবাদী যুদ্ধকে জাতীয় প্রতিরক্ষার নামে সমর্থন করেছেন অনমনীয়ভাবে তাদের বিরোধীতা। যারা সমাজতন্ত্র তথা প্রলেতারীয় একনায়কত্ত্বের পক্ষে এবং সমাজতান্ত্রিক ব‍্যবস্থার কাছাকাছি সোভিয়েত পদ্ধতির শাসন ব‍্যবস্থার সাথে একমত শুধু তারাই আমন্ত্রিত হবেন। লেনিন এ সম্মেলনের বক্তৃতায় বলেন মার্কস সহ সকল সমাজতন্ত্রীদের একটাই লক্ষ্য পুজিঁবাদী রাষ্ট্র শক্তির বিনাশ (destruction )। তিনি বলেন পৃর্বের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের তথাকথিত সমাজতন্ত্রীরা সমাজতান্ত্রিক তথা মেহনতিদের আন্দোলনের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে বিশ্ব পুজিবাদকে রক্ষা করেছে। ঐ ধারাকে সম্পূর্ণ বাতিল ও অগ্রাহ্য করে মার্কসীয় ধারায় প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ত্ব প্রতিষ্ঠার শ্লোগানকে সামনে রেখে তৃতীয় আন্তর্জাতিক নতুন গতিতে অগ্রসর হবে। লেনিন আরো বলেন পুজিঁবাদী একনায়কতন্ত্রের বিপরীতে প্রকৃত গণতন্ত্র অর্থাৎ মুক্তি ও সমতা অর্জন শুধু সোভিয়েত ব‍্যবস্থা বা প্রলেতারীয় গণতন্ত্রেই সম্ভব। তৃতীয় আন্তজার্তিক পঞ্চাশটি দেশের আটান্নটি কমিউনিস্ট পার্টিকে সংযুক্ত করেছিল। এই কাঠামো ও বাৎসরিক সম্মেলনের মাধ‍্যমে মার্কসবাদের বিপ্লবী তাত্ত্বিক ভিত্তি সমৃদ্ধ হয়েছিল। সাম্রাজ‍্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, অতি বামপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই এবং গণভিত্তি সম্পন্ন কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়োজনীয়তার বিষয়সমুহ গভীরভাবে আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত গ্রহনে তৃতীয় আন্তর্জাতিক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। তবে এ ধরনের কাঠামোতে সিদ্ধান্ত গ্রহনের কিছু সীমাবদ্ধতা বা কমিনটার্ন এর ওপর নির্ভরতা বাড়ার প্রবনতা দেখা দিচ্ছিল। তাছাড়া জার্মানিতে সোভিয়েত ধারার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব (১৯১৯) ব‍্যর্থ হওয়া , বিশ্ব বিপ্লবের সম্ভাবনা বাস্তবায়িত না হয়ে একদেশে সমাজতন্ত্র নির্মানের কাজ অগ্রসর করার ফলে সমাজতান্ত্রিক তত্ত্ব ও প্রয়োগে কিছু ভিন্নতা দেখা দেয়। পরবর্তীতে এটা অনুভূত হয় যে এরকম একটি কাঠামোতে আবদ্ধ না থেকে যার যার নিজের দেশে মার্কসবাদ লেনিনবাদের সৃষ্টিশীল প্রয়োগের উপর গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। এ ধরনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তৃতীয় আন্তজার্তিক ১৯৪৩ সালে বিলুপ্ত ঘোষনা করা হয়।

৫। যখন গোপেন চক্রবর্তী দূর্গাপুর ভ্রমণ করেন তখন বিশ্ব ব‍্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পটভূমি ছিল নিম্নরুপ:

এ সময়ের একটি অন‍্যতম যুগান্তকারী প্রধান ঘটনা রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লব। প‍্যারি কমিউনের পর (১৮৭১), এই প্রথম শ্রমিক কৃষকের নিজস্ব মালিকানায় জার সাম্রাজ্য যতটুকু বিস্তৃত ছিল তার সবটুকু নিয়ে নানা বাধা অতিক্রম ও চৌদ্দটি দেশের সাথে মরণপন লড়াই করে বুর্জোয়াদের হটিয়ে গণমানুষের স্বার্থে আধুনিক সোভিয়েত ব‍্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত, পরিচালিত ও অগ্রসর হয়েছিল। অন‍্যদিকে পশ্চিম ইউরোপ বিশেষত ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানির উপর ক্ষতিপূরনের যে দায় চাপানো হয়েছে তা বহন করা তাদের জন‍্য হয়ে উঠেছিল যন্ত্রণাকর ও বেদনাদায়ক। অন‍্যদিকে যুদ্ধের ভেতর দিয়ে লাভবান হলেও আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দেয়। আর ইউরোপে দেখা দিয়েছিল অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। ইতালিতে এ সময় ঘটেছে ফ‍্যাসিবাদের উথান। অন‍্যদিকে প্রাচ‍্যে বিশেষত এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সক্রিয় ও জোরদার হয়ে উঠেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমর্থন করাতে সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশ ভেঙ্গে পড়ছিল। অন‍্যদিকে, অটোমান সাম্রাজ‍্যের বিলুপ্তির পর কামাল আতাতুর্ক পাশার নেতৃত্বে তুরস্ক স্বাধীনতা লাভ করেছে ও একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিনত হচ্ছিল। চীনে ক্রমাগতভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আরব দেশগুলোর ভেতর সৌদি আরব সুলতানের মাধ‍্যমে শাসিত স্বাধীন দেশ। অন‍্যান‍্য আরব দেশ যথা মিশর, মরক্কো, ইরাক, সিরিয়া, প‍্যালেস্টাইন ও জর্ডনে সাম্রাজ‍্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম সক্রিয় ও জোরদার হচিছল।

৬। ভারতে প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধের সময় শিল্প উদ‍্যোগের গতি জোরালো হয়েছিল। তবে সাতাশি ভাগ কোম্পানির মূলধন ছিল ইংরেজদের। দ্রুত সমৃদ্ধ হচ্ছিল বস্ত্র ও খনি শিল্প। ১৯২২ সালের হিসাব অনুযায়ী ভারতে শ্রমিকের সংখ‍্যা ছিল দু’কোটির বেশি। এই শ্রমিকদের ছিল দীর্ঘ শ্রম দিন (এগার বা বারো ঘন্টা), সামান‍্য মজুরি, কাজের চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও বাসস্থান। মালিকদের ছিল একটাই লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি যথাসম্ভব যত বেশি মুনাফা।

৭।খেলাফত আন্দোলন (১৯১৯-১৯২৪) ইসলামী খেলাফত বা সরকার ব‍্যবস্থা পুনরুদ্ধারে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিবাদ আন্দোলন।

৮। গোপেন চক্রবর্তী ও সমাজতন্ত্রের চিন্তা :

সমাজতন্ত্রের সোভিয়েত মডেল:
সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব‍্যবস্থা একটি কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। উৎপাদন ও উৎপাদিকা শক্তির উপর ছিল পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। বেতন বা মজুরি বাজার ব‍্যবস্থা দিয়ে নির্ধারিত হত না। মৌলিক সেবা যথা খাদ‍্য, বস্ত্র, স্বাস্থ‍্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাসস্থান নিশ্চিত করা হয়েছিল। সবার জন‍্য বছরে একবার রাষ্ট্রীয় খরচে বিশ্রাম ও ভ্রমন।সোভিয়েত অর্থনীতিতে উৎপাদন ব‍্যবস্থার সম্পূর্ণ মালিকানা ছিল রাষ্ট্রের। যৌথ খামার, রাষ্ট্রীয় খামার, সামরিক ও বেসামরিক ভারি শিল্প, জ্বালানি, রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব‍্যবস্থা, মহাকাশ ও অন‍্যান‍্য বিজ্ঞান চর্চা এবং কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক নির্দেশ ভিত্তিক ব‍্যবস্থাপনা। সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বিবেচনা আমলে নিয়ে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব‍্যবস্থা গড়ে তোলা। আর এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর উন্নয়নে দক্ষ জনবল সৃষ্টি, উৎপাদিকা শক্তি তথা ভারি শিল্প বিকাশে সহযোগিতা, উন্নত পুজিঁবাদী দেশে শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের আন্দোলন ও বুর্জোয়াদের যুদ্ধবাজ নীতির বিরুদ্ধে শান্তির আন্দোলন শক্তিশালী ও সংহত করা।

