শহীদ সেলিমের স্মৃতি নিয়ে আছেন স্ত্রী নাসিমা জাহান জেসমিন ও মেয়ে নুসরাত জাহান ডরথী

প্রকাশিত: ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৪

শহীদ সেলিমের স্মৃতি নিয়ে আছেন স্ত্রী নাসিমা জাহান জেসমিন ও মেয়ে নুসরাত জাহান ডরথী

Manual1 Ad Code

বিপ্লব রায় |

বরিশালের সূর্য সন্তান শহীদ এইচএম ইব্রাহিম সেলিম ও কাজী দেলোয়ার হোসেনের আত্মত্যাগের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কেউ এখন আর জানে না। জানানোও হয় না কখনো। বিভিন্ন দিবসে বহু আলোচনা হলেও এই সূর্যসন্তানদের ইতিহাস সেখানে বিস্মৃত। আজ শহীদ সেলিম-দেলোয়ার দিবস। তাই যুগের পর যুগ এসব স্মৃতি বুকে আঁকড়ে ধরে আছেন শুধু তাদের পরিবারের মানুষগুলো।

জীবন সঙ্গী শহীদ ইব্রাহিম সেলিমের প্রতিটি স্মৃতি ছুঁয়ে এখনো ডুকরে কেঁদে ওঠেন স্ত্রী নাসিমা জাহান জেসমিন। বিয়ের মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালে তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের দাবিতে ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় মিছিল দেওয়ার সময় ট্রাকচাপা দিয়ে পুলিশ হত্যা করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র সেলিম ও কাজী দেলোয়ার হোসেনকে। তাঁরা দুজনই ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা। এরপর থেকে ছয়মাস বয়সী একমাত্র মেয়ে নুসরাত জাহান ডরথীকে নিয়ে শুরু হয় তাঁর কঠিন জীবন সংগ্রাম। ডরথি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। কিন্তু সংগ্রাম থামেনি তাঁদের। থামেনি কান্নাও।

গত শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) বরিশালের কাউনিয়া সড়কে এ প্রতিবেদকের কথা হয় নাসিমা জাহান জেসমিনের সঙ্গে। তিনি জানান, এক সময়ে বিলাসী জীবন ছেড়ে এখন বাস করছেন জরাজীর্ণ একতলা স্যাঁতসেঁতে একটি ঘরে। কথায় কথায় চোখ মোছেন। স্বামীর সঙ্গে প্রেম-বিয়ে, বিরহ ও বিশেষ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বলেন, দুঃখ নিয়ে আর দুঃখ নেই। সব মানিয়ে নিয়েছি। এখন শরীরেও বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ। এসব নিয়েই দিন কাটছে তাদের।

নাসিমা জাহান বলেন, বাবা ডা. আতিকুল্লাহ ছিলেন বাউফল থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচও)। তাই পরিবারের সঙ্গে সেখানের সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন তিনি। এসময় বড়ভাই খাইরুল আনাম ফুয়াদের বন্ধু হিসেবে ইব্রাহিম সেলিম তাদের বাসায় আসতেন। এখান থেকে পরিচয় ও প্রেম।

প্রেম চলেছে অতি গোপনে। কিন্তু পরে আর গোপন থাকেনি কিছুই। সেলিম ঢাকা থেকে রঙিন খামে শুকনো গোলাপের পাপড়ি মোড়ানো চিঠি লিখে পাঠাতেন জেসমিনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বেবীর বটতলার বাসার ঠিকানায়। সেখান থেকে চিঠি নিয়ে পড়তে গিয়েও ধরা খেয়েছেন মায়ের কাছে। শুনেছেন নানা বকুনি। কিন্তু তবুও প্রেম চলেছে চুকিয়ে। তবে এত গভীর প্রেমের মধ্যে কিছুটা বিরহও ছিল তাদের। অকারণেই মাঝখানে কয়েক মাস কথা বন্ধ ছিল জেসমিনের। একটানা প্রেম ভালো লাগেনি বলে। এরপর সেলিমের চেষ্টায় ছিন্নপত্রে জোড়া লেগেছে আবার।

