প্রীতি ওরাং-এর মৃত্যু: আশফাকুল ও তার স্ত্রী তানিয়ার বিচার দাবি

প্রকাশিত: ১০:০৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৪

প্রীতি ওরাং-এর মৃত্যু: আশফাকুল ও তার স্ত্রী তানিয়ার বিচার দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ : রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতি ওরাং-কে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারের ফাঁসিসহ দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছে গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক।

আজ মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে সংগঠনের সভাপতি আবুল হোসেন এ দাবি জানান।

এতে সভাপতিত্ব করেন ১২টি জাতীয় ট্রেড ইউনিয়নের জোট শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল ওয়াহেদ। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় গার্হস্থ নারী শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুরশিদা আক্তার নাহার, ব্লাস্টের সিনিয়র আউটরিচ অফিসার আমান উল্লাহ প্রমুখ।

গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের সভাপতি আবুল হোসেন এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে দেশে আর কোনো গৃহকর্মী হত্যার ঘটনা ঘটবে না বলেও উল্লেখ করেন।

এ সময় আবুল হোসেন বলেন, ‘প্রীতি ওরাং-কে সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার তাদের ভবনের আট তলা ফ্ল্যাট থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছেন।

সেখানে যারা প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তারা প্রীতির লাশ দেখে বলেছে প্রীতির শরীরের কাপড় খোলামেলা ছিল। এটা প্রাথমিকভাবে প্রমাণ করে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ১৫ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এ ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করায় প্রীতির পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

মামলা তুলে নিতে বলা হচ্ছে। অভিযুক্ত ডেইলি স্টার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। আমরা রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ করব প্রীতির পরিবারকে উপযুক্ত নিরাপত্তা দেওয়া হোক। সাংবাদিক ভাইদের মাধ্যমে আমি সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করতে চাই প্রীতি হত্যার বিচারে আপনারা সবাই এগিয়ে আসুন।
সবাই মানবিক হোন, এক প্রীতির বিচার হলে আর কোনো প্রীতিকে এভাবে মরতে হবে না।’

সমাবেশে নিহত প্রীতির বড় বোন কবিতা ওরাং বলেন, ‘আমার ছোট বোন জীবিকা নির্বাহের জন্য ঢাকায় এসেছিল। কিন্তু তাকে লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরতে হয়েছে। প্রীতির হত্যাকারীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফাঁসির দাবি জানাচ্ছি। প্রীতির এই হত্যাকাণ্ড আমরা মেনে নিতে পারি না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনুন।

প্রতিবাদ সমাবেশে ওরাং ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা কমিটির সভাপতি এবং বৃহত্তর সিলেটের ওরাংগের সভাপতি পূরণ ওরাং বলেন, ‘প্রীতি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যাতে মামলা করা না হয় এজন্য বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করা হয়েছে। হত্যাকারী সৈয়দ আশফাকুল হক একটি জাতীয় দৈনিকের উচ্চপদস্থ দায়িত্বে আছেন। তিনি এত বড় দায়িত্বে থেকে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হয়ে অমানবিক আচরণ করেছেন। এজন্য আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করতে চাই না, আমরা চাই প্রকৃত হত্যাকারীর বিচার হোক। আমরা জেনেছি ডেইলি স্টার পত্রিকার জেলা প্রতিনিধির মাধ্যমে মৌলভীবাজার থেকে প্রীতিকে তার বাসায় কাজের মেয়ে হিসেবে আনা হয়েছে। এর আগেও সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসা থেকে আরেকজন গৃহকর্মী পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়, সেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। একইভাবে প্রীতির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা মিডিয়ার ভাইদের প্রতি অনুরোধ করতে চাই, প্রীতির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে যেন কোনো অসত্য প্রতিবেদন ছাপা না হয়। প্রীতিকে যেভাবে বিবস্ত্র করে ওপর থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে এটা অত্যন্ত অমানবিক। প্রীতির বিচারের দাবিতে গোটা বাংলাদেশ ফুসে উঠেছে। এই ঘটনায় মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছি। আমরা অনুরোধ করব, এই বিচার যেন বানচাল করা না হয়। যদি উপযুক্ত বিচার না হয় আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।’

প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রীতির মা। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানকে যারা নিষ্ঠুরভাবে বাসা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে তাদের ফাঁসির নিশ্চিত করতে হবে। আমার সন্তান মৃত্যুর পর আমি বিছানায় ঘুমাতে পারি না। চোখ বন্ধ করলেই আমার সন্তানের লাশ দেখি। আপনারা এখানে যারা আছেন হয়তো সবাই সন্তানের বাবা অথবা মা। আপনারা আমার কষ্টের কথা অনুধাবন করেন। যাতে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হয় এ জন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই।’