৮। বাজার সমাজতন্ত্রের মডেল বলতে বোঝান হয় এমন সামাজিক অর্থনৈতিক ব‍্যবস্থা যেখানে উৎপাদিকা শক্তির মালিকানা সরকারি, সমবায় বা সামাজিক মালিকানার ভেতর বিস্তৃত। সিদ্ধান্ত গ্রহনে অনুসরণ করা হয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন। স্থানীয় ব‍্যবস্থাপকদের দেয়া হয় বাজার চাহিদা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ নেয়ার এখতিয়ার। অন‍্যতম প্রধান ধারনা হল পুজিঁবাদী ব‍্যবস্থার মতই বিভিন্ন বানিজ‍‍্যিক প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে মুনাফা অর্জন করতে পারবে। কিন্তু এ ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা থেকে যাবে ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের হাতে। বাজার সমাজতন্ত্রের রকম অনুযায়ী যা মুনাফা অর্জিত হবে তা কর্মীদের ভেতর বন্টন করা যাবে বা সামাজিক কার্যক্রম বা সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা সংহত করার কাজে ব‍্যবহৃত হতে পারবে বা জনহিতকর বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থায়নে ব‍্যবহৃত হতে পারবে। সামাজিক গণতন্ত্র (social democracy ) অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সাম‍্য অর্জনের জন‍্য কর ব‍্যবস্থাপনা, ভর্তুকি ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ব‍্যবহার করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দু’হাজার সাল থেকে দু’হাজার বারো পর্যন্ত বিশেষত দু’হাজার সাত আটের পুজিঁবাদী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ের পর লক্ষ্য করা যায় পশ্চিমে গ্রীন পার্টি, বাম লোকরঞ্জনবাদী ধারা বা দখল কর ওয়াল স্ট্রিট জাতীয় রাজনৈতিক ধারার উথানের। এদের অন‍্যতম প্রধান শ্লোগান ছিল আমরাই নিরান্নবই ভাগ। এধরনের আন্দোলনের প্রধান কারন ছিল ক্রমাগতভাবে নয়া উদারবাদী চিন্তা তথা বাজার ব‍্যবস্থাতেই সব কিছুর সমাধান ও অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরন ও ব‍্যাক্তিখাত ভিত্তিক পুজিঁবাদী ব‍্যবস্থার চরম বৈষম‍্যমূলক শোষন। এসব আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কিছু সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রী নেতৃবৃন্দের উথান হয়েছে যথা যুক্তরাজ্যে জেরেমি করবিন (লেবার পার্টি) আর যুক্তরাষ্ট্রে বার্নি স‍্যানডার্স (তিনি Democratic socialist, মূলত ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক বা সুইডেনে প্রচলিত সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রী ধারনার সমর্থক)। আমেরিকার গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক পার্টির (Democratic socialist of America ) সদস‍্য সংখ‍্যা প্রায় একলক্ষ। সাম্প্রতিক সময়ে এ পার্টির বিভিন্ন সদস‍‍্যদের যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এ পার্টির কয়েকজন নির্বাচিত সাংসদ হলেন Bernie Sanders, John conyers, Ron Dellums, David Bonior। এছাড়া অপেক্ষাকৃত নতূনদের মধ‍্যে রয়েছেন Alexandra Ocasio cortez, Rashida Tlaib, Cori Bush, Jamaal Bowman ও অন‍্যান‍্য সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রীরা। পুজিঁবাদী ব‍্যবস্থার সংস্কার করে গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় যেতে চান। এর বিপরীতে বাজার সমাজতান্ত্রিক ব‍্যবস্থা উৎপাদন ব‍্যবস্থার মালিকানার ও ব‍্যবস্থাপনার আমুল পরিবর্তন করে ঐ লক্ষ্যগুলো অর্জনে সচেষ্ট থাকে। বাজার সমাজতন্ত্রে ব‍্যাক্তি সম্পদ অর্জন অনুমোদিত। বাজারে কুটির শিল্প বা কৃষি পণ‍্যের দাম বাজার পরিস্থিতির (চাহিদা ও সরবরাহ ) মাধ‍্যমে নির্ধারিত। কৃষি খামারি তার উৎপাদিত সমুদয় বা আংশিক পণ‍্য বাজারে বিক্রি করে দিতে পারবেন। এ থেকে যে মুনাফা হবে তার সম্পূর্ণ বা আংশিক মালিকানা থাকবে তার। বাজার সমাজতন্ত্রের উদাহরন হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিন প্রবর্তিত নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচি (NEP), গণচীন, ভিয়েতনাম, বেলারুশ ও কিউবার পরীক্ষা নিরীক্ষাকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।