Manual8 Ad Code

এভাবে কিছুদিন পর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৮২ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে জেসমিন বরিশালে এসে বিয়ে সেলিমকে করেন। কিন্তু বিধি বাম! সেলিম তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। তাই বেকার ছেলেকে বিয়ে করায় কেউ তাদের মেনে নেননি। আর বিয়ের মাত্র ২ বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে স্বামীও পুলিশের আঘাতে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন।

তিনি জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর সেদিনই এ খবর পেয়েছিলেন তাঁর বড়ভাই খায়রুল আনাম ফুয়াদ (বর্তমানে বেঁচে নেই)। তিনি জেসমিনকে বরিশাল থেকে লঞ্চে বাউফলে স্বামীর কাছে নিয়ে যান। এসময় লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। মেয়ে ডরথির বয়স তখন মাত্র ৬ মাস। স্বামীর মৃত্যুর পর এরশাদ সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রত্যাখ্যান করেছেন জেসমিন।
এসব ঘটনার পর বাবা ডা. আতিকুল্লাহ এই বিয়ে মেনে নিলেও মা হাসনাহেনা ছিলেন নাছোড়বান্দা। বহু সাধনার পর তিনি মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন ১৫ বছর পর।

Manual6 Ad Code

স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবারের অন্য সদস্যরাও মুখ ফিরিয়ে নেয় তার কাছ থেকে। শুনতে হয় সামাজিক ও পারিবারিক নানা গালমন্দ। এসেছে প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব। কিন্তু সব এড়িয়ে বরিশাল মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি ও সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ থেকে বাংলায় ¯œাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এরপর আর পড়া হয়নি তাঁর।

স্বামীর স্মৃতিচারণ করে জেসমিন বলেন, সেলিমকে এমন করে হত্যা করা হবে, কেউ বুঝতে পারিনি। তাই কিছু বলেও গেল না। বিশাল বিত্ত বৈভবের স্বপ্ন ছিল না সেলিমের। ছিল সততার সঙ্গে স্বচ্ছলতা নিয়ে ঢাকায় বসবাস করা।
মধুর স্মৃতিচারণ করে তিনি জানান, বিয়ের পর জোসনা রাতে বরিশালের সোনালী সিনেমা হলে ‘কালো গোলাপ’ সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন দু’জন। নিজে পরেছিলেন লাল পাড়ের শাদা শাড়ি। কপালে বড় টিপ। সিনেমা দেখা শেষে চাঁদনি রাতে হাত ধরাধরি করে নির্জন রাস্তায়ও হেঁটে হেঁটে গল্প করেছেন তারা। এসব স্মৃতি তাঁকে আজো কাঁদায়।

নাসিমা জাহান জেসমিনের বয়স এখন ৬৩। স্বামীর বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের নাজিরপুর এলাকায় শহীদ সেলিমের অনেক সম্পত্তি থাকলেও তার প্রভাবশালী দেবর সব দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ তাঁর। তাই বাবার কবরও জিয়ারত করতে যেতে পারেন না মেয়ে ডরথী। এখন সংসার চলে একমাত্র মেয়ে নুসরাত জাহান ডরথির চাকরির টাকায়। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদেরকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে দিয়েছিলেন, সেখান থেকে পাওয়া কিছু লাভের টাকায় টেনেটুনে তাদের দিন চলে।

তিনি বলেন, সেলিম চলে গেলেও তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাদেরকে ভোলেননি। এর মধ্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ওয়াহিদ্জুামান চান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বাহাউদ্দিন গোলাপ ও বাউফলের পৌরমেয়র জিয়াউল হক জুয়েল অন্যতম। তারা এখনো তাদের খোঁজ খবর নেন। সাধ্যমত সহায়তা করেন।
এছাড়াও মেয়ে ডরথীকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি, ঘরসহ ১৫ শতাংশ জমিও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই এই পরিবারটির।

Manual6 Ad Code

শহীদ সেলিমের মেয়ে নুসরাত জাহান ডরথী জানান, বাবা ছাড়া পৃথিবীটা কত কঠিন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। নানা সংঘাত এড়াতে পারিবারিক অনেক কথাও বুকে চেপে সয়ে যেতে হচ্ছে। বাবা থাকলে জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। তবুও এখনো বাবার জন্য অপেক্ষা করি। যদি কখনো এসে একটু মা বলে ডাক দেয়!
#

Manual2 Ad Code

বিপ্লব রায়
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
দৈনিক মতবাদ

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code