এদিকে গৃহকর্মী প্রীতি উড়াংয়ের মৃত্যুতে উদ্বেগ জানিয়ে দায়ীদের বিচার দাবিতে একই সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে একটি সংগঠন।

শিশু গৃহকর্মী চা শ্রমিকের সন্তান প্রীতি উড়াংয়ের হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন তার মা নমিতা উড়াং।

ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসার ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে গৃহকর্মী প্রীতি উড়াংকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে নমিতা উড়াং বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ বলে কি আপনাদের কোনো দয়া-মায়া নাই? আমার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। আমার মেয়েকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’ এতে আরও বক্তব্য দেন প্রীতির বাবা লোকেশ উড়াং, চাচাতো বোন কবিতা ও দাদা সংকর তাঁতী।

প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যু: আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী ৪ দিনের রিমান্ডে

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গত সপ্তাহে আবাসিক ভবন থেকে পড়ে কিশোরী গৃহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ঢাকার একটি আদালত।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও মোহাম্মদপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হাসান ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে, ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুর রহমান ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

গত বুধবার তাদের এ মামলায় প্রথম আদালতে হাজির করা হলে অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুল হক পুলিশের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে তদন্ত কর্মকর্তাকে কারা গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করার আদেশ দেন।

মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হাসান গত সোমবার সন্দেহভাজন দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং গতকাল ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনসহ আদালতে প্রতিবেদন দেন।

রিমান্ড আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা জানান, দম্পতির বাড়ির ভেতরে একটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে তবে পুলিশ কোনো মেমোরি কার্ড খুঁজে পায়নি এবং মেমোরি কার্ডটি খুঁজে পেতে অভিযুক্তদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।

আদালত আশফাকুল হকের কাছে ক্যামেরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতে কোনো মেমোরি কার্ড ছিল না।

তদন্ত কর্মকর্তা আরও জানান, কারাগারের দুটি গেটে পৃথক জিজ্ঞাসাবাদের সময় আসামিরা এমন কিছু তথ্য দিয়েছে যা সামনাসামনি জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে যাচাই করা দরকার।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আশরাফ উল আলম ও চৈতন্য চন্দ্র হালদার রিমান্ড আবেদনের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে বলেন, ঘটনার পরপরই আটকের পর উভয় অভিযুক্তকে পুলিশ হেফাজতে ৩৬ ঘণ্টা পুলিশ হেফাজতে একসঙ্গে ও আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

এছাড়া আদালতের নির্দেশে আশফাকুল হক ও তানিয়া খন্দকারকে কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর কারাগারের গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আরও বলেন, জামিনযোগ্য ধারায় দায়ের করা মামলায় আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের উল্লেখ করে তারা জানায়, জামিনযোগ্য ধারায় দায়ের করা মামলায় নিম্ন আদালত ‘অভিযুক্তকে জামিন দেবেন’।

উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

গত মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে ওই দম্পতির ফ্ল্যাটের অষ্টম তলার জানালা দিয়ে পড়ে মৌলভীবাজারের গৃহকর্মী প্রীতি উরাং (১৫) মারা যান।

ঘটনার কিছুক্ষণ পর পুলিশ আশফাকুল হক ও তানিয়া খন্দকারকে হেফাজতে নেয়।

নিহতের পরিবার বাদী হয়ে অবহেলাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় মামলা করলে গত বুধবার তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ।

এদিকে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে বিচার দাবি করেছেন প্রীতির বাবা-মা।

এছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) প্রীতির মৃত্যুতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত এমএসএফের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তদন্ত প্রতিবেদনে তার শরীরে নতুন ও পুরোনো আঘাতের চিহ্নের কথা উল্লেখ আছে।

‘এই হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা সবার মধ্যে গভীর দুঃখ ও চরম ক্ষোভের সঞ্চার করেছে,’ এই ঘটনার স্বাধীন তদন্ত এবং দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।

আসক এর নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সল স্বাক্ষরিত বিবৃতিতেও স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে।

বিবৃতিতে এ ঘটনার দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়। এছাড়া শিশুদের গৃহকর্মে নিয়োগ বন্ধে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানায় সংস্থাটি।

আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতি ওরাং-কে হত্যার দ্রুত বিচারের দাবিতে শ্রীমঙ্গলে মানববন্ধন 

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতি ওরাং-কে হত্যার দ্রুত বিচারের দাবিতে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বৃহস্পতিবার সকালে শ্রীমঙ্গল চৌমুহনায় মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