চীনা লক্ষন যুক্ত সমাজতন্ত্র কি!? যেখানে রাষ্ট্রীয় ও ব‍্যাক্তি মালিকানার প্রতিষ্ঠানে মূলধনী পণ‍্য “মুক্ত মূল‍্য নির্ধারণ” পদ্ধতিতে দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া ব‍্যাক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফা থেকে সামাজিক লভ‍্যাংশ (social dividend) সুবিধা বা কর্মীদের আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ ধরনের মুনাফার ব‍্যবহার নেই। রাষ্ট্রীয় ও ব‍্যাক্তি মালিকানার অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে বাজার অর্থনীতির নিয়ম মেনে। যথা স্টক এক্সচেঞ্জে ন‍্যায‍্য বানিজ‍্যের (trading equity ) ক্ষেত্রে পরোক্ষ সামষ্টিক অর্থনৈতিক (macroeconomic) পদ্ধতি যেভাবে পুজিঁবাদী দেশের সরকার করে থাকে। বাজার ব‍্যবস্থার মাধ‍্যমেই সকল ধরনের অর্থনৈতিক আদান প্রদান সম্পন্ন হয়ে থাকে। সকল রাষ্ট্রীয় ও ব‍্যাক্তি মালিকানাধীন খাতের প্রতিষ্ঠানসমুহ বাজার ব‍্যবস্থাপনার অধীনে কাজ করছে। যদিও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে এখনো indicative পরিকল্পনা পদ্ধতি ব‍্যবহৃত হচ্ছে। সোভিয়েত মডেলের প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনায় চীনা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা কারখানা গুলো জয়েন্ট স্টক কোম্পানি হিসাবে কাজ করছে। এধরনের ব‍্যবস্থাপনা করার ক্ষেত্রে পরিকল্পিত সমাজতন্ত্র গড়ার ভিত্তি হিসাবে বাজার অর্থনীতি ও পণ‍্য বিনিময় অর্থনীতির কথা তাত্ত্বিকভাবে সামনে আনা হয়েছে। এছাড়া এ যুক্তিও সামনে আনা হয়েছে যে সমাজতান্ত্রিক সমাজ তখনই নির্মাণ সম্ভব যখন বাজার অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা ঐতিহাসিকভাবে নিঃশেষিত হবে। অন‍্যদিকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বাজার অর্থনীতি ভিত্তিক উন্নয়ন স্তরকে অগ্রাহ্য করে সরাসরি সমাজতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় উত্তোরনের চেষ্টা করেছিল।

৯। সমাজতন্ত্রের গণতান্ত্রিক মডেল :
কার্ল মার্কস লিখেছিলেন গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হল সমাজতন্ত্রে যাবার পথ। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রীরা সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন মডেল প্রস্তাব করেছেন। সেটা বাজার সমাজতন্ত্র থেকে শুরু করে অংশগ্রহনমূলক সমাজতান্ত্রিক ব‍্যবস্থা যা বিকেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত। এ ব‍্যবস্থায় উৎপাদনের উপায়সমুহের মালিকানা ও ব‍্যবস্থাপনা থাকবে শ্রমিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এই ধারার অনুসারীরা কেন্দ্রীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত সোভিয়েত পদ্ধতির কমান্ড অর্থনৈতিক ব‍্যবস্থাপনার বিরোধী। যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ, উৎপাদন উপায় সমুহ যথা কল-কারখানা বা ব‍্যবসা সব কিছুর মালিকানা সামাজিক ও যৌথভাবে নিয়ন্ত্রিত। জনসাধারণ ও শ্রমিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণে স্বনির্ভর ব‍্যবস্থাপনায় গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ব‍্যবস্থা চলবে। দ্বিতীয় আন্তজার্তিকের অন‍্যতম নেত্রী রোজা লুক্সেমবার্গ বলেছিলেন বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ব‍্যবস্থা গড়ে উঠবে তৃণমূলের সক্রিয় অংশগ্রহনে। কার্ল মার্কস কমিউনিস্ট ইশতেহারে লিখেছেন বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে প্রথম কাজ হল সর্বহারার শাসন ক্ষমতায় আরোহন। এরপর পুজিঁবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তোরনে বিপ্লবী রুপান্তর পর্ব। এই স্তরে নেতৃত্ত্ব দেবে শ্রমিক শ্রেণি। এই সময়টা চিহ্নিত হবে সর্বহারার একনায়কত্ত্বের স্তর হিসাবে। সর্বহারা এই রুপান্তরের ভেতর দিয়ে শোষনমূলক পুজিঁবাদী রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙ্গে মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজব‍্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে কোন শোষনের সুযোগ থাকবে না। মানুষ পুজিঁবাদী শ্রমের বাজারের শৃঙ্খল থেকে হবে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। রোজা লুক্সেমবার্গ লিখেছেন “শ্রমজীবী মানুষের সমাজে গণতন্ত্র এমন উচ্চতর স্তরে পৌছাবে সেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে নির্বাচনে তার মতামত ব‍্যক্ত করবে। ভিন্নমত প্রকাশের সকল পরিবেশ বজায় থাকবে। সমাজতন্ত্র উন্নত ব‍্যবস্থা হওয়াতে মানুষ পুজিঁবাদের দিকে পিছন ফিরে তাকাবে না। আর স্বাধীন মতামত ব‍্যক্ত করার পরিবেশ ছাড়া যে কোন প্রতিষ্ঠান তার জীবনী শক্তি হারিয়ে ফেলবে। এরফলে জনজীবন তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে ! একদল পার্টি নেতা হয়তো অফুরন্ত জীবনি শক্তি আর আদর্শবাদী অবস্থান থেকে নির্দেশনা দেবেন ও পরিচালনা করবেন। তারা যেসব বক্তৃতা প্রধান নেতার জন‍্য লিখবেন এবং তারাই সভায় বিপুল হাততালি দেবেন! সেক্ষেত্রে এটা একনায়কতন্ত্র হবে ঠিকই , কিন্তু সর্বহারার একনায়কতন্ত্র তার সকল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে।” রোজা লুক্সেমবার্গ বুঝতেন “সমাজতন্ত্র শোষিত মেহনতি জনতার জন‍্য কোন দল কর্তৃক সেবা বা উপহার নয়। সমাজতন্ত্রের রাজনীতি ও সমাজতন্ত্র আত্মপ্রকাশ করবে সাধারণ, শোষিত, বঞ্চিতদের স্বেচ্ছাসেবী এবং সচেতন আন্দোলন থেকে। আর শ্রেণি বিভক্ত সমাজের সকল স্তরের ইতিহাস রচিত হয়েছে কোন হুকুমদারির মাধ‍্যমে নয়, এর প্রত‍্যেকটি অধ‍্যায়ে সাধারণ জনতার সরাসরি, গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে।” তাই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীরা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, মিশ্র অর্থনীতি, ব‍্যাপক সামাজিক বিমা, যথাযোগ‍্য পেনশন, এবং ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক খাতের উপর কাঠামো ও কৌশলগত সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং সার্বজনীন আবাসন, স্বাস্থ‍্য ও শিক্ষা ব‍্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অনুসারী। তবে ব‍্যক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার, ভিন্নমত প্রকাশ ও সার্বজনীন নির্বাচন ব‍্যবস্থা তারা দৃঢ়ভাবে অনুসরনে সংকল্পবদ্ধ।

১০। লাতিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্রের বলিভারিয়ান মডেল :
আঠারশ শতক পযর্ন্ত মধ‍্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ স্পেন ও পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল। তাই এ অঞ্চলে স্পানিশ ও পর্তুগীজ ভাষার প্রচলন হয়েছে। আর এ ভাষাগুলোর উৎপত্তি প্রাচীন ল‍্যাটিন থেকে সে সুত্রে এ মহাদেশের নাম হয়েছে লাতিন আমেরিকা! সিমন বলিভার ছিলেন ভেনেজুয়েলার জাতীয়তাবাদী নেতা ও সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল। উনিশ শতকে স্পেনের উপনিবেশ ও সাম্রাজ‍্যবাদী আগ্রাসী ব‍্যবস্থার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে ১৮২১ সালে তার নেতৃত্বে ভেনেজুয়েলা স্বাধীনতা লাভ করে। সিমন বলিভারের ধারনার অন‍্যতম উল্লেখযোগ্য দিকগুলো যা carta de jamaica ও discurso de angostora তে লেখা আছে তা নিম্নরুপ :
স্পানিশ ভাষাভাষি লাতিন দেশ সমুহের শিথিল ইউনিয়ন (উদাহরন gran Colombia ) গড়ে তোলা, সবার জন‍্য শিক্ষা, স্বাধীনতা ও যেকোন বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ সামরিক প্রতিরোধ। এ ধারাবাহিকতায় হুগো চাভেজ (ভেনেজুয়েলার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) অনুসৃত বলিভারিয় ধারনায় নিম্নোক্ত প্রসঙ্গগুলো প্রাধান্য পেয়েছে :
সাম্রাজ‍্যবাদ বিরোধীতা, তৃণমূল জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, দেশপ্রেম ও জনগণের সেবা, দক্ষিণ আমেরিকার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সাম‍্যের নীতির ভিত্তিতে জনসাধারনের মালিকানা প্রতিষ্ঠা বা বিতরন ও দূর্নীতির মূলোৎপাটন। চাভেজ যেমন প্রভাবিত হয়েছেন বলিভারের চিন্তার দ্বারা, তেমনি তাকে প্রভাবিত করেছে লাতিন আমেরিকার মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ ফেডেরিকো ব্রিটো ফিগেরোয়ার লেখা। আর তাছাড়া তরুণ বয়সে প্রভাবিত হয়েছেন লাতিন আমেরিকার ধ্রুপদী যৌথ সমবায়ের ঐতিহ্য দেখে। যেগুলো অনুসরণ করেছেন জর্জ এলিসার গাইটান (কলম্বিয়া), ফিদেল কাস্ত্রো (কিউবা), চে গুয়েভারা ( আর্জন্টিনা) এবং সালভাদর আলিয়েন্দে (চিলি)। জীবনের শেষ প্রান্তে চাভেজ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারনায় প্রভাবিত হন এবং সেটাকে বলিভারিয়ান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ‍্য অংশ হিসাবে ঘোষনা করেন। তিনি ঘোষনা দেন নতুন ধারার সমাজতন্ত্র অবশ্যই হবে মানবিক ও গণতান্ত্রিক। যা কিনা রাষ্ট্রযন্ত্র বা উৎপাদনের হাতিয়ারকে প্রাধান্য না দিয়ে মানুষকে প্রাধান্য দেবে। এই বলিভারীয় ধারার রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে ও হচ্ছে বলিভিয়া, গুয়াতেমালা, ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ায়।

১১। কমরেড গোপেন চক্রবর্তীর দূর্গাপুর সফরে কি দাড়িয়েছিল ফলাফল!? গোপেন চক্রবর্তী তিন চারদিন সুসঙ্গ দূর্গাপুরে ছিলেন। তিনি এটুকু বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন যে এ ধরনের সন্ত্রাসবাদী ও সংস্কার কাজ করে পরিস্থিতির পরিবর্তন করা যাবে না। প্রয়োজন পুরো সমাজ কাঠামোর আমূল বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আর তা করতে হলে সমাজের অগ্রবাহিনী শ্রমিক শ্রেণিকে সচেতন ও সংগঠিত করতে হবে। আর সংগঠিত সচেতন শ্রমিক শ্রেণিই হবে বিপ্লবের অগ্রবাহিনী। তারাই বুর্জোয়া ব‍্যবস্থাকে বদলে নতুন সমাজ গড়ে তুলবে। আর কলকাতা শহরে অনেক কল কারখানা গড়ে উঠছে। সেখানে শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করে তারা শোষিত ও বঞ্চিত। তারা অসচেতন, অশিক্ষিত ও অসংগঠিত। তাদেরকে সচেতন ও সংগঠিত করে সমাজের বিপ্লবী পরিবর্তনের কাজকে তথা বিপ্লব সংগঠিত করার কাজে এগিয়ে নিতে হবে। সোভিয়েত দেশে শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের বিপ্লব ও নিজেদের শাসন ব‍্যবস্থা প্রতিষ্ঠা তার একটি সফল ও জ্বলন্ত উদাহরন। বহু তর্ক বিতর্কের পর ধীরে ধীরে মনীন্দ্র সিংহ ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা কমরেড গোপেন চক্রবর্তীর সব যুক্তির সাথে একমত না হলেও তার কথার সাথে দ্বিমত করে জোরালো অবস্থান তৈরি করতে পারলেন না। এ অবস্থায় মনীন্দ্র সিংহ বললেন তিনি কোলকাতায় লেখাপড়া করেছেন। সেখানকার সবকিছুই তার জানা। তাই কোলকাতা গিয়ে এ ধরনের বিপ্লবের লক্ষ‍্যে কাজ করা তার পক্ষে কঠিন হবে না। তার মামাতো ভাইও তার সাথে যোগদিতে সম্মত হলেন! সে সুত্রে মনীন্দ্র সিংহ ১৯২৮ সালে চলে আসেন কোলকাতায়, দেখা করেন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন‍্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফফর আহমেদের সাথে তার হ‍্যারিসন রোডের অফিসে । তার কথা ও নির্দেশে অনুপ্রাণিত হয়ে চলে যান কলকাতার কাছে মেটিয়াবুরুজ শ্রমিক এলাকায়। সেখানে ট্রেড ইউনিয়নের অফিস খুলে কাজ শুরু করেন সুতাকলের শ্রমিকদের সাথে। তারা ছিল বেশিরভাগ উর্দুভাষী তাই তাকে অল্প সময়ে উর্দুভাষাও রপ্ত করতে হয়! এভাবেই সময় এগিয়ে যায়, ধীরে ধীরে শ্রমিকদের আন্দোলন দানা বাধতে থাকে। শক্তিশালী হয়ে উঠে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন। একপর্যায়ে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আর মালিকের শোষনের বিরুদ্ধে কারখানায় শুরু হয় ধর্মঘট ! মালিক পক্ষ হয়ে পড়েন আতঙ্কিত! শুরু হয় শ্রমিকদের সাথে সমঝোতার আলোচনা। অন‍্যদিকে উনিশ তিরিশ সালের প্রথম দিকে গ্রেফতার হয়ে যান মনীন্দ্র সিংহ। বিচারে তার পাঁচ বছরের সাজা হয়। পাঁচ বছর পর যখন তিনি গ্রামের বাড়ি সুসঙ্গ দূর্গাপুরে থাকার ও কোলকাতায় না থাকার শর্তে মুক্তিপান, তখন ১৯৩৫ সাল, বৃটিশ সরকারের নির্দেশে কমিউনিস্ট পার্টি হয়েছে বেআইনি! আর ১৯৩৫ সালে বাংলায় নির্বাচনের মাধ‍‍্যমে ক্ষমতায় এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টির সাথে মুসলিম লীগের যৌথ সরকার। সেদিন কে জানতো ময়মনসিংহের, নেত্রকোণা মহকুমার সুসঙ্গ দূর্গাপুরের এক নিভৃত গ্রামের দেশপ্রেমিক, বৃটিশ বিরোধী এই তরুণ জেল, জুলুম, অত‍্যাচার, নির্যাতন সহ‍্য করে এদেশের রাজনৈতিক ও জনতার মহলে একদিন পরিচিত হয়ে উঠবেন কমরেড মণি সিং হিসেবে! সর্বস্বত‍্যাগী দেশপ্রেমিক কমিউনিস্ট জাতীয় নেতা হিসেবে যার নাম ছড়িয়ে পড়বে দেশে ও বিদেশে! আর পরবর্তীতে বাঙালির শোষনমুক্তি ও সমাজতান্ত্রিক চেতনার আলোকবর্তিকা ও কিংবদন্তির নায়ক হিসেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে!

তারিখ সুসঙ্গ দূর্গাপুর ৩রা ফেব্রুয়ারি ২০২৪

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